বিএনপিকে অনুসরণ করে গত বছরের ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ থেকে কর্মসূচি দিলেও ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর জামায়াতে ইসলামীর অবস্থানে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। এই কর্মসূচি ঘোষণার দু’দিন পরও জামায়াত নীরব। কালো পতাকা মিছিল করবে না দলটি। কী কর্মসূচি দেবে, তাও স্পষ্ট করেনি।
জামায়াতের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা গত রোববার সমকালকে জানান, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি কর্মসূচি দিতে বিএনপির প্রস্তাব রয়েছে। তবে কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি ইসলামিক দলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিকল্প কী কর্মসূচি দেওয়া যেতে পারে, তা ভাবা হচ্ছে। এই নেতা জানিয়েছিলেন, সোমবার কর্মসূচির ঘোষণা আসবে।
তবে গতকাল জামায়াত সূত্র জানায়, কর্মসূচি দেওয়া হবে কিনা তা অনিশ্চিত। এই সূত্রের ভাষ্য, গত অক্টোবরের পর সাড়ে তিন হাজারের বেশি নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। গ্রেপ্তার এড়াতে বাড়িছাড়া হয়েছেন ১ লাখ ৬ হাজারের বেশি নেতাকর্মী। মামলায় আসামি হয়েছেন ২ লাখ ৭৯ হাজারের বেশি নেতাকর্মী। হতাহত অনেকে। নির্বাচন যেভাবেই হোক হয়ে গেছে, ঝুঁকি নিয়ে মিছিল-সমাবেশ করে কতটা ফল হবে, নিশ্চয়তা নেই। তাই রাজপথে কর্মসূচির চেয়ে সাংগঠনিক কাজ এবং নেতাকর্মীর স্বাভাবিক জীবনে ফেরাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
১৯৯৯ সালে জোট করে বিএনপি ও জামায়াত। জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য বিএনপি প্রশ্নের মুখে পড়লেও জোট টিকে ছিল। তবে ২০১৫ সাল থেকেই নিষ্ক্রিয় ছিল জোট। ২০১৮ সালে জোটবদ্ধ নির্বাচন করে বিএনপি ও জামায়াত। নির্বাচনের পর ফের দূরত্ব তৈরি হয়।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি আন্দোলন শুরুর পর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সমঝোতার ভিত্তিতে জোট ভাঙে। ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দেয় জামায়াত। বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচি অনুসরণ শুরু করে জামায়াত।
যুগপৎ আন্দোলনের তিন দিনের মাথায় জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান গ্রেপ্তার হন। যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি পালনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাধা ও হামলার মুখে পড়ে দলটি। গ্রেপ্তার ও আক্রান্ত হন নেতাকর্মীরা। বিএনপি এর প্রতিবাদ না করায় প্রকাশ্যেই ক্ষোভ জানিয়ে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুগপৎ আন্দোলন থেকে সরে যায় জামায়াত।
গত বছরের ১০ জুন এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো ঢাকায় সমাবেশের অনুমতি পায় জামায়াত। এতে সরকারের সঙ্গে দলটির যোগাযোগের গুঞ্জন তৈরি হয়। কিন্তু পরের মাসগুলোতে বারবার আবেদন করেও সভা-সমাবেশ করার অনুমতি পায়নি জামায়াত। তবে অক্টোবরে পরিস্থিতিতে বদল আসে। হঠাৎ বিএনপির অনুসরণে কর্মসূচি দেয়। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের দিনে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর মতো জামায়াতও মহাসমাবেশের কর্মসূচি দেয়। যদিও দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা কয়েকদিন আগেও জানিয়েছিলেন, ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের পরিকল্পনা নেই।
২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সহিংসতা হয়। তবে পুলিশের অলিখিত অনুমতিতে দেড় কিলোমিটার দূরে আরামবাগে অনেকটাই নির্বিঘ্নে মহাসমাবেশ করে জাময়াত। ওই দিন থেকে গত ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বিএনপি যখন যে কর্মসূচি দিয়েছে, জামায়াত তা অনুসরণ করেছে। বিএনপির সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে হরতাল, অবরোধ, গণসংযোগ, লিফলেট
বিতরণের মতো কর্মসূচি করেছে দলীয় ব্যানারে। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম সমকালকে বলেছেন, জামায়াত আন্দোলনে ছিল, থাকবে।
জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মুজিবুর রহমান সোমবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, জুলুমবাজ সরকারের শেষরক্ষা হবে না। রাজপথে যে আন্দোলন, তা জুলুমবাজ সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। বিনাভোটের সরকারের পতনে সবাইকে রাজপথে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে ২০১০ সাল থেকে কোণঠাসা জামায়াত। দলের শীর্ষ নেতাদের সাজা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়। অন্য নেতারা সহিংসতার মামলায় আসামি হয়েছেন। দলের আমির ছাড়াও সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিনসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা কয়েক বছর ধরে কারাগারে রয়েছেন। একাধিকবার জামিন পেলেও নতুন নতুন মামলায় গ্রেপ্তারের ফলে মুক্তি মেলেনি।
২০১৩ সালে হাইকোর্টে বাতিল হয় জামায়াতের নিবন্ধন। গত নভেম্বরে সেই আদেশই বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। নির্বাচন ঠেকাতে না পারায় বিএনপির মতো জামায়াতও চাপে পড়েছে।
সমকাল