বান্দরবানে ব্যাংক লুট; হ্যান্ডেল কেএনএফ উইথ কেয়ার

শেখ রোকন

মঙ্গল ও বুধবার বান্দরবান জেলার রুমা ও থানচি উপজেলায় সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের তিনটি শাখায় সশস্ত্র সংগঠন ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ বা ‘কেএনএফ’ যেভাবে অস্ত্রবাজি শেষে লুট বা ভল্ট ভাঙার চেষ্টা করেছে, সেটা প্রায় নজিরবিহীন। অন্তত ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সরকার ও শান্তিবাহিনীর মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর এ ধরনের তৎপরতা দেখা যায়নি। এটা ঠিক, ওই অঞ্চলের বৃহত্তম সংগঠন পাবর্ত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি- জেএসএস কয়েক দফা ভেঙে ইউপিডিএফ কিংবা জেএসএস (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গঠিত হওয়ার পর ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ও রক্তপাত বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু জনস্থাপনায় হামলা বা ব্যাংক লুটের মতো অঘটন দেখা যায়নি।

এটা সত্য, ২০১৯ সালে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই কেএনএফ বেশ কিছু নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়ে এসেছে। সমর্থন, অস্ত্রশক্তি, জনবল ও অর্থবলে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র গোষ্ঠী হয়েও কিছু বেপরোয়া পদক্ষেপ নিয়ে অল্প দিনেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে তারা। যেমন ‘শান্তিচুক্তি’-পূর্ববর্তী সময়ের মতো আইনশৃঙ্খলা ও সশস্ত্র বাহিনীর ওপর হামলা। যেমন নবীন সংগঠন হয়েও প্রাচীন ও প্রভাবশালী জেএসএস বা ইউপিডিএফের ওপর হামলা।

কেএনএফের সম্ভবত সবচেয়ে নজিরবিহীন তৎপরতা ছিল ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে অ-পাহাড়ি ও সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগোষ্ঠীভিত্তিক নতুন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জোট বাঁধা। সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশের ১৯টি জেলা থেকে ‘হিজরত’-এর নামে যে অর্ধশতাধিক তরুণ ‘নিখোঁজ’ হয়েছিল, তাদের প্রশিক্ষণের জন্য ২০২১ সালে কেএনএফ ও জামাতুল আনসারের লিখিত চুক্তি হয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত অ-পাহাড়ি জঙ্গি সংগঠনের কাছে পরবর্তী সময়ে অস্ত্রও বিক্রি করে পাহাড়ি সশস্ত্র এ গোষ্ঠী। ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে দুই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই কম্বিং অপারেশন শুরু হয়। গত বছর আগস্ট পর্যন্ত এসব অভিযানে দুই গোষ্ঠীর শতাধিক সদস্য গ্রেপ্তারও হয়। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থিত  ঘাঁটি ও প্রশিক্ষণ শিবির।

দৃশ্যত, গত বছরের মাঝামাঝি থেকেই কেএনএফ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সেটা কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কম্বিং অপারেশনের কারণে নয়; সীমান্তের বাইরের পরিস্থিতির কারণেও। কারণ কেএনএফের তৎপরতা যে অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত; মূলত বান্দরবান ও রাঙামাটির কয়েকটি উপজেলায়, সেটা তিন দেশের সীমান্ত অঞ্চল। বিশেষত কেএনএফ ‘স্ট্রংহোল্ড’ রুমা ও থানচির একদিকে রয়েছে ভারতের মিজোরাম রাজ্য, অপরদিকে মিয়ানমারের চিন স্টেট। গত বছর অক্টোবরে মিয়ানমারে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর জান্তাবিরোধী ‘অপারেশন ১০২৭’ শুরু হওয়ার পর কেএনএফ সম্ভবত বাংলাদেশ সীমান্তের বাইরের সমর্থকদের অগ্রাধিকার তালিকায় পিছিয়ে পড়ে। কোণঠাসা কেএনএফের পক্ষে শান্তি আলোচনায় বসা ছাড়া অস্তিত্ব রক্ষার আর কোনো পথ ছিল না।

পরিস্থিতির ধারাবাহিকতায় গত বছর মে মাসে বান্দরবানের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধি নিয়ে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা মারমার নেতৃত্বে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’ গঠিত হয়। এর পর জুলাই ও অগাস্ট মাসে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও কেএনএফের মধ্যে দুইবার ‘ভার্চুয়ালি’ বৈঠক হয়। আর ৫ নভেম্বর রুমা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মুনলাইপাড়ায় প্রথমবারের মতো সরাসরি বৈঠক হয়। দুই পক্ষের দ্বিতীয় বৈঠকটি হয়েছিল গত ৫ মার্চ আরও কেন্দ্রস্থলে; রুমা সদরের বেথেলপাড়া কমিউনিটি সেন্টারে। সেখানে আরও অন্তত সাতটি বিষয়ে ঐকমত্য ও সমঝোতা হয়।

কেক কেটে পরস্পরকে খাওয়ানো এবং বম শিল্পীদের দেশাত্মবোধক গানের মধ্য দিয়ে ‘সৌহার্দপূর্ণ’ পরিবেশে আলোচনায় কেএনএফ ৭ দফা দাবি উপস্থাপন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য– কেএনএফের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার, নতুন করে সংঘাতে না জড়ানো, কেএনএফ সদস্যদের পুনর্বাসন ও সহায়তা। দ্বিতীয়বারের সরাসরি বৈঠকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পর্যায়ের কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। কেএনফের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি তথা সাধারণ সম্পাদক লালজংময় বমের নেতৃত্বে ৮ সদস্য অংশ নেন।

কথা ছিল, দু’পক্ষ এ মাসের ২২ তারিখ আবার বৈঠকে বসবে। তার বদলে ব্যাংকে হামলা চালানো হলো। আর শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষ থেকেও বৃহস্পতিবার বলে দেওয়া হয়েছে– আর আলোচনা নয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা ও প্রতিরক্ষা বাহিনী যৌথ অভিযান শুরু করেছে। ওদিকে কেএনএফ ফেসবুক পেজ থেকেও কার্যত হম্বিতম্বি চলছে।

এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই– কেএনএফ গঠনের নেপথ্যে বাংলাদেশেরই কোনো কোনো পক্ষের বিশেষ সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল। হতে পারে, প্রথম দিকে খাঁচার ভেতর থাকলেও যখন পাখা গজিয়েছে এবং সীমান্তের বাইরেও নিজ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে, তখন কেএনএফ খাঁচা ভেঙে উড়াল দিয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, শান্তি আলোচনায় বসা কেএনএফ হঠাৎ ‘ইউ টার্ন’ নিয়েছে কেন, শান্তি আলোচনায় দর কষাকাষিতে আরও সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতে? নাকি শান্তি আলোচনা নিয়ে গোষ্ঠীর ভেতরে যে দ্বিমত রয়েছে, তারই উপদলীয় কোন্দলের বহিঃপ্রকাশ? নাকি পার্বত্য চট্টগ্রামেই সক্রিয় অন্য কোনো গোষ্ঠী শান্তি আলোচনা ভণ্ডুল করে দিতে চায়?
এসব অপেক্ষাকৃত ‘নিরীহ’ প্রশ্ন। পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ বিবেচিত হবে, যদি এর সঙ্গে বাংলাদেশের বাইরের শক্তিগুলোর সম্পৃক্ততা থাকে। ভারত-মিয়ানমারে কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর নিজস্ব হিসাবনিকাশ রয়েছে। বিশেষত মিয়ানমারের চিন স্টেট এই গোষ্ঠীর দখলে যাওয়ার পর তিন দেশের সংযোগস্থলের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য খানিকটা ক্ষুণ্ন হয়েছে, আরও হতে পারে।

বৃহস্পতিবার সমকালে প্রকাশিত ইনফোগ্রাফ

বৃহস্পতিবার সমকালে প্রকাশিত ইনফোগ্রাফ

ফলে আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় মনে হয়, কেএনএফের সর্বসাম্প্রতিক তৎপরতাকে নিছক ব্যাংকে হামলা বা লুটের লেন্স দিয়ে দেখা উচিত হবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘কুকি-চিন’ জনগোষ্ঠীর আকার ও প্রভাব দিয়েও বিবেচনা করা যাবে না। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের মিজোরাম ও মণিপুর রাজ্য এবং মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন স্টেটে এই জনগোষ্ঠীর যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা, প্রভাব এবং শক্তিশালী নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন, সেটার প্রেক্ষিতে দেখতে হবে। রুমা বা থানচিতে ব্যাংক হামলার সঙ্গে ত্রিদেশীয় ভূরাজনীতির সম্পর্ককে গভীর অভিনিবেশ সহকারে বিবেচনা করতে হবে।

বিশেষত, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ঘরের ভেতরে ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে এখন তাদের সংঘাত আশপাশের দেশগুলোতে রপ্তানি করতে চাইছে। জ্বলন্ত চিন ও রাখাইন স্টেটের কোনো স্ফুলিঙ্গ যাতে সীমান্তের এপাশে এসে না পড়ে, সে ব্যাপারে বিশেষভাবে সাবধান থাকতে হবে।

ভঙ্গুর বা নাজুক বস্তুর প্যাকেজে সাধারণত সাবধানবাণী উৎকীর্ণ থাকে- ‘হ্যান্ডেল উইথ কেয়ার’। অভিনিবেশ সহকারে দেখলে দেখা যাবে- শঙ্খ নদী, রুমা খাল, রাইখিয়াং খালবিধৌত সবুজ পার্বত্য ভূখণ্ডে লাল রঙে লেখা- ‘হ্যান্ডেল কেএনএফ উইথ কেয়ার’। বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে ‘ডিল’ করতে হবে। নিছক সামরিক অভিযান দিয়ে সমাধান আসবে– এমন নিশ্চয়তা কে দিতে পারে?

samakal