বাড়তেই থাকবে বিদ্যুতের দাম

  • রিন্টু আনোয়ার
  •  ০৪ মার্চ ২০২৩, ২০:৪৯, আপডেট: ০৫ মার্চ ২০২৩, ০৭:১২

বছরে বা মাসে নয়, প্রতি সপ্তাহেও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পথে সরকারের সামনে বাধা নেই। প্রতিবাদ-বিক্ষোভে কেউ সরকারের গদিতে টান ফেলে দেবে, সেই ঝুঁকি বা শঙ্কাও নেই সরকারের। আইনগতভাবে সেই ব্যবস্থা করে নিয়েছে সরকার। প্রতি মাসে বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয়ের নীতির আওতায় দুই মাসের মধ্যে তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এটার নাম দাম ‘বৃদ্ধি’ নয়, বলা হচ্ছে ‘সমন্বয়’।

শব্দের মারপ্যাঁচেও কি বিদ্যুতের কোনো সুখবর আছে? অথবা সমন্বয় কি এটাই শেষ? এরপর আর দাম বাড়বে না? বা আরো দুয়েকবার দাম বাড়ানোর পর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ মিলতে থাকবে? শুরু হওয়া গ্রীষ্মকালেই বা পরিস্থিতি কেমন যাবে? গেলবারের মতো কোনো বিপর্যয় ঘটবে না তো? এসব প্রশ্নের পরিষ্কার জবাব নেই কারো কাছে। বাস্তবতা হচ্ছে, অন্তত লোড শেডিং কিছু কমলেও মানুষ স্বস্তি বোধ করবে।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বাংলাদেশের এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। আমদানি হয় এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। এই বছর গ্রীষ্ম, রমজান এবং সেচের চাহিদা হিসাব করে কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, সর্বোচ্চ চাহিদা হতে পারে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম কেন্দ্র রয়েছে ১৫৪টি যার মধ্যে বেশির ভাগই ভাড়ায় চালিত ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। কিন্তু ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়া আর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে গত বছর তীব্র চাহিদার সময়েও ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখা হয় যা কোনোভাবেই আশ্বস্ত হওয়ার বার্তা নয়।

অবস্থা-ব্যবস্থার কোনো উন্নতি না করে সমন্বয় নাম দিয়ে বিদ্যুতের দাম প্রতিদিন বাড়ালেও তাতে আশার আলো দেখা যাবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। সাধারণত গ্রীষ্মে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। সে কারণে এই বছরের গরমের মৌসুমে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রশ্নে দেখানো হয়েছিল ভারতের ঝাড়খণ্ডে তৈরি করা আদানি পাওয়ারের স্বপ্ন। এরই মধ্যে এ আশার ‘লেজে টিপ’ পড়ে গেছে। কয়েক দফায় আদানির বিদ্যুতের আগমনী বার্তার তারিখ পেছানোর পর এখন আর এ নিয়ে মানুষের গরজ নেই। যার যা বোঝার বুঝে নিয়েছে মানুষ যার ছাপ সরকারের সর্বশেষ বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মধ্যেও। আর তাই নিয়তির লিখনের মতো মেনে নেয়া ছাড়া কারো তেমন প্রক্রিয়াও নেই।

এর আগে গত জানুয়ারিতে দুই দফায় বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এটি জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দুই ভাগে কার্যকর হয়েছে। সর্বশেষ ৩০ জানুয়ারির প্রজ্ঞাপনে খুচরা পর্যায়ে ৫ শতাংশ এবং পাইকারি পর্যায়ে ৮ শতাংশ বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। বিদ্যুৎ, শক্তি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বলা হয়েছে, পয়লা মার্চ থেকে একজন গ্রাহক যিনি আগে ১,০০০ টাকা পরিশোধ করেছেন, তাকে একই পরিমাণ বিদ্যুতের বিনিময়ে ১,১৫০ টাকা পরিশোধ করতে হবে।

এ নিয়ে গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। আগে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করত এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি। এখন আইন সংশোধন করে এ ক্ষমতা হাতে নিয়েছে সরকার। এর পর থেকেই নির্বাহী আদেশে দাম বাড়াচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। দেশের সরকারি-বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত দামে বিদ্যুৎ কিনে নেয় পিডিবি। এরপর তারা উৎপাদন খরচের চেয়ে কিছুটা কম দামে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার কাছে বিক্রি করে। ঘাটতি মেটাতে পিডিবি সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নেয়। তবে বিতরণ সংস্থাগুলো কোনো ভর্তুকি পায় না। তারা নিয়মিত মুনাফা করছে। গত অর্থবছরেও মুনাফা করেছে বিতরণ সংস্থাগুলো।

বাংলাদেশে বিদ্যুতের এ অবস্থার মাঝে অনেকে পাকিস্তানের ছোঁয়া আঁচ করছেন। উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে পাকিস্তানও দেশী-বিদেশী ঋণে একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছিল এবং বাহাদুরি করেছে বিদ্যুতায়নের সক্ষমতা নিয়ে। কিছু দিনের মধ্যেই বাহাদুরির বেলুন ফুটা হয়ে যায়। উচ্চ সুদহারে নেয়া বাণিজ্যিক ঋণে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সাফল্য আনতে পারেনি। আবার বিদ্যুৎ খাতের জ্বালানি পরিকল্পনাও ছিল পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। সঙ্গতিপূর্ণ সঞ্চালন ব্যবস্থা না থাকায় বিপুল সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে গুনতে হয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ। এতে প্রতিবার পাকিস্তানি রুপির অবমূল্যায়নের সাথে সাথে ব্যয়ও বেড়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের। দিন দিন এ ব্যয়ের মাত্রা দেশটির ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বা বিতরণ কোম্পানিগুলোর সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে ক্রমান্বয়ে বড় হয়েছে। এতে যে দায় তৈরি হয়েছে, একপর্যায়ে তা বিদ্যুৎ খাতের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশটির সক্ষমতা অনুযায়ী সর্বোচ্চ পরিমাণ ভর্তুকি দিয়েও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। এর ধারাবাহিকতায় খাতটিতে সৃষ্ট ঋণের দুষ্টচক্রের ভার এখন পাকিস্তানের সরকার তথা তাদের গোটা অর্থনীতিকেই এবার বহন করতে হচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি সঙ্গিন হয়ে পড়ায় পাকিস্তানে এখন বিদ্যমান বিদ্যুৎ নীতি পর্যালোচনার দাবি উঠছে। আর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কটে পতিত হয়েছে ঋণের বোঝায় জর্জরিত পাকিস্তান। আপাতত সঙ্কট মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের ঋণের অর্থছাড়ের অপেক্ষায় আছে দেশটি।

বাংলাদেশ সম্প্রতি আইএমএফের ঋণের অর্থ পেয়ে গেছে। সরকারের দাবি, সরকারের ঋণশোধের সক্ষমতা আছে বুঝেই আইএমএফ ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশকে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রীর দাবিও এ ধাঁচের। এত অল্প সময়ের মধ্যে একাধিকবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, এটি জনগণের ‘উদ্বিগ্ন হওয়ার’ কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়েছিলেন ‘প্রতি মাসেই আমরা বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করব।’ প্রশ্ন ছিল, তার মানে প্রতি মাসেই কি দাম বাড়বে? প্রতিমন্ত্রীর জবাব- দাম সমন্বয় করব, বাড়ানো হবে তা তো বলিনি। বলতে বলতে একপর্যায়ে তিনি বলে দেন, বিদ্যুৎ ব্যবহার বৃদ্ধির অর্থ তার আয় বাড়ছে। আয় বাড়ছে বলেই মানুষ বাড়তি বিল দিতে পারছে। আয় না বাড়লে মানুষ ১০০ থেকে ২০০ টাকা বিল দিচ্ছে কিভাবে? প্রতিমন্ত্রীর এমন মত-অভিমতের মধ্য দিয়ে সরকারের মোটিভ পরিষ্কার। তা বোঝার আর কিছু বাকি থাকে না।

বিদ্যুৎ নিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মহলের কথাবার্তার বহর এমনই ছিল। বাংলাদেশেও বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি উৎপাদন কেন্দ্রের আধিপত্য তুঙ্গে। বিদ্যুতের ট্যারিফ নির্ধারণের ক্ষেত্রে শর্ত ও কাঠামোও দুই দেশে বেশ মিলে। ক্যাপাসিটি চার্জ, জ্বালানি ক্রয় ও মূল্য পরিশোধের শর্ত, ডলার ইনডেক্সেশন, কর সুবিধার নীতিগুলোও প্রায় এক। দুই দেশেই বছরের পর বছর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো লাভজনকভাবে ব্যবসা করলেও দায় ও আর্থিক চাপে পড়েছে রাষ্ট্র ও জনসাধারণ। পাকিস্তানে পরিস্থিতি এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বাংলাদেশে সামষ্টিকভাবে এখনো তা হয়নি। তবে অন্তত বিদ্যুৎ বিভাগে তা হতে তেমন বাকিও নেই। একক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) লোকসান ও ঋণের বোঝা মারাত্মক রূপ নিয়েছে। এরই মধ্যে সংস্থাটির ক্রমপুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ৬৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিপুল এ লোকসানের পুরোটাই ভর্তুকি বা ঋণ আকারে দিয়েছে সরকার। গত অর্থবছরেও সরকারের কাছ থেকে সংস্থাটিকে ভর্তুকি নিতে হয়েছে ২৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা।

আবার সংস্থাটির কাছে সরকারের পাওনাও বকেয়া রয়েছে বিপুল পরিমাণ। শুধু ২০১৬-০৭ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যেই সংস্থাটিকে সরকার ঋণ দিয়েছে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। বিপিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এ ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা এখন বিপিডিবির নেই। আবার এ ঋণের কারণে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে সংস্থাটির সঙ্গে কোনো ধরনের চুক্তিতে যেতে চাইছে না বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। পরিস্থিতি কত ভয়াবহ রকমের জটিল!

সামনেই রমজান। বরাবরের মতো এবারের রমজানেও নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখার অঙ্গীকার রয়েছে সরকারের। এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নের চেষ্টাও দৃশ্যত আছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের সঙ্গে দেনদরবারের খবর প্রতিদিনই। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে বিক্রেতা, পাইকার, উৎপাদক, আড়তদারসহ সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানানো হয়েছে অন্তত এবার যেন রমজানে নিত্যপণ্যের দাম না বাড়ানোর দৃষ্টান্ত তৈরি করা হয়। কিন্তু আলামত খারাপ। স্বাধীনতার মাস মার্চের শুরু থেকে বিদ্যুতের বাড়তি দাম কার্যকরের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে রমজানে নিত্যপণ্যের দাম অন্যবারের চেয়ে এবার আরো বাড়বে-সেই বার্তা জেনে গেছে মানুষ।

মানুষের মাঝে এর বিরুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক ক্ষোভ নেই। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এর বিরুদ্ধে কোনো কর্মসূচি নেই। গত বছরের ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। এরপর গত ২১ নভেম্বর পাইকারি ও ১২ জানুয়ারি ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির সপ্তাহের ব্যবধানেই ১৮ জানুয়ারি বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। এর মধ্য দিয়ে হাতেকলমের বুঝিয়ে দেয়ার মতো বার্তাটি হচ্ছে, এখন চক্রাকারে তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়তেই থাকবে!

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com