- ইকতেদার আহমেদ
- ৩১ মে ২০২১
বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের পর প্রথম বাজেট ঘোষিত হয় ৩০ জুন, ১৯৭২ সালে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাজেটের আকৃতি ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। এটি জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। এর পরবর্তী অর্থবছর ১৯৭৩-৭৪ এর বাজেটের আকৃতি ছিল ৯৯৫ কোটি টাকা। এ বাজেটও সংসদে উপস্থাপন করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশের এ দুটি বাজেটের আকৃতি হাজার কোটি টাকার কোঠার নিচে ছিল। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে উপস্থাপিত তৃতীয় বাজেট হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করে ১০৮৪.৩৭ কোটি টাকায় প্রণীত হয়। এটি অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থাপিত শেষ বাজেট। বাজেটটি উপস্থাপন-পরবর্তী তিনি অর্থমন্ত্রীর পদ হারান এবং মন্ত্রিসভা থেকে ছিটকে পড়েন। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি ও আর্থিক সামর্থ্যরে নিরিখে এবং তৎকালীন আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এ তিনটি বাজেটের আকার বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী ছিল। ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের চতুর্থ বাজেটটি উপস্থাপন করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ড. এ আর মল্লিক। বাজেটের আকৃতি ছিল ১৫৪৯.১৯ কোটি টাকা। চতুর্থ বাজেটটি ঘোষিত হওয়ার দুই মাসেরও কম সময়ের মাথায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার নিজ দলের ঘনিষ্ঠ সহচরদের সমর্থিত সামরিক অভ্যুত্থানে মর্মান্তিকভাবে দুই কন্যা ছাড়া পরিবারের অপরাপর সদস্যসমেত নিহত হলে তার ঘোষিত একদলীয় শাসনব্যবস্থার যবনিকাপাতের সূত্রপাত ঘটে।
পচাত্তর পটপরিবর্তন পরবর্তী তিনটি অর্থবছর ১৯৭৬-৭৭, ১৯৭৭-৭৮ ও ১৯৭৮-৭৯ এর বাজেট অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রথমত, উপসামরিক আইন প্রশাসক এবং অতঃপর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান উপস্থাপন করেন। ওই তিনটি অর্থবছরের বাজেটের আকৃতি ছিল ১৯৮৯.৮৭, ২১৮৪ ও ২৪৯৯ কোটি টাকা। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৯ অবধি প্রতিটি অর্থবছরের বাজেট অবলোকনে দেখা যায় পরবর্তী অর্থবছরে বাজেটের কলেবর বেড়েছে। ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে উপস্থাপিত ১৭তম বাজেটের ক্ষেত্রে দেখা গেল এর পরিধি ১০ হাজারের কোঠা অতিক্রম করে ১০৫৬৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশের ৩৮তম বাজেট উপস্থাপন করা হয়। এ বাজেটের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ব্যয় বরাদ্দ এক লাখ কোটি টাকার কোঠা অতিক্রম করে এক লাখ ১৩ হাজার ১৭০ কোটি টাকা নির্ধারিত হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে উপস্থাপিত ৪৮তম বাজেটের ক্ষেত্রে দেখা গেল ব্যয় বরাদ্দ পাঁচ লাখের কোটা অতিক্রম করে পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটিতে গিয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান অর্থবছর ২০২০-২১ এ প্রদত্ত দেশের ৪৯তম বাজেটের আকার বরাবরের মতো বৃদ্ধি পেয়ে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে পৌঁছে। ধারণা করা হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকৃতিতে অতীতের মতো বাড়বে।
সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়াধীন বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থার বরাবর প্রতিবছর নিজ নিজ ব্যয়ভার মেটানোর জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। এ অর্থ বরাদ্দ মঞ্জুরের দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ওপর ন্যস্ত। আমাদের দেশে অর্থবছর ১ জুলাই শুরু হয়ে ৩০ জুন শেষ হয় যদিও পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে অর্থবছর ১ মার্চ থেকে ফেব্রুয়ারির শেষদিন অবধি হয়। আবার কোনো কোনো দেশে অর্থবছর ও ইংরেজি বছর একই হয়ে থাকে। প্রতি বছর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ কর্তৃক বাজেট প্রস্তুতের আগে সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তদাধীন বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থা থেকে আসন্ন অর্থবছরে ব্যয় বিষয়ে চাহিদাপত্র দিতে বলা হয়। বাজেট প্রস্তুতকালীন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সাথে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও তদাধীন বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থার চাহিদাপত্র বিষয়ে পৃথক বৈঠক হয় এবং ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও তদাধীন বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থা কর্তৃক প্রেরিত চাহিদাপত্র বিষয়ের ওপর বিস্তারিত আলোচনাপূর্বক মন্ত্রণালয় ও তদাধীন বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থার জন্য বাজেট বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়। সচরাচর দেখা যায় চাহিদাপত্রে মন্ত্রণালয় ও তদাধীন বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থার পক্ষ থেকে যেভাবে বরাদ্দ চাওয়া হয় তাতে এতদবিষয়ে মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন করা হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ বাজেট প্রস্তুত করলেও প্রতিবছর সংসদ অধিবেশনে সংসদ কর্তৃক অর্থবিল আকারে এটি সংসদে উত্থাপনের আগে রাষ্ট্রপতির সুপারিশ গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে। সংসদে বিস্তারিত আলোচনান্তে প্রয়োজনীয় সংযোজন ও বিয়োজনের মাধ্যমে বাজেট পাস হয় এবং পাসান্তে এটিকে কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে তার সম্মতি গ্রহণ করতে হয়।
প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও তদাধীন বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থার প্রধানরা নিজ নিজ কার্যালয়ের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা। যে কোনো অর্থ ব্যয় বিষয়ে এরূপ আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তার অনুমোদন নিতে হয়। প্রতি অর্থবছরের জন্য বরাদ্দকৃত খাতভিত্তিক অর্থ অর্থবছর সমাপ্ত হওয়ার আগেই ব্যয় করে এর বিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়াধীন প্রধান হিসাবরক্ষকের কার্যালয়ে সর্বশেষ ১৮ জুনের মধ্যে দাখিলের বিধান থাকলেও ক্ষেত্রবিশেষে তা ৩০ জুন অবধি দাখিল করা যায়।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং তদাধীন বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থা এর বরাবর প্রতি অর্থবছরে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে আসে। এ নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যয়ের বিধান থাকলেও অনেকের ক্ষেত্রে প্রায়ই তা উপেক্ষিত হতে দেখা যায়। আবার অনেক আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তার মধ্যে এ বিশ্বাসটি কাজ করে যে একটি অর্থবছরের জন্য বরাদ্দকৃত সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয় না করা গেলে তা তার জন্য অদক্ষতা হিসেবে বিবেচিত। এ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে এরূপ অনেক কর্মকর্তা নিজের দক্ষতা প্রমাণের জন্য ব্যয়ের যৌক্তিকতা থাকুক বা না থাকুক তা বিবেচনা না করে যেকোনোভাবে বরাদ্দকৃত সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয়ের প্রয়াস নেন। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ব্যয় না করে যোগসাজশীভাবে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে ভুয়া বিল দাখিলপূর্বক অগ্রিম অর্থ উত্তোলনের ব্যবস্থা করেন। এভাবে অগ্রিম উত্তোলনকৃত অর্থ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আত্মসাৎ হয়।
প্রতিটি অর্থবছরই দেখা যায় পরবর্তী অর্থবছরের জন্য সংসদে বাজেট উত্থাপনের সময় চলতি বছরের ব্যয়ের সংযোজন-বিয়োজনসহ অতিরিক্ত ও অপ্রত্যাশিত ব্যয় সমন্বয়ের জন্য সম্পূরক বাজেট পেশের আবশ্যকতা দেখা দেয়। সম্পূরক বাজেটের মাধ্যমে চলতি বছরের বাজেটের সংযোজন-বিয়োজনসহ অপ্রত্যাশিত ও অতিরিক্ত ব্যয়ের অনুমোদন দেয়া হয়। এ ধরনের অনুমোদন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যয় পরবর্তী হয় বিধায় ব্যয়ের যৌক্তিকতা বিষয়ে কোনো ধরনের বিতর্ক অনেকটা অর্থহীন। প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে মানুষ ও গবাদিপশুর জীবনহানি, ফসলহানি, সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা ও যোগাযোগ অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির জন্য যে অপ্রত্যাশিত ও অতিরিক্ত ব্যয় অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে পরিস্থিতির আকস্মিকতায় মূল বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ে যে ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয় এ ক্ষেত্রে সচরাচর তা সম্ভব হয় না। এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ও অতিরিক্ত ব্যয় দ্রুত জনমানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের নিমিত্ত করা হলেও এক শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী নীতি-নৈতিকতা ও মানবিকতার অবজ্ঞা ও উপেক্ষায় এতদসংক্রান্ত ব্যয় হতেও ফায়দা হাসিলে কোনো ধরনের কুণ্ঠাবোধ করে না।
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও এর অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোয় দুর্নীতি যে লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে তা দেশের শীর্ষ পর্যায়ে আসীন ব্যক্তিদের সাম্প্রতিক ও বিগত বছরে প্রদত্ত বক্তব্য থেকে জনমানুষের কাছে অনেকটাই স্পষ্ট। সরকার প্রতি অর্থবছরে বাজেটে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করে এর একটি বড় অংশ উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ করা হয়। উন্নয়নের নামে বরাদ্দকৃত অর্থের বড় অংশ যে লোপাট হয় তা আজ আর কারো অজানা নয়। বাজেটে জনগণ প্রদত্ত কর থেকে অর্থের সংস্থান করা হয়। আর সে অর্থের বড় অংশ যদি লোপাট হয় তা জনকল্যাণের পরিবর্তে জনদুর্ভোগ বয়ে আনে।
বিশ্বের এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ পাচার রোধের দেখভাল করার প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি এর তথ্যমতে বিগত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ লাখ কোটি টাকার বেশি অর্থ পাচার হয়ে গেছে। এ অর্থ পাচারের সাথে দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়ীরা জড়িত। এরা ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থেকে পাচারের কাজ সমাধা করে থাকে এমনটি সংস্থাটির কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়। এ বিপুল অর্থ দেশের উন্নয়নে ব্যয় করা গেলে দেশের চেহারার পরিবর্তন ঘটে এর সুফল যে জনগণ ভোগ করত এ বিষয়ে দ্বিমত করার কোনো অবকাশ নেই। এ কথাটি অনস্বীকার্য যে এ পাচারকৃত অর্থ দিয়ে বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পগুলোর অন্যতম পদ্মা সেতুর মতো দেড় ডজন প্রকল্প হাতে নেয়া যেত।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ধনীদের দ্রুত সম্পদ বৃদ্ধির গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান ওয়েলথএক্স এর তথ্যমতে বাংলাদেশ বিশ্বে ধনীদের সম্পদ দ্রুত সম্পদ বৃদ্ধি হারের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। বাংলাদেশের যাদের ক্ষেত্রে এ দ্রুত সম্পদ বৃদ্ধির ঘটনা পরিলক্ষিত হচ্ছে এরা কেউ ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ রাজনীতিক, কেউ শীর্ষ আমলা আবার কেউ শীর্ষ ব্যবসায়ী। এরা সবাই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর অতি নিকটজন বিধায় এরা দেশের প্রচলিত আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর তাই অপ্রতিরোধ্য গতিতে এদের সম্পদের বিস্তৃতি ঘটছে।
জনকল্যাণ ও জনমঙ্গল এবং দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য বাজেটে প্রতি বছর যে ব্যয় বৃদ্ধি ঘটছে তার সুফল দুর্নীতি, দুঃশাসন, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে যদি দেশের জনমানুষ ভোগ করতে না পারে এবং তার দ্বারা যদি দেশ উপকৃত না হয় তবে কেনো প্রতি বছর বাজেটে এ ব্যয় বৃদ্ধি এবং এর মাধ্যমে জনগণের ওপর করের বোঝা আরোপ? যে ব্যয় বৃদ্ধি লাগামহীন দুর্নীতির কারণে দেশে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, অসন্তোষ, দুর্দশা, অনিয়ম প্রভৃতির জন্ম দেয় এবং বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করে সে ব্যয় বৃদ্ধির আদৌ কি প্রয়োজন রয়েছে?
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক