বাজারে নতুন নোটের ছড়াছড়ি

logo

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

২৬ জুলাই ২০২৩, বুধবার

mzamin

facebook sharing button

উচ্চ মূল্যস্ফীতির শঙ্কার মধ্যেই রেকর্ড পরিমাণ টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এভাবে সরকারের মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নেয়ার কারণে বাজারে নগদ টাকার চাহিদা বেড়েছে। এ কারণে বাজারে নতুন নোটের ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলমান ২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন করে টাকা ছাপানোর পরিমাণ ১৭৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাপানো হয়েছে, যা ২০২২ সালে ছিল ২৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এ বছর ৫১ হাজার কোটি টাকা বেশি ছাপানো হয়েছে। বাজেট অর্থায়নের ঘাটতি মেটাতে সরকার সাধারণত সরকারি সিকিউরিটিজ, ট্রেজারি বিল ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে ট্রেজারি বন্ড নিলামের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি অনেক দেশে পড়তির দিকে থাকলেও, বাংলাদেশে এই চাপ কমার কোনো লক্ষণ নেই।

এরমধ্যেই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারকে টাকা ধার দিতে নতুন টাকা ছাড়ছে, যেটি প্রকারান্তরে মূল্যস্ফীতিকেই আরও বাড়িয়ে তুলবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া মানেই হচ্ছে নতুন করে ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়া হচ্ছে।  জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি জুলাই মাসের প্রথম ২০ দিনের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, সরকারি ব্যয়ের চাহিদা মেটাতে ১৩ হাজার কোটি টাকা বাজারে ছেড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

রাজস্ব আয়ের বড় ঘাটতি মেটাতেই এই টাকা ধার করেছে সরকার। প্রত্যাশা অনুযায়ী বৈদেশিক সহায়তা না পাওয়ার কারণে বাজারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকার সরবরাহ বাড়াতে হয়েছে। অথচ গত অর্থবছরের পুরো সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার মোট ধার করেছিল ৭৮ হাজার কোটি টাকার সামান্য বেশি। সূত্রমতে, চলতি অর্থবছরের জন্য সরকার যে বাজেট ঘোষণা করেছে সেখানে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। 

এ বছরের বাজেটে ঘাটতি পূরণের জন্য ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি ব্যাংক খাত থেকে নেয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে জানা গেছে, মূল্যস্ফীতির দিক দিয়ে দেশ কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। প্রায় দুই বছর ধরে জিনিসপত্রের দামে সাধারণ মানুষ অনেকটা দিশাহারা। বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম কিছুটা কমে এলেও ডলারের বাড়তি দামের কারণে এর সুফল পাচ্ছে না দেশের ভোক্তারা। বিশ্লেষকেরা জানান, সরকার যখন অন্য উৎস থেকে টাকা ধার না করে সরাসরি টাকা ছাপিয়ে খরচ মেটায়, তখন মূল্যস্ফীতিতে এর প্রভাব পড়ে। অতি মূল্যস্ফীতির এ সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের দফায় দফায় টাকা নিয়ে খরচ করার ফলে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা আরও কঠিন হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, অর্থবছরের প্রথম ২০ দিনেই প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা ধার করেছে সরকার। আর বিদায়ী অর্থবছরে নিয়েছে ৪ লাখ ৮৩০ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই নেয়া হয় ১ লাখ ৬১ হাজার ২৩১ কোটি টাকা।

২০২২ সালের একই সময়ে তা ছিল ৬২ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা।  ব্যাংকাররা বলছেন, অর্থনৈতিক সংকট, সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ না পাওয়া এবং সঞ্চয়পত্রের আগের ঋণ পরিশোধ করতে হওয়ায় চলতি অর্থবছরের প্রথম দিক থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর ভর করতে হচ্ছে সরকারকে। এতে বছরের প্রথম দিক থেকেই ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে নতুন করে ঋণ নিতে হয়েছে। আবার বেশির ভাগ ঋণেরই জোগান এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিভল্বমেন্ট ফান্ড (নতুন টাকার জোগান) থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ইতিপূর্বে একই অর্থবছরে ডিভল্বমেন্ট করে সরকারকে এত বেশি ঋণ কখনো দেয়া হয়নি। ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটের কারণে চলতি অর্থবছর ডিভল্বমেন্টের মাধ্যমে ঋণ দেয়া বেড়েছে। জান গেছে, সরকার প্রতি রোববার ট্রেজারি বিল এবং মঙ্গলবার বন্ডের বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের জন্য নিলামের ব্যবস্থা করে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিলামে বন্ড বা বিল কিনতে ব্যর্থ হলে তা ডিভল্বমেন্ট করা হয়।

এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন টাকার রিজার্ভ থেকে সরকারকে ঋণ দেয়া হয়।  কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিভল্বমেন্ট ফান্ড থেকে সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ২৫ হাজার কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরের শুরুতে ছিল ৫৩ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এক অর্থবছরে সরকার টাকা ছাপিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়েছে ১৪৬.৮৯ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকার জোগান দেয়ার তথ্যটি অস্বীকার করলেও নতুন টাকা ছাপানোর তথ্য গোপন থাকছে না।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২২ সালের মে মাসে দেশে মোট ছাপানো টাকার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৮৬১ কোটি। গত মে মাসে তা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বাজারে জোগান বেড়েছে ৪৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতি অবলম্বন করছে, তাতে সাময়িকভাবে সমস্যার সমাধান হলেও দীর্ঘ মেয়াদে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক জানান, তারা সরকারকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে এবং এর ফলে বাজারে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, প্রথমত বাজারে অনেক ডলার বিক্রি করছি। ডলার বিক্রি করা হলে বাজার থেকে টাকা উঠে আসে। সেই পরিমাণ টাকা আবার বাজারে দিতে হয়।

এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ইতিমধ্যেই ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরুদ্ধে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিশ্বব্যাপী অনেক দেশে গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি কমে আসলেও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। এমনকি অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া শ্রীলঙ্কাও খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে, যা বাংলাদেশ পারেনি। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সাময়িকভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হলেও তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আরও খারাপ হবে। তার মতে, সরকার এবার অর্থবছরের শুরুতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে যে পরিমাণ টাকা নিয়েছে সেটি গত ৫০ বছরে মোট মিলিয়েও নেয়নি। এবার রাজস্ব ঘাটতি অনেক বেড়েছে। কিন্তু তারল্য সংকটের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারকে যথেষ্ট সহায়তা দেয়ার সক্ষমতা নেই।

এসব বিবেচনাতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করার সহজ পথ সরকার বেছে নিয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এভাবে টাকা ছাপানো হলে, বর্তমানে অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।  এ অবস্থা তৈরি হয়েছে মূলত টাকা পাচার, ব্যাংকের অর্থ লুটপাট ও দুর্নীতিসহ নানা কারণে ব্যাংক খাত দুর্বল হয়ে পড়ায়। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা ব্যাংক থেকে এভাবে ঋণ নেয়াটা কমাতে হলে সরকারকে রাজস্ব খরচ অন্তত এক লাখ কোটি টাকা কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু নির্বাচনের বছরে সেটিই বা কতোটা সম্ভব হবে, তাও হবে দেখার বিষয়। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, টাকা ছাপানো একটা চলমান প্রক্রিয়া। যত বড় অর্থনীতি, তত বেশি টাকা প্রয়োজন হয়। বিশ্বের সবখানে কিন্তু টাকা ছাপানো হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণ দেয়া হচ্ছে। এটা করা হচ্ছে বাজারে তারল্যের সংকট আছে এ জন্য। আগের বছর তারল্য সংকট ছিল না।  এদিকে বাজারে যেকোনো কেনাকাটা করতে নতুন নোটের প্রচলন লক্ষ্য করা গেছে। এমনকি ফুটপাথের চায়ের দোকানির কাছেও প্রচুর নতুন টাকা দেখা গেছে। সাধারণত চায়ের দোকানে নতুন টাকা কম দেখা যায়।