এ লেখার জন্য সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে ছাত্র, রিকশাচালক থেকে চা-বিক্রেতা, সবজি বিক্রেতা থেকে মুদিদোকানি, ফল থেকে মুরগি কিংবা মাছ বিক্রেতা—তাঁদের সবারই মোটাদাগে এক কথা, পরিস্থিতি ভালো না। ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই দ্রব্যমূল্য নিয়ে চরম অস্বস্তিতে। বাজারে গেলে দাম শুনে মন খারাপ হচ্ছে, ক্ষোভ বাড়ছে। কেউ কেউ দাম শুনে না কিনে ফিরে যাচ্ছেন, কেউ কম কিনছেন। নির্দিষ্ট আয়ের অনেকে খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। অনেকে আমিষের স্বাদ ভুলতে বসেছেন। মাছ কিনতে না পেরে আলুভর্তা-ডালের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু আলুর দাম বেড়ে গেলে ভর্তা জুটাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।
অনেকে ধারদেনা করে কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছেন। বলছেন, ‘পেট যখন আছে, খেতে তো হবেই। ‘অনেকে বাঁচার উপায় খুঁজতে লাজলজ্জা ভুলে ট্রাকের পেছনে ব্যাগ নিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। এই বাজারযুদ্ধের প্রভাব মোকাবিলা করতে অনেককে সন্তানদের জন্য কেনা পুষ্টিকর খাবারের সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে, খাদ্যের পরিমাণ এবং মানের সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে। অন্যদের মতো একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও বলছেন, ‘আয় তো বাড়েনি, কিন্তু দাম তো বাড়ছে আর বাড়ছেই। আর পারছি না, কীভাবে সম্ভব? খাদ্য কমিয়ে দেওয়া ছাড়া কী করার আছে?’
এই লাগামহীন অস্বাভাবিক বাজার পরিস্থিতির পেছনে দুর্নীতির ব্যাপকতা এবং সুশাসনের ঘাটতি বড় কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমাজ থেকে ক্ষয়ে যাচ্ছে, জবাবদিহির জায়গা সংকুচিত হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত দুর্বল ও অকার্যকর হয়ে পড়ছে। এই সুযোগে একটি মহল প্রয়োজনে বাজার কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছে, ব্যাংক লুট করছে, কিংবা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে। একটি ভঙ্গুর পরিস্থিতি মোকাবিলা ও একটি শক্ত পথ হাঁটার জন্য আমাদের যে সতর্কতা ও অর্থনৈতিক বিচক্ষণতা অবলম্বন করা প্রয়োজন ছিল, সে জায়গায় আমরা সফল হইনি।
দীর্ঘমেয়াদি বাজারশৃঙ্খলা ও বাজার নিয়ে মানুষের মনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হলে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন কঠোর হাতে দমন করা প্রয়োজন। একটি গণতান্ত্রিক ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা ছাড়া এ ধরনের অর্থনৈতিক অসংগতি দূর করা কার্যত দুরূহ। সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি মানুষের ‘বাজারযুদ্ধ’কে আরও কঠিন ও দীর্ঘায়িত করে তুলতে পারে। একটি অনিশ্চিত এবং অপ্রত্যাবর্তনযোগ্য গন্তব্যে পৌঁছার আগেই শান্তির পথ খুঁজে বের করা অতি জরুরি।
- ড. ফরিদ খান অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
- প্রথম আলো