বাগে আনতে নানামুখী চাপ

জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন বিমুখ দল ও নেতাদের উপর নানামুখী চাপ আসছে। দেয়া হচ্ছে নানা প্রস্তাব। কেউ কেউ এই প্রস্তুব লুফে নিচ্ছেন আবার কেউ কেউ প্রত্যাখ্যান করছেন। যারা নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিচ্ছেন তাদের বিরূপ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে। চাপ এড়াতে আত্মগোপনে যাওয়া বা দেশ ছাড়ার ঘটনাও আছে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৩০শে নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন। বিভিন্ন সূত্রের দাবি, সামনের কয়েকদিনে দলগুলোকে নির্বাচনমুখী করতে আরও তৎপরতা দেখা যেতে পারে। গতকাল জাতীয় পার্টি ও মেজর জেনারেল অব. সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন নতুন জোট ‘যুক্তফ্রন্ট’ নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই জাতীয় পার্টি নির্বাচনের পরিবেশ নেই এমন কথা বলে আসছিল। দলটির নেতারা এটাও বলেছেন, নির্বাচনে গেলে যেমন বিপদ হতে পারে না গেলেও বিপদ হবে।

নির্বাচনে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। কিন্তু নির্বাচনে না গেলে কেমন বিপদ হতে পারে তার অবশ্য ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি দলটির তরফে।

সর্বশেষ নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম সরকার পতনের দাবিতে আন্দোলন করা ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ছিলেন। হঠাৎ ওই জোট ছেড়ে নতুন জোট গঠন এবং নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ কৌতুহল দেখা দিয়েছে। গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দেয়ার আগের দিনও সৈয়দ ইবরাহিম জানিয়েছিলেন তারা আন্দোলনেই আছেন। সূত্রের দাবি গত কয়েকদিনে তার সঙ্গে সরকারি দলের একজন সিনিয়র নেতা ও একাধিক কর্মকর্তার বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে আলোচনার ভিত্তিতে তিনি নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সৈয়দ ইব্রাহিমকে চট্টগ্রামের একটি আসনে নির্বিঘ্নে নির্বাচন করার সুযোগ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর তিনি নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বলে আলোচনা আছে। এ ছাড়া তার সঙ্গে জোট করা অন্য দলের নেতারাও সুবিধা পাবেন বলে মনে করছেন। সৈয়দ ইবরাহিম নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ায় তার আসনে (চট্টগ্রাম-৫) জাতীয় পার্টির সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের কপাল পুড়তে পারে।

যুক্তফ্রন্টে আরও কয়েকটি দলকে যুক্ত করার চেষ্টা হয়েছে কয়েকদিন থেকে। কিন্তু ওই দলগুলো সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে রাজি হয়নি। একক দল হিসেবে আন্দোলনে থাকা গণঅধিকার পরিষদকে এই জোটে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয় বলে দাবি করেছেন দলটির এক নেতা। তার দাবি শুধু এই জোটে না, নির্বাচনে যেতে নানামুখী চাপ দেয়া হচ্ছে। তবে গণঅধিকার বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। দলটির সভাপতি নুরুল হক নুর এক সমাবেশে বলেছেন, গণঅধিকার পরিষদকে নির্বাচনে না নিতে পেরে সরকারের পক্ষ থেকে হুমকি দেয়া হচ্ছে। গতকাল তিনি বলেছেন, রাজনীতিবিদরা কোরবানির হাটের গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হচ্ছেন।

বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল বলেছেন, কিংস পার্টিতে যোগ দিতে নেতাদের চাপ ও ভয় দেখানো হচ্ছে।

নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পাওয়ার পর থেকে আলোচনায় তৃণমূল বিএনপি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম)। দল দুটি নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে তৎপরতা চালাচ্ছেন। বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা দল দুটিতে যুক্ত হচ্ছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে বিরোধী দলগুলোর পরিচিত নেতাদের কেউ কেউ এই দুই দলে যুক্ত হয়ে নির্বাচন করতে পারেন। যদিও এ পর্যন্ত তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। নতুন করে নিবন্ধন পাওয়া দল দুটির নেপথ্যে অনেকে আছেন বলে মনে করা হচ্ছে। এই দুই দলকে নিজেদের মতো পরিচালিত করতে ইতিমধ্যে নেতৃত্ব পর্যায়ে পরিবর্তনও এসেছে। শুরুতে দল দুটির যারা উদ্যোক্তা ছিলেন তারা এখন আর মূল নেতৃত্বে নেই। বিএনএম এখন পর্যন্ত দলের চেয়ারম্যান ঠিক করতে পারেনি। নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দলটিতে দ্বন্দ্বের আভাস মিলছে।

গত ১০ই আগস্ট বিএনএম নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পায়। তখন দলের আহ্বায়ক ছিলেন বিএনপি’র সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান আর সদস্য সচিব ছিলেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য মেজর (অব.) মো. হানিফ। গত বৃহস্পতিবার ঢাকার গুলশানে এক নেতার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে বিএনএম’র কাউন্সিল হয়। তাতে আগের ৩১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় ও জাতীয় স্থায়ী কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। দলটির মহাসচিব করা হয় মো. শাহজাহানকে। তবে চেয়ারম্যান ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের পদসহ অন্যান্য পদ খালি রাখা হয়। গত সোমবার বিএনপি’র সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোহাম্মদ আবু জাফরকে বিএনএমে যোগ দেয়ার পরপরই তাকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। দলটির বিলুপ্ত কমিটির নেতারা কাউন্সিল করা ও নতুন কমিটি গঠনের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। একজন নেতা মানবজমিনকে বলেন, রাতের আঁধারে কমিটি হাইজ্যাক করা হয়েছে। আলোচনায় থাকা তৃণমূল বিএনপিতেও যোগ দিয়েই বড় পদ পেয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ।

দল দুটির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সামনে অন্য দল থেকে হেভিওয়েট নেতারা আসলে তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হতে পারে। এমনটি সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের পদও পরিবর্তন হতে পারে।
নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে চাপে থাকার তথ্য জানিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের একাধিক নেতা। তাদের দাবি নানামুখী চাপ আসছে নির্বাচনে যেতে। কিন্তু তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন জাতীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না দলটি। বিএনপি ও সমমনা জোটে আছে এমন কয়েকটি দলের নেতারা জানিয়েছেন, নির্বাচনে যেতে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু তারা সাড়া দেননি।

জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য শুধু যে দলগুলো চাপে আছে তা কিন্তু নয়। নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন এলাকায় জনপ্রিয় এমন ব্যক্তিদেরও নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য বলা হচ্ছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। প্রস্তাবে সায় না দেয়ার হয়রানি করা হচ্ছে এমন অভিযোগও আসছে বিভিন্ন জায়গা থেকে।

বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ড্যাবের প্রথম সহ-সভাপতি অধ্যাপক ডা. শহিদুল আলমকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল একটি পক্ষের তরফে। সাতক্ষীরার একটি আসন থেকে তাকে নির্বাচন করতে বলা হয়েছিল। তিনি এ প্রস্তাবে সায় দেননি। এরপরই কালীগঞ্জের নলতাস্থ বাসায় সাদা পোশাকধারী পুলিশ হানা দেয় বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।
বরগুনা জেলার বিএনপি’র একজন সাবেক সংসদ সদস্য মানবজমিনকে জানিয়েছেন, তাকে ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচন করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি এতে সায় দেননি।

বিরোধী দলগুলোর নেতারা জানিয়েছেন, নানামুখী চাপ আসায় তারা কৌশল অবলম্বন করছেন। কেউ কেউ মোবাইল ফোন বন্ধ রাখছেন। কেউ বাসায় থাকছেন না।

সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে বিএনপি’র সমমনা ৩৭টি’র মতো দল যুগপৎ কর্মসূচি পালন করছে। এর মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, এলডিপি, সমমনা জাতীয়তাবাদী জোট, গণফোরাম, গণঅধিকার পরিষদ রয়েছে। এর বাইরে  ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এবি পার্টিও তফসিল প্রত্যাখ্যান করে কর্মসূচি পালন করছে। সরকারের পদত্যাগ ও তফসিল বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছে জামায়াত। যদিও দলটি এখন নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দলের তালিকায় নেই।  জামায়াতের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য তাদের উপরও চাপ দেয়া হয়েছে। দলটির কারাবন্দি আমীরের কাছে একাধিকবার একাধিক প্রস্তাব এসেছে। দলটি নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে থাকায় নেতাদের মুক্তি মিলছে না এমনটাও দাবি করেন কোনো কোনো নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামায়াতের একজন নেতা বলেন, ১০ বছর ঝুলে থাকার পর দলের নিবন্ধন নিয়ে আপিলের যে রায় হয়েছে তার পেছনেও নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়টি থাকতে পারে।

সূত্র : মানবজমিন