বাকশালের কুঞ্জবনে মতি-মাহফুজদের স্বাধীনতার পূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ

 আমার দেশ
১৬ এপ্রিল ২০২৩

মিনার রশিদ

মিনার রশিদ

মিনার রশিদ

মাহফুজ আনাম লিখেছেন, স্বাধীনতার পূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে একটি সমাজে মুক্ত সাংবাদিকতা প্রয়োজন। তাঁর এই লেখাটি প্রণিধানযোগ্য কারণেই সুধীজনের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে!

গত চৌদ্দ বছরে এই স্বাধীনতার পূর্ণ সৌন্দর্য আহরণে মতি-মাহফুজদের কোনো কষ্ট হয়েছে তা কখনোই মনে হয় নাই! ফ্যাসিবাদের আদালত যখন মাহমুদুর রহমানকে জানিয়েছিল- ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স, তখনও তা মতি-মাহফুজদের মগজে বা বিবেকে লাগে নাই। পুরো সাংবাদিকতাকে গ্রাম বাংলার “আই ডোন্ট নো” গল্পের আদলে এরা সাজিয়ে ফেলেছে। এখন ইচ্ছেমাত্র যে কাউকে অতিমানব অথবা যে কাউকে দানব বানিয়ে ফেলতে পারে।

গত দেড় যুগ ধরে একটা ট্রেন্ড লক্ষ্য করা গেছে! অন্য সবার একটু আধটু সমালোচনা করলেও পালের গোদা শেখ হাসিনা বা তার পরিবারকে নিয়ে কোনো নেগেটিভ কথা ঘুণাক্ষরেও বলা যাবে না! এই নিয়মটি কঠোরভাবে পালন করেও এদেশে অনেকেই মজলুম মানুষের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছেন। একই ভাবে বিএনপির অন্য সবার প্রশংসা করলেও তারেক রহমানকে নিয়ে পজিটিভ কোনো কথা বলা যাবে না। এই পূর্ণ সৌন্দর্যে টেস্টিং সল্ট হিসাবে তো হাওয়া ভবন, জজ মিয়া নাটক এসব তো রয়েছেই।

সারা বছর সরকারের একটু আধটু সমালোচনা করে এক শুভ সকালে বরকতময় এক সার্ভের ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে দেখানো হয়েছে যে সরকারের জনপ্রিয়তা একটু কমলেও প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা মাশাল্লাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে একদিনেই হাজার দিনের পাপ মাফ হয়ে অনেক পুণ্য জমে যায়! এর পরেও সামান্য ঘাটতি থাকলে জন্মদিনে প্রথম পাতার পুরোটাই উৎসর্গ করে তা পূরণ করা হয়েছে!

এই কৌশলেই তো স্বাধীনতার পূর্ণ সৌন্দর্য এর সকল রূপ-রস-গন্ধ সহ উপভোগ করেছেন! কী চমৎকার ব্যবস্থা! নেত্রী খুশি, পাঠকও খুশি! এখন দেখা যাচ্ছে, যাদের বারোটা বাজিয়েছে সেই বিএনপির অনেক জাঁদরেল নেতারাও খুশি!

এই মতি-মাহফুজরাই একটি নতুন শব্দের সাথে জাতিকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু পরিচয় নয়, অচিরেই দেশটি ব্যর্থ রাষ্ট্র বা Failed State বনে যাচ্ছে বলে পুরো জাতিকে আতংকিত করে ফেলেছিল! ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের একটি দেশ হিসাবে কিছুটা ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলেও তখন রাষ্ট্রের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সম্পূর্ণ কার্যকর ছিল! জাতির দুর্যোগপূর্ণ বা বিরাট সংকটের সময় সাধারণত পত্রিকার সম্পাদকবৃন্দ তাদের পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় মন্তব্য কলাম প্রকাশ করে থাকেন! কিন্তু এই মতি-মাহফুজ ২০০১-২০০৬ সালে কিছুদিন পরপরই দেশটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়ে যাচ্ছে এই আর্তনাদ করে মন্তব্য কলাম লিখতেন।

সেই বাঘ যখন সঠিকভাবেই উঠোনে এসে হাজির হলো তখন জাতির এই নকিবরা চুপ মেরে গেলেন। কারণ যেদিক থেকে বাঘটি আসার কথা বলা হয়েছিল, সেই দিক থেকে না এসে উল্টো দিক থেকে এসেছিল! গত ১৬ বছর যাবত সেই বাঘের হাতে জাতির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলিত-মথিত চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে দিলেন! এ নিয়ে প্রথম পাতায় ঘন ঘন মন্তব্য প্রতিবেদন তো দূরের কথা- সামান্য প্রতিবাদ করতেও ভুলে গেলেন!

একটি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হরণ করতে হলে তিনটি ইন্টারনাল শক্তিকে ধ্বংস বা নিস্তেজ করতে হয়। এই তিনটি শক্তি হলো আধিপত্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ, প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং গণমাধ্যমের প্রতিবাদী অংশ। এই তিনটিকেই নিস্তেজ বা নিষ্ক্রিয় করতে আধিপত্যবাদী শক্তিকে সরাসরি সহযোগিতা করেছে এই মতি-মাহফুজ, আলো-স্টার-চ্যানেল আই, সিপিডি-টিআইবি গং!

তাদের জন্যে প্রথম হুমকি ছিল আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী যেটাকে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে নিঃশেষ করা হয়েছে! এখন দেখুন নিজের জবানিতেই স্বীকার করলেন পিলখানাতে প্রথম আলোর ভূমিকাটি! মাহফুজ আনাম লিখেছেন,

“সরকার, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও অন্য যাঁরা সাম্প্রতিক বিবৃতিগুলো দিয়েছেন, তাঁরা হয়তো বিএনপির শাসনামলে দুর্নীতির বিষয়গুলো তুলে ধরা এবং সেই সময়ে তারেক জিয়া ও হাওয়া ভবনের কীর্তিকলাপ উন্মোচনে প্রথম আলোর ভূমিকার কথা ভুলে গেছেন। তাঁরা হয়তো ভুলে গেছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টার তদন্তকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার ঘৃণ্য উদ্যোগ উন্মোচন করতে কী ভূমিকা রেখেছিল প্রথম আলো। ‘জজ মিয়া’ ষড়যন্ত্র কারা উন্মোচন করেছে? আইভি রহমানসহ ২৪ আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যুর নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকে গোপন করতে বিএনপি যে ঘৃণ্য চক্রান্ত করেছিল, সেটিও উন্মোচন করে প্রথম আলো। ভোটার তালিকায় ভুয়া ভোটারের তথ্য কারা প্রকাশ করেছিল? ইয়াজউদ্দিন রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন হাওয়া ভবন ও বঙ্গভবনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টি প্রকাশ্যে এনেছিল কারা? নবগঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য সুস্পষ্ট ও দৃশ্যমান বিপদ হিসেবে বিবেচিত বিডিআর বিদ্রোহের সময় প্রথম আলোর ভূমিকা কী ছিল?”

অর্থাৎ পিলখানার ঘটনা থেকে জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে ডাইভার্ট করার জন্যে প্রথম আলোর ভূমিকাটি আবারও স্মরণ করিয়ে দিলেন! এখানে মাহফুজ আনাম নিজের অজান্তেই সম্ভবত একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লূ দিয়ে রেখেছেন একাডেমিক গবেষকদের জন্যে।

আপনাদের হয়তোবা স্মরণে আছে যে ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ শে ফেব্রুয়ারিতে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পরপরই ইন্ডিয়ার প্রাক্তন সেনাপ্রধান রায় চৌধুরী “Delhi can’t afford to let Dhaka slip off its radar” এই শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলেন। সেখানে তিনি এই হামলার পেছনে পাকিস্তানের আইএসআই কেন ও কীভাবে জড়িত তা সবিস্তারে তুলে ধরেছিলেন! একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশকে অন্য একটি দেশের রেডারের আওতায় রাখার স্পর্ধা কেন দেখাবে- সেই প্রশ্ন না তুলে এই রায় চৌধুরীর মতলববাজি সন্দেহটিই ছড়িয়ে দেয় চেতনাপন্থী সকল মিডিয়া।

বাংলাদেশকে ঘিরে ইন্ডিয়ার সকল অপারেশনের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে। এটা অনেকটা তিন চোরের গরু চুরির কাহিনীর মত। প্রথম চোর গরু নিয়ে এক রাস্তা দিয়ে সটকে পড়ে। দ্বিতীয় চোর গরুর গলার ঘন্টা খুলে অন্য রাস্তা দিয়ে তা বাজাতে বাজাতে চলতে থাকে। তৃতীয় চোর জনতার মধ্য থেকে বলতে থাকে, “ঐ যে, চোর ঐদিকে” এটা বলে ঘন্টার আওয়াজকে অনুসরণ করে এবং জনতাকে ঐদিকে ধাবিত করে!

এখানে সম্ভবত দ্বিতীয় চোরের ভূমিকাটি পালন করেছে শংকর রায় চৌধুরী সহ “র” এর ইন্টেলেকচুয়াল উইং। তৃতীয় চোরটি ছিল জনতার মধ্য থেকে আমাদের জাতির এই নকিবরা! সেই ভূমিকাটিই মূলত তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন- “বিডিআর বিদ্রোহের সময় প্রথম আলোর ভূমিকা কী ছিল” অভিমানী এই বাক্যটি আপার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে। এটাই সম্ভবতঃ পিলখানার ভয়ংকর ষড়যন্ত্রে সেই তিন নম্বর চোরের ভূমিকা।

এগুলো যাতে জনগণ কোনোদিন টের না পায় তজ্জন্যে দেশ ও জাতির সত্যিকারের ‘ওয়াচডগ’ মিডিয়াগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে বা নিস্তেজ করে রেখেছে। মাহমুদুর রহমান, আবুল আসাদ কিংবা শফিক রেহমানদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বেলায় এই মতি-মাহফুজ একটা টু শব্দ উচ্চারণ করে নাই। সাংবাদিকদের স্বাধীনতার কথা তখন একবারের তরেও মনে পড়ে নাই! স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে এরা সাংবাদিক নয়- সাংবাদিকতার আড়ালে এরা ফ্যাসিবাদ বা আধিপত্যবাদের ঘৃণা দালাল।

কাজেই হঠাৎ শেখ হাসিনার মুখে “প্রথম আলো আওয়ামীলীগের শত্রু, গণতন্ত্রের শত্রু, দেশের শত্রু” এসব শুনে অনেকেই দ্বিধায় পড়ে গেছেন। এটা কি চুক্তির বাইরে গিয়ে টক দইওয়ালাকে থাপ্পড় মারার মত ক্লাইম্যাক্স নাকি আরও মজার কিছু? এটাকেই বলে হয়তো-যার জন্যে করলাম চুরি, সেই বলে চোর!

এতে কোনো সন্দেহ নাই যে শেখ হাসিনা যা বলেন তার পুরোটাই মিথ্যা বলেন! তার এই একটি মাত্র কথা যেখানে তিন ভাগের দুই ভাগে (প্রথম আলো গণতন্ত্রের শত্রু, প্রথম আলো দেশের শত্রু) নির্ভেজাল সত্য রয়েছে!

তবে এক হিসাবে প্রথম আলো আওয়ামী লীগের আসলেই এক নম্বর শত্রু। এক-এগারোর মাধ্যমে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে এবং গত ১৪বছর ইনিয়ে বিনিয়ে সমর্থন দিয়ে দলটির আদর্শিক মৃত্যু ত্বরান্বিত করেছে। বলা যায়, প্রথম আলো গং বিএনপিকে বিষ প্রয়োগে মারার চেষ্টা করলে আওয়ামীলীগকে মারার চেষ্টা করেছে মিঠাই খাইয়ে!

বিএনপির কিছু নেতাসহ বিরোধীদলগুলোর একটা অংশ প্রথম আলোর ব্যাপারে অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত। যদিও প্রথম আলো আগের কৃতকর্ম নিয়ে কখনোই কোনো অনুশোচনা প্রকাশ করে নাই। বরং সেই কর্মকাণ্ড নিয়ে গর্ব প্রকাশ করে।

শয়তানের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পেতে একটা গ্রুপ শয়তানের পূজা করে। প্রথম আলোদের নিয়ে অনেকের ভাবনা তেমনি। তারাও এই মিডিয়া শয়তানকে পুজো দিয়ে তার অনিষ্ট থেকে রক্ষা পেতে চান!

কিন্তু এই ভাবনা সঠিক ও নিরাপদ না। শয়তানকে পূজা নয়- চূড়ান্ত পরাজয়ের লক্ষ্যে তাকে মোকাবেলা করাই একমাত্র এবং সঠিক পন্থা!

লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, লেখক ও গবেষক