বাংলাদেশ কেন ব্যর্থতার গ্রাসে (পর্ব-২): দিন দিন বাড়ছে অসভ্যতা

জীবনে ব্যর্থতার কারণ

ফিরোজ মাহবুব কামাল   23 October 2022

দিন দিন বাড়ছে অসভ্যতা

বাংলাদেশের বুকে নৃশংস ও অসভ্য কর্ম একাত্তরে শেষ হয়নি। বরং সে অসভ্য কর্মের তালিকা দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ জুড়ে প্রতিদিনই এখন রক্তাক্ত একাত্তরের তান্ডব। দেশটির নীচের নামা এখনো শেষ হয়নি, বরং প্রতিদিন ধেয়ে চলছে নীচ থেকে আরো নীচের দিকে। নতুন বীভৎসতা নিয়ে গড়া হচ্ছে নৃশংস বর্বরতার নতুন ইতিহাস। ২০০৬ সালের ৩০ অক্টোবর ১২ জন নিরীহ নাগরিককে যেভাবে লগি-বৈঠা নিয়ে বায়তুল মোকাররমের উত্তরের রাস্তায় হত্যা করে লাশের উপর নাচানাচি করা হলো -সেরূপ নৃশংসতার কথা কি কোন সভ্য দেশে ভাবা যায়? একাত্তরের  ৯ মাসেও কি কোথাও লাশের উপর এরূপ নৃশংস নৃত্য দেখা গেছে? এ হলো নৃশংস অসভ্যতার নতুন মাত্রা। অথচ সে অপরাধে পুলিশ কাউকেই গ্রেফতার করেনি। আদালতে তা নিয়ে কোন বিচার বসেনি। বড় রকমের এরূপ হত্যাকাণ্ড ঘটলেও কোন অপরাধীকেই শাস্তি দেয়া হয়নি। যেন সেদিন বাংলাদেশের মাটিতে কোন অপরাধই ঘটেনি।

সেদিন ১২টি নিরীহ প্রাণ অকারণেই নীরবে ঝরে গেল। নিহতগণ যেহেতু ইসলামপন্থী এবং খুনিরা যেহেতু লগি-বৈঠাধারী আওয়ামী বাকশালী –অতএব বিচারের প্রশ্নই উঠে না। দেশ যেন গহিন জঙ্গল। উক্ত ঘটনার দিন দেশে সরকার, পুলিশ, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা যে বেঁচে ছিল –তার আলামত সে দিন দেখা যায়নি। জঙ্গলে পশুর নখরে নিহত হলে তার বিচার হয়না, তেমন এক জঙ্গলীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাংলাদেশে। সভ্য রাষ্ট্রের আলামত হলো আইনের শাসন। আইনের শাসন বিলুপ্ত হওয়ার অর্থ, সভ্য রাষ্ট্রের বিলুপ্তি। তখন বিজয় পায় পশুত্ব ও অসভ্যতা। মানুষ খুন হলো অথচ খুনির শাস্তি হলো না –এ থেকে প্রমাণ মেলে, বেঁচে নাই আইনের শাসন। এতে বুঝা যায়, রাষ্ট্র বেঁচে নাই কোন সভ্য ও ভদ্র এজেন্ডা নিয়ে। এভাবেই সংকেত মেলে, রাষ্ট্র ধেয়ে চলছে ভয়ানক অসভ্যতার দিকে।

একই রূপ পশুত্বের বিজয় দেখা গেছে ২০১৩ সালের ৫ মে’র রাতে শাপলা চত্বরে। সে রাতে সেনা বাহিনীর সদস্যগণ যেভাবে মেশিন গান দিয়ে শত শত নিরস্ত্র মানুষকে হতাহত  করে -সেটিও কি কোন সভ্য দেশে হয়? সে হত্যাকান্ডের কোন তদন্ত হয়নি, আদালতে বিচার বসেনি এবং কারো কোন শাস্তিও হয়নি। অথচ বহু মানুষ যে মারা গেছে ও আহত হয়েছে সে খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। লাশ মিউনিসিপালিটর ময়লার গাড়িতে তুলে গায়েব করে এবং পানি দিয়ে রাস্তা ধুয়েও সে নৃশংতার চিত্র গায়েব করতে পারিনি। পশুত্বের ও অসভ্যতার আলামত তো এটাই যে, অপরাধ ঘটে যায় কিন্তু সে অপরাধের বিচার হয়না। এবং রেহাই পেয়ে যায় খুনের আসামীগণ। আইন-আদালত আছে এমন কোন সভ্য দেশে কি এমনটি ভাবা যায়। অথচ ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে এটাই রীতি।

সেনাবাহিনীর কাজ তো জনগণকে প্রতিরক্ষা দেয়া, জনগণকে হত্যা করা নয়। একাত্তরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অপরাধগুলো নিয়ে বহু আলোচনা হয়। কিন্তু নিন্দা ও আলোচনা নাই বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর নৃশংস অপরাধগুলো নিয়ে। নৃশংসতার ও অসভ্যতার সংস্কৃতি সেনাবাহিনীর মধ্যে যে কতটা প্রবল ভাবে প্রতিষ্ঠিত -সেটি দেখা গেছে ২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাকান্ডে। সেনাবাহিনীর সেপাহীরা সেদিন নিরস্ত্র জনগণের উপর নয়, নিজেদের অফিসারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৫৬ জন অফিসারসহ ৭৪ জনকে হত্যা করে। কোন বিশ্বযুদ্ধেও একদিনে এতো জন অফিসার নিহত হয়নি। নৃশংস বর্বরতার এ ইতিহাসও একমাত্র বাংলাদেশের। দেশে যখন প্রবল প্লাবন আসে তখন সে প্লাবনের পানি শুধু নদীতে থাকে না, সকল জনপদেই প্রবেশ করে। তেমনি নৃশংস দুর্বৃত্তির প্লাবন এলে তা থেকে সামরিক-বেসামরিক কোন প্রতিষ্ঠানই বাঁচে না। তাই বাঁচেনি দেশের সেনাবাহিনীও।

২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর যেরূপ দিনের ভোট নির্বাচনের পূর্বের রাতে ডাকাতি হয়ে গেল -সেরূপ অসভ্য কর্মের ইতিহাসও কি সমগ্র বিশ্বমাঝে কোথাও আছে? সেটিও ঘটেছে একমাত্র বাংলাদেশে। সাধারন ডাকাতেরা এক রাতে মাত্র কয়েক গৃহে ডাকাতির সামর্থ্য রাখে। কিন্তু হাসিনার ডাকাত দল এক রাতে সমগ্র দেশ জুড়ে ডাকাতি করে নিয়েছে। জাতীয় সংসদের ৩০০ সিটের মাঝে ২৯৩ সিট আওয়ামী লীগ জোট নেয়। বাংলাদেশের কোন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কি কোন কালে এতো সিট ও এতো ভোট পেয়েছে? গৃহে ডাকাতের হামলা হলে গৃহমালিকের সব কিছুই ডাকাতি হয়ে যায়। তেমনি সব সিট দখলে নেয় ভোটডাকাতগণ। ডাকাত সর্দারনী শেখ হাসিনা সেটি করেছে। কোন জবাবদেহীতা নাই।

কোন সভ্য দেশে চুরিডাকাতি বা ভোটডাকাতি হলে সে দেশের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কাজ হয় ডাকাত ধরা। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটে উল্টোটি। এদেশে পুলিশ ও সেনাবাহিনী যোগ দেয় ডাকাতদের দলে। তাই ২০১৮ সালের ভোটডাকাতিতে ডাকাতদের সাথে যোগ দেশের পুলিশ, RAB ও সেনা বাহিনী। তারা দেশবাসী থেকে নিজেদের বেতনের অর্থ, রেশন, বাড়ির প্লট ও নানারূপ সুযোগ-সুবিধা নেয়, কিন্তু প্রতিরক্ষা দেয় জনগণের শত্রুদের। এই হলো তাদের গাদ্দারীর নমুনা। জঙ্গলে ডাকাতি হলে বিচার হয় না। কারণ সেখানে পুলিশ ও আদালত থাকে না। ফলে বিচার না হওয়াই জঙ্গলের সংস্কৃতি। সে জঙ্গলের সংস্কৃতির পাহারা দিচ্ছে দেশের পুলিশ, RAB ও সেনা বাহিনী। 

অসম্ভব করেছে সভ্য রূপে বাঁচা

সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কোন দাবী-দাওয়ার বিষয় নয়। এটি নাগরিকদের ন্যায্য অধিকারের বিষয়। সে অধিকার না দেয়াই গুরুতর অপরাধ। তাই এ অধিকার নিয়ে আন্দোলন করতে হবে কেন? ভদ্র মানুষেরা অন্যের ন্যায্য পাওনাকে যথাযথ ভাবে দিয়ে দেয়। ভদ্রতা তো সে পাওনা পরিশোধ করায়। জনগণের সে পাওনার বিষয়টি হলো ভোটের অধিকার। প্রতিটি সভ্য ও ভদ্র সরকারের ন্যূনতম দায়িত্ব হলো, জনগণের সে অধিকারের সুরক্ষা দেয়া। অথচ বিস্ময়, সে সভ্যতা ও ভদ্রতা হাসিনার মধ্যে নাই। ফলে জনগণের ভোটের উপর সে ডাকাতি করে। অথচ জনগণের ভোটের উপর ডাকাতির অর্থ: জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সে যুদ্ধ ও অপরাধের পথে নেমেছে শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে এভাবেই সে অসম্ভব করেছে সভ্য ও ভদ্র রাজনীতি। একই অপরাধ করেছিল শেখ মুজিব। তিনিও একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা দিয়ে অসম্ভব করেছিলেন নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের শান্তিপূর্ণ সভ্য রীতি।

তাছাড়া সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কোন জটিল বিজ্ঞানের বিষয় নয়। নেপাল, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বহু দেশেই সেটি অনায়াসে হয়। অথচ সেরূপ নির্বাচন বাংলার মাটিতে নেপাল, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ন্যায় দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার বহু আগে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেটি আজ থেকে ৬৮ বছর আগে ১৯৫৪ সালে। কিন্তু আওয়ামী শাসনামলে একবারও হয়নি। না মুজিবের আমলে, না হাসিনার আমলে। অথচ দেশটির উপর আওয়ামী লীগ ২২ বছর শাসন করেছে। আওয়ামী লীগের শাসন মানেই জনগণের অধিকারের উপর ডাকাতির শাসন। আওয়ামী লীগ কখনোই জনগণকে অধিকার দেয় না, বরং কেড়ে নেয়।

ভোটডাকাতির অপরাধ ও নিরেপক্ষ নির্বাচন এক সাথে চলে না। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য মানবিক গুণে বেড়ে উঠাটি জরুরি। দুর্বৃত্ত ডাকাতদের তা থাকে না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচনের নামে দুর্বৃত্তি করে প্রমাণ করে দিয়েছে, মানবিক গুণে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে বাকশালী আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের ব্যর্থতা কতটা প্রকট। এখানে অপরাধী শুধু হাসিনা নয়, অপরাধী হলো দেশের পুলিশ, RAB, সেনা বাহিনী, প্রশাসন এবং আদালতও। তাদের সহযোগিতা না পেলে হাসিনার একার পক্ষে দেশ জুড়ে এতো বড় ভোটডাকাতি করা সম্ভব হতো না। কোন ডাকাতই একাকী তা পারে না। ব্যর্থতা জনগণেরও। তারাও নিজেদের ভোটকে ডাকাতি হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছে। সম্পদ থাকলে সে সম্পদের পাহারা দেয়ার সামর্থ্যও থাকতে হয়। নইলে ডাকাতেরা ছিনিয়ে নেয়। বাংলাদেশে তো সেটিই ঘটেছে। ব্যর্থতা সে সব বিবেকহীন শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও মিডিয়াকর্মীদেরও যারা হাসিনার ন্যায় ভোটডাকাতকে ঘৃণা না করে মাননীয় ও শ্রদ্ধেয় বলে। এরূপ মৃত বিবেক নিয়ে কি সভ্য ও ভদ্র রাষ্ট্র গড়া যায়?