বাংলাদেশে হিফাজতে ইসলাম এবং ইসলামের হিফাজতে ভয়ানক ব্যর্থতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল     27 January 2023

www.drfirozmahboobkamal.com/blog/বাংলাদেশে-হিফাজতে-ইসলাম/

কতটুকু হচ্ছে ইসলামের হিফাজতের কাজ?

বাংলাদেশে আলেমদের প্রধানতম সংগঠন হলো হিফাজতে ইসলাম। নাম শুনলেই মনে হয় এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাংলাদেশের বুকে ইসলামের হিফাজতের লক্ষ্যে। বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার দুটি ধারা। একটি আলিয়া মাদ্রাসার ধারা। এধারার মাদ্রাসাগুলির জন্য সরকারি বরাদ্দ আছে এবং শিক্ষাকার্যক্রম তদারকির জন্য মাদ্রাসা বোর্ডও রয়েছে। ছাত্রদের নিয়মিত পরীক্ষা নেয়া হয় এবং পাশ করলে তাদের ডিগ্রি দেয়া হয়। আলেম, ফাজেল ও টাইটেল হলো এ মাদ্রাসা থেকে দেয়া ডিগ্রির নাম। তারা ইচ্ছা করলে মাদ্রাসা বোর্ডের দেয়া ডিগ্রি দেখিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হতে পারে।

অপরটি হলো কওমী মাদ্রাসার ধারা। এ ধারার মাদ্রাসাগুলির জন্য কোর সরকারি বোর্ড নাই। কোন সরকারি বরাদ্দও নাই। খরচ চলে জনগণের দানের অর্থে। পরীক্ষা নেয়া ও সার্টিফিকেট দেয়ারও কোন বিধান নাই। শিক্ষা শেষ হলে মাদ্রাসার পক্ষ থেকে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সনদ ও পাগড়ি বিতরণ করা হয়। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে বহু শত কওমী মাদ্রাসা রয়েছে। এ মাদ্রাসাগুলোর রয়েছে বহু লক্ষ ছাত্র। রয়েছে বহু হাজার শিক্ষক। বাংলাদেশের অধিকাংশ মসজিদের ইমাম হলো এই কওমী মাদ্রাসা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্ররা। হিফাজতে ইসলাম হলো কওমী মাদ্রাসার মোহাদ্দেসদের তথা শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান। ফলে এ সংগঠনটির সদস্যদের সংখ্যটি বিশাল। এ সংগঠনের নেতাদের ডাকা অনুষ্ঠানগুলিতে কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররাও হাজির হয়। মসজিদের ইমামতি হাতে থাকায় তাদের প্রভাবও যথেষ্ট।

কিন্তু প্রশ্ন হলো হিফাজতে ইসলামের ন্যায় বিশাল সংগঠনের দ্বারা বাংলাদেশে ইসলামের হিফাজতের কাজটি কতটুকু হচ্ছে? হিফাজতের অর্থ কি শুধু মাদ্রাসাগুলোর হিফাজত? শুধু কি মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের স্বার্থের হিফাজত? শুধু কি মাদ্রাসার জন্য অনুদান লাভ, জমি লাভ এবং মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্য নানারূপ সুযোগ-সুবিধা ও সার্টিফিকেট লাভের নিশ্চয়তা? শেখ হাসিনা কওমী মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা শেষ করে যারা বেরুবে তাদেরকে এম,এ ডিগ্রি প্রদানের অঙ্গিকার করেছে। আর তাতে অতিশয় খুশি হয়ে হাসিনার ন্যায় একজন নৃশংস জালেম ফ্যাসিস্টকে কওমী জননীর খেতাব দিয়েছে। 

জালেমের কাছে আত্মসমর্পণে কি ইসলামের হিফাজত সম্ভব?

শাসক যেখানে নৃশংস জালেম এবং যার লাগাতর যুদ্ধটি ইসলামের বিরুদ্ধে, তার কাছে আত্মসমর্পণে কি ইসলামের হিফাজতের কাজটি হয়? প্রতিযুগেই ইসলামের বড় শত্রু হলো নমরুদ-ফিরাউনের ন্যায় স্বৈরাচারি শাসকগণ। তারা আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্বের বদলে নিজেদের সার্বভৌমত্বের প্রতিষ্ঠা চায়। ইসলামকে তারা নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে। তাই স্বৈরাচারি শাসকমাত্রই ইসলামের শত্রু। তারা শুধু ইসলামপন্থীদের আত্মসমর্পণই চায় না, বরং যে লক্ষ্যে< ল্কষউদ্দেশ্য, এজেন্ডা  নিয়ে ইসলাম নবীজী (সা:)’র হাতে প্রতিষ্ঠিত পেয়েছিল তারও বিলুপ্তি চায়। নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলামে শুধু নামাজ, রোজা, হজ্জ,যাকাত ছিল না, সে ইসলামে ছিল ইসলামী রাষ্ট্র, শরিয়ত, কুর’আন শিক্ষা, জিহাদ ও মুসলিম ঐক্য, সে ইসলামকে শেখ হাসিনার সরকার মানতে রাজী নয়। যে জিহাদ দেয় শত্রুদের হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা, মুসলিমদের সে জিহাদ নিয়েও বাচতে দিতে রাজী নয়। তাই হাসিনার সরকারের পক্ষ থেকে ইসলামের মূল এজেন্ডা, শিক্ষা, চেতনা ও মুসলিমত্বের উপর চলছে লাগাতর হামলা।

শেখ হাসিনা সরকার ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। ফলে ভারত যা চায়, শেখ হাসিনাও সেটিই চায়। ফলে মুর্তি এখন আর শুধু মন্দিরে শোভা পায়না, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিণাতেও প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। স্কুলের আঙ্গিণায় মুজিবের মুর্তি বসিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সে মুর্তির প্রতি সম্মান দেখাতে বাধ্য করা হচ্ছে। হিন্দুদের পূজাকে সকল নাগরিকের উৎসবে পরিণত করা হচ্ছে। স্কুলের পাঠ্য পুস্তকে মানুষকে বানরের বংশধর বলা হচ্ছে। এ ভাবে মানবের সৃষ্টি প্রসঙ্গে মহান আল্লাহতায়ালার বয়ানের বদলে ডারউনের বয়ানকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। স্কুলের পাঠ্য বই’য়ে মসজিদের বদলে মন্দিরের ছবি বেশী ছাপা হচ্ছে। যে ইখতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের প্রেক্ষিতে বাংলার মুসলিমগণ মুর্তপূজার ভয়ানক বিপদ থেকে মুক্তি পেল তাকে বহিরাগত আখ্যায়ীত করে ছাত্র-ছাত্রীদের ঘৃণা করতে শেখাচ্ছে। এভাবে  বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিণত হয়েছে ছাত্রদের ইসলাম থেকে দূরে সরানোর হাতিয়ারে।

ইসলামের হিফাজতের অর্থ তো ইসলামের নামের হিফাজত নয়। মসজিদ-মাদ্রাসার জায়গা-জমি ও বিল্ডিংগুলির হিফাজতও নয়। বরং সেটি হলো যে লক্ষ্য ও এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সমগ্র মানব জাতির জন্য ইসলামকে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল এবং নবীজী (সা:) যে ইসলামকে পূর্ণ ভাবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন -সে ইসলামের হিফাজত। শয়তানী শক্তির লক্ষ্য, সে কুর’আনী ইসলামের বিলুপ্তি। অতএব সে ইসলামকে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা দেয়ার মধ্যেই ইসলামে হিফাজত। ইসলামের শরিয়তি বিধানকে কিতাবে বন্দী করে রাখলে ইসলাম বাঁচে না। এভাবে ইসলামের হিফাজতের কাজও হয় না। নবীজী (সা:)’ প্রতিষ্ঠিত ইসলামে ইসলামী রাষ্ট্র ছিল, শরিয়তী আদালত ছিল, দুর্নীতির নির্মূল এবং সুবিচারের প্রতিষ্ঠা ছিল, কুর’আন-হাদীসের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল এবং ইসলামের শত্রুদের হামলাকে প্রতিহত করার লাগাতর জিহাদ ছিল। সে সাথে ছিল ভাষা, বর্ণ, গোত্র, অঞ্চল-ভিত্তিক পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠে মুসলিমদের মাঝে প্যান-ইসলামিক ঐক্য। কিন্তু সে ইসলাম বাংলাদেশে বেঁচে নাই। অর্থাৎ ইসলামের হিফাজতের কাজটি হয়নি। রাষ্ট্র অধিকৃত হয়ে আছে ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে। অতএব প্রশ্ন হলো, নবীজী (সা)’র ইসলাম না বাঁচলে হিফাজতে ইসলাম দেশে কোন ইসলামের হিফাজত করছে?

ইসলামকে হিফাজত করার অর্থ: মুসলিমদের চেতনায় ঈমান ও ইসলামী আক্বীদার হিফাজত। কারণ, জনগণের চেতনায় ইসলাম বাঁচলেই রাষ্ট্রের বুকে ইসলাম বাঁচে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের চেতনায় ইসলাম বাঁচানোর কাজটি হচ্ছে। চেতনার ভূবন অধিকৃত করেছে “জয় বাংলা”র চেতনা। ফলে শাসক দলের নেতাকর্মীগণ এই “জয় বাংলা”র চেতনার ধারক। তারা মুসলিম হওয়ার দাবী করলেও তাদের মুখে “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি নাই। অথচ “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি তোলাটি ফরজ। সেটির হুকুম এসেছে পবিত্র কুর’আনে। অথচ “জয় বাংলা”র চেতনাধারীদের চিত্তে মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা দেয়ায় রুচি নাই। সে ঈমানও নাই। বরং “জয় বাংলা” ধ্বনি তোলে তারা সর্বশক্তিবান মহান আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্ঠত্বের বদলে বাংলার মাটি ও ভাষার শ্রেষ্ঠত্বের বয়ান খাড়া করে। এভাবে দেশকে তারা পূজণীয় করে। এভাবে ইসলামের মূল আক্বীদাকে তারা হত্যা করে। এভাবেই বাঙালি মুসলিমের চেতনায় চলছে ঈমান হত্যার কাজ। ঈমান হত্যার কাজটি ব্যাপক ভাবে হওয়ার কারণেই দেশবাসীর মাঝে আগ্রহ নাই শরিয়ত পালনে ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদে। এখানেই হিফাজতে ইসলামের ব্যর্থতা। তারা বাংলাদেশীদের চেতনায় ইসলামকে বাঁচাতে পারিনি।

ইসলামের হিফাজতের অর্থটি ব্যাপক। মুসলিমদের জান, মাল ও ইজ্জত-আবরুর হিফাজতও এর মধ্যে এসে যায়। কারণ ইসলামের অনুসারীগণ নিহত হতে থাকলে ইসলাম বাঁচে না। কিন্তু সে লক্ষ্য অর্জনেও হিফাজতে ইসলাম পুরাপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তারা এমন কি ব্যর্থ হচ্ছে নিজ নেতাকর্মীদের জানের হিফাজত দিতে। তাদের সে ব্যর্থাটি দেখা গেল ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্ত্বরের গণহত্যায়। সেদিন হত্যা করা হয় হিফাজতে ইসলামের অসংখ্য নিরীহ নেতাকর্মীদের। এরূপ গণহত্যার মধ্য দিয়ে জালেম সরকার প্রতিবাদী জনগণকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। হাসিনা এক্ষেত্রে সফল হয়েছে। শাপলা চত্ত্বরের গণহত্যার পর হিফাজতে ইসলাম  আত্মসমর্পণ করে হাসিনার ন্যায় খুনি জালেম শাসকের কাছে। সে রাতের গণহত্যায় নৃশংস ভাবে যাদের শহীদ করা হলো এবং যাদের লাশ ঢাকা মিউনিসিপালিটির ময়লা পরিবহনের গাড়িতে তুলে গায়েব করা হলো – হিফজতে ইসলামের নেতাগণ তাদের নামের তালিকাও প্রকাশ করেনি। এ ভয়ে যে, সেটি করলে তারা বিপদে পড়বে। জালেমের কাছে আত্মসমর্পণে রাজী এমন ভীতুদের দিয়ে ইসলামের হিফাজতের কাজ হয়?

লক্ষণীয় বিষয় হলো, এ গণহত্যার কিছুকাল পরই দেখা গেল হিফাজতে ইসলামীর নেতাদের শাপলা চত্ত্বরের খুনি শেখ হাসিনার সাথে একই মঞ্চে উপনীত হতে। খুনীর সাথে সেদিন হাত মেলাতেও দেখা গেল। ঘটনা সেখানেই থেমে থাকেনি। হাসিনা ন্যায় খুনিকে হিফাজতে ইসলামের কিছু নেতাদের পক্ষ থেকে কওমী জননী খেতাবে ভূষিত করা হলো। প্রশ্ন হলো, এরূপ নৃশংস খুনিকে যারা সম্মানিত করে -তারা কি কখনো ইসলামের হিফাজতকারী হতে পারে? শরিয়তী বিধানে ফরজ হলো খুনিকে শাস্তি দেয়া, এবং হারাম হলো অপরাধীকে সম্মানিত করা।

ইসলামের বিরুদ্ধে চরম নাশকতা হচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গণে। সেখানে কুর’আন-হাদিস শিক্ষা দেওয়া হয় না। মানব সৃষ্টি এবং সে সাথে এ বিশ্বসৃষ্টির পিছনে মহান আল্লাহ সুবহানা ওয়া তায়ালার কি উদ্দেশ্য এবং কি এজেন্ডা -সেগুলো স্কুল-কলেজে শেখানো হয়না। বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম দেশের আদালতে আল্লাহর শরীয়ত আইনের কোন স্থান নেই। ইসলাম যা কিছু হারাম করেছে তার অনেক কিছুই বাংলাদেশের সংবিধানে ও আইনে হালাল করা হয়েছে। তাই ব্যাভিচার, পতিতাবৃত্তি, সূদী ব্যাংক, জুয়া –এগুলিও বাংলাদেশের আইনে বৈধতা পেয়েছে। ফলে প্রশ্ন হলো, কোথায় হিফাজত হলো ইসলামের? 

হিফাজতের মুচলেকাদূরে সরেছে নবীজী (সা) সূন্নত থেকে 

অন্যরা আন্দোলনের মাধ্যমে দাবী আদায় করে। অথচ হিফাজতেরে নেতাগণ বেছে নিয়েছে আত্মসমর্পণের পথ। পত্রিকার প্রকাশ পেয়েছে, হিফাজতের ইসলামের নেতাগণ ফ্যাসিবাদী সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়েছে যে, তাঁরা আর রাজনীতিতে থাকবে না। প্রশ্ন হলো, রাজনীতিতে না থাকলে তারা ইসলামের হিফাজত করবেন কীরূপে? সেটা কি নিজেদের কর্মকান্ড মসজিদ মাদ্রাসার মধ্যে সীমিত রেখে? সেটা কি স্রেফ দোয়া-দরুদের মধ্য দিয়ে সম্ভব?

অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, হিফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীগণ ইসলামের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেননি। ইসলামের হিফাজত স্রেফ দোয়া-দরুদে হয় না। ইসলামকে হিফাজত করতে গিয়ে নবীজী (সা:)কে রাজনীতিতে নামতে হয়েছে।‌‌ রাজনীতি হলো ঈমানদারের জিহাদ। রাজনীতিতে যেমন বুদ্ধিবৃত্তি আছে, তেমনি রাজপথের লড়াই এবং সশস্ত্র যুদ্ধও আছে। মহান নবীজী (সা:)কে এরূপ সবগুলি পথে চলতে হয়েছে। তিনি দশটি বছর রাষ্ট্রপ্রধান ছিলে‌ন। তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। অন্য পক্ষের সাথে সন্ধি করেছেন। বিদেশে দূত পাঠিয়েছেন। তিনি শরীয়ত ভিত্তিক আদালত প্রতিষ্ঠা করেছেন। সে আদালতের মধ্য দিয়ে অন্যায়, জুলুম ও দুর্বৃত্তির নির্মূল করেছেন এবং ন্যায় ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। নবীজী (সা:) যদি তাঁর কর্মসীমা মসজিদের মাদ্রাসা ও দোয়ার মধ্যে সীমিত রাখতেন -তবে কি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেত? সম্ভব হতো কি ইসলামী সভ্যতার নির্মাণ? এসবই তো ইসলামকে হিফাজত করার নবীজী (সা:)’র অনুসৃত পথ। অথচ হিফাজতে ইসলাম সে পথে নাই।

রাজনীতি থেকে হাত গুটিয়ে নেয়ার অর্থই হলো নবীজী (সা:)’র সুন্নত থেকে দূরে থাকা। অথচ নবীজী (সা:)’র সুন্নত থেকে ছিটকে পড়ার অর্থ, ইসলাম থেকে ছিটকে পড়া। শয়তান তো সেটিই চায়। আল্লাহ সুবহানা ওয়া তায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা নিসার ৮০ নাম্বার আয়াতে বলেছেন ,যে ব্যক্তি রাসূলকে অনুসরণ করলো সেই অনুসরণ করলো আল্লাহকে। তাই নবীজী (সা:) রাজনীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার যে মহান সুন্নত রেখে গেলেন সে পবিত্র সুন্নত একজন ঈমানদার বর্জন করে কি করে? অথচ হিফাজতে ইসলাম নবীজী সা:’র সে অতি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নতটিকে বর্জন করছে। অথচ সাহাবায়ে কেরাম ও গৌরব যুগের মুসলিমগণ নবীজী (সা:)’র রাজনীতির সুন্নতকে ধরে রেখেছিলেন। রাজনীতির বলে মুসলিমরা একটি বিশেষ শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। মুসলমিদের পতনের শুরু তো তখন থেকেই যখন আলেমগণ সে সূন্নত থেকে দূরে সরেছে। ‌‌

ব্যর্থতা ইসলামের হিফাজতে

পত্রিকায় আরো প্রকাশ, হাসিনা সরকারের ফরমায়েশ অনুযায়ী হিফাজতে ইসলাম জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করবে। সেটি করবে ফ্যাসিবাদী হাসিনাকে খুশি করার তাড়নায়। লক্ষ্য, তাদের কারান্দী নেতাদের মুক্ত করা। মুসলিম কাজ করে মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করতে। নিয়েত যদি স্বৈরাচারি হাসিনার ন্যায় জালেম ও খুনি শাসককে খুশি করা হয় তবে কি আল্লাহতায়ালা তাতে খুশি হবেন? তাছাড়া প্রশ্ন হলো, রাজপথে জামায়াত-শিবিরকে প্রতিরোধ করার কাজ কি রাজনীতি নয়? তারা যে রাজনীতি নাই –সে কথা কি তবে মিথ্যা নয়? জামায়াত-শিবির বিরোধী রাজনীতি জায়েজ হলে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, শরিয়তী আইনের বিচার এবং দুর্বৃ্ত্ত নির্মূলের রাজনীতিতে তারা নাই কেন?

ইসলামে মুসলিমদের মাঝে একতা গড়া ফরজ। অথচ হিফাজতে ইসলাম একতা প্রতিষ্ঠার সে ফরজ কাজে নাই। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে কি বাঙালি মুসলিমদের মাঝে একতা প্রতিষ্ঠার কাজটি হবে? ইসলামপন্থীদের মাঝে এরূপ বিভক্তির রাজনীতিতে ইসলামের হিফাজতের কাজটি হবে না। বরং তাতে অধিক হারে হবে শেখ হাসিনার ন্যায় ইসলামের শত্রুর হিফাজতের কাজটিই। এবং তাতে মহা খুশি হবে শয়তান। হিফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের মাঝে কি এরূপ গুরুতর বিষয়গুলি নিয়ে কোন চিন্তা-ভাবনা নেই?

দেশ আজ হাসিনার ন্যায় নৃশংস জালেম, খুনি ও ভোটডাকাতের হাতে অধিকৃত। এরূপ খুনি জালেমের বিরুদ্ধে হক কথা বলাকে নবীজী (সা:) উত্তম জিহাদ বলেছেন। দেশের বিরোধী দলগুলো এ জালেম সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছে। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো, সে লড়াই’য়ে হিফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীগণ নাই। তারা বরং হাসিনাকে মুচলেকা দিয়েছে যে তারা রাজনীতিতে নাই। এর অর্থ, জালেম শাসক নির্মূলের লড়াই’য়ে তারা নাই। এটি কি জনগণের মৌলিক অধিকারের সাথে গাদ্দারী নয়? যারা ইসলামের হিফাজত নিয়ে ভাবে তারা কি জালেমের কাছে কখনো আত্মসমর্পণ করে?

হযরত আদম (আ:)কে সৃষ্টির পরই তাঁর সামনে শয়তানকে তার প্রতারণা ও কুমন্ত্রনার ফাঁদ নিয়ে হাজির হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এভাবেই সেদিন হযরত আদম (আ:) ও বিবি হাওয়াকে পরীক্ষার মুখোমুখী খাড়া করা হয়েছিল। মহান আল্লাহতায়ালার অনুমতি ছাড়া একটি পাতাও পড়ে না। তিনি না চাইলে শয়তান সে সুযোগ পেত না। প্রতিযুগে শয়তান ও তার খলিফাদেরকে খাড়া করা হয় ঈমানদারের ঈমানের পরীক্ষা নেয়ার জন্য। পরীক্ষায় পাশের মধ্য দিয়েই তাকে নিজেকে জান্নাতের যোগ্য রূপে প্রমাণ করতে হয়। শয়তান যে প্রতারণার ফাঁদটি হযরত আদম (আ:)’য়ের সামনে পেশ করেছিল, শয়তানের অনুসারী রূপে সে কাজটিই করছে শেখ হাসিনা। সে নিচ্ছে বাঙালি মুসলিমদের ঈমানের পরীক্ষা। এরূপ পরীক্ষায় তো তারাই পাশ করে যারা তাকে চিনতে সক্ষম এবং তার নির্মূলে খাড়া হতে সক্ষম। নামাজের জামায়াতে অনেক ঘুষখোর, মদখোর ও সূদখোরই খাড়া হতে পারে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয় সত্যের পক্ষে ও শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াই’য়ে খাড়া হতে। প্রশ্ন হলো, এ লড়াইয়ে হিফাজতে ইসলামের অবস্থানটি কোথায়?

কথা হলো, জালেম শাসককে ক্ষমতায় রেখে কি ইসলামের হিফাজত দেয়া যায়? তখন তো অসম্ভব হয় পূর্ণ ইসলাম-পালন। কারণ, পূর্ণ ইসলাম পালনের জন্য চাই কুর’আনী জ্ঞান, শরিয়তী বিচারের প্রতিষ্ঠা এবং সহায়ক রাষ্ট্রীয় পরিবেশ। এগুলিকে অসম্ভব করা হয়েছে বাংলাদেশে। যারা শরিয়ত অনুযায়ী বিচার করে না তাদেরকে মহান আল্লাহতায়ালা সুরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে কাফির, জালিম ও ফাসিক রূপে অভিহিত করেছেন। এ আয়াত তিনটির মাধ্যমে মহান আল্লাহতায়ালা জানিয়ে দিয়েছেন শরিয়তের প্রতিষ্ঠা মুসলিম রূপে গণ্য হওয়ার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। শরিয়তের প্রতিষ্ঠা না দিয়ে ইসলাম পালন হয় না। তখন মুসলিমের মুসলিমত্ব বাঁচে না। ইসলামের হিফাজতও হয়না। অথচ শরিয়ত প্রতিষ্ঠার জিহাদে হিফাজতে ইসলাম নাই। স্কুল-কলেজে কুর’আন শিক্ষা দেয়া হোক –সে দাবী নিয়েও হিফাজত ইসলাম আন্দোলনে নাই। ফলে গাদ্দারীটি কি ইসলামের সাথে নয়? হিফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীগণ যতই ইসলামের পাহারাদার হওয়ার দাবী করুক না কেন, তাদের দ্বারা ইসলামের হিফাজতের কাজ যে হচ্ছে না –সেটি দেশের আদালতে শরিয়তের বিলুপ্তি এবং স্কুল-কলেজে কুর’আনী জ্ঞানদানের অনুপস্থিতিই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তবে ব্যর্থতা শুধু হিফাজতে ইসলামের নয়। বরং এ ব্যর্থতাটি প্রতিটি বাঙালি মুসলিমের। কারণ, ইসলামকে হিফাজত করার ফরজ দায়ভারটি তো প্রতিটি ঈমানদারের। ২৮/০১/২০২৩