বাংলাদেশে সীমান্ত সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি

ড. মাহফুজ পারভেজ

মিয়ানমারে সংকট এখন চরম পর্যায়ে। দেশটির কেন্দ্রস্থল ছাড়িয়ে গৃহযুদ্ধের ছাপ সর্বত্র। সশস্ত্র লড়াইয়ের ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ ও ভারত। বিশেষ করে, মিয়ানমারে প্রচণ্ড গৃহযুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের সীমান্ত সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টি অগ্রাধিকার তালিকায় চলে এসেছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, সংঘাতকবলিত বিশ্ব মানচিত্রে মিয়ানমার একটি স্পর্শকাতর দেশ। নিরাপত্তার ঝুঁকি ও স্থিতিশীলতার সংকটে থাকা অঞ্চলগুলোর মধ্যে মিয়ানমারকে গণ্য করা হয়। মিয়ানমারের সংকট ও সংঘাত দেশটির পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ডের জন্যেও বিপদের কারণ হচ্ছে। নিকট প্রতিবেশী হওয়ায় বাংলাদেশকে সব সময়ই মিয়ানমার বিষয়ে থাকতে হয় সতর্ক। সর্বশেষ ঘটনাপ্রবাহে মিয়ানমারের তীব্র গৃহযুদ্ধ বাংলাদেশ সীমান্তে উত্তেজনা, প্রাণহানি, বোমা ও গোলাবর্ষণের পাশাপাশি সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিবর্গের অনুপ্রবেশের উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশের জন্য। মিয়ানমারের সমস্যা যে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জন্য মারাত্মক বিপদের বার্তাবহ, তারও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে অঘোষিত এক সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল।

এসময় তিনি মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সরকারের বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এ খবর দিয়েছে অনলাইন টাইমস অব ইন্ডিয়া। ফলে মিয়ানমারের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও বাড়ছে সংঘাতজনিত বিপদ।

মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ও সংঘাতের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় এবং বিশেষভাবে নাইক্ষ্যংছড়ি ও উখিয়া উপজেলায়। পাশের দেশের বিপদের আঁচে সীমান্তসংলগ্ন অন্তত ২০টি গ্রাম এখন আতঙ্কের জনপদ। প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে তাদের ব্যবসা, স্কুল ও ক্ষেত-খামারের কাজ। এমন প্রেক্ষাপটে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে সব মিলিয়ে ২৬৭ জন পরাজিত সেনাসদস্য। উখিয়ার রহমতবিল সীমান্ত দিয়ে দেশটির সেনা, শুল্ক কর্মকর্তা ও অন্য সংস্থার সদস্যরাও ঢুকেছে। সাধারণ মানুষও সংঘাত থেকে বাঁচতে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছে।

সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টারশেল এসে পড়ছে বাংলাদেশে। নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের মধ্যমপাড়ায় এমন ঘটনা ঘটেছে। সেখানে মর্টারশেলটি একটি বাড়ির উঠানের আমগাছে লেগে মাটির নিচে ঢুকে যায়। এতে কেউ হতাহত না হলেও তুমব্রুর পশ্চিমকুল এলাকায় মর্টারশেলের আঘাতে ছৈয়দ আলম (৩৫) নামে এক ইজিবাইকচালক আহত হয়েছেন।

সংকট তৈরি হচ্ছে মিয়ানমারের পরাজিত সেনাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময়ও। প্রথম দফায় ১১১ সেনাসদস্য বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করলে গ্রামবাসী তাদের বাধা দেয়। এসময় সশস্ত্র সেনাসদস্য নিরস্ত্র গ্রামবাসীর ওপর হামলা করে। এতে চার বাংলাদেশি আহত হন।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারীদের কাছে রাইফেল ও এসএমজি ছিল। তারা সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করেছে ও  বোমা ফাটাচ্ছে। যারা সশস্ত্র হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে,  তাদের মধ্যে পরাজিত সেনাসদস্য ছাড়াও বিদ্রোহী গ্রুপ আরসা ও আরএস কর্মী থাকতে পারে। সেনাদলের আড়ালে আরসা বা আরএসও সদস্যরা ঢুকছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার সুযোগ কম। আতঙ্ক সৃষ্টি করে যে অস্ত্রধারীরা আসছে, তারা আসলে কারা, তা শনাক্ত করা জরুরি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের দুই শিক্ষক মোহাম্মদ আলম চৌধুরী ও আক্কাস আহমদের বাড়ি মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায়। তারা নিরাপত্তা ও শরণার্থী ইস্যুতে গবেষণায় লিপ্ত। সরজমিন তথ্যের ভিত্তিতে তারা বলেছেন, গোলাগুলি ও মর্টারশেলের ভয়ে সীমান্তবর্তী এলাকার লোকজন দূরবর্তী নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। বিদ্রোহীদের ধাওয়ায় পালিয়ে আসছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর পরাজিত সদস্যরাও। আশঙ্কা বাড়ছে সংঘাতকবলিত মিয়ানমার থেকে আরও শরণার্থী অনুপ্রবেশের। বিদ্রোহী গ্রুপগুলোও প্রতিপক্ষের খোঁজে সীমান্ত অতিক্রম করে চলে আসতে পারে। ফলে সীমান্ত সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি হ্রাসে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

৭ই ফেব্রুয়ারি সকালে গবেষকদ্বয় জানান, মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সংঘর্ষ বেড়েই চলছে। সারারাত ধরে থেমে থেমে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে সীমান্ত এলাকায়। তুমব্রু সীমান্তে গোলাগুলির আওয়াজ কমলেও ঘুমধুম সীমান্ত এলাকার পরিস্থিতি এখনো অস্বাভাবিক। ওপার থেকে এখনো আসছে গুলির আওয়াজ। সেখানকার মানুষের ঘুম ভাঙছে গুলির বিকট শব্দে। সর্বত্র বিরাজ করছে আতঙ্ক। তারা বলেন,  এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বান্দরবান ও কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসকারী জনসাধারণের দিন-রাত কাটছে চরম উৎকণ্ঠায়। অনেক এলাকার মানুষ ভয়ে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, মিয়ানমারের ভেতরে দেশটির সরকারি বাহিনীর (বিজিপি) সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) লড়াই চলছে। এ কারণে মিয়ানমার সীমান্তের ক্যাম্প দখলে টানা গুলিবর্ষণ, মর্টারশেল নিক্ষেপসহ বিস্ফোরণের শব্দে সীমান্ত লাগোয়া বাংলাদেশের গ্রামগুলো কেঁপে উঠছে।

উল্লেখ্য যে, মিয়ানমার বর্তমানে একটি দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের অন্তত ৬০ শতাংশ বিদ্রোহী আরাকান আর্মির (এ এ) নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রাখাইনসহ মিয়ানমারের একটি বড় অংশ এরই মধ্যে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। তাদের হামলার তীব্রতায় টিকতে না পেরে জান্তা সেনারা একাধিক স্থান থেকে পালিয়ে গেছে। আরাকান আর্মির (এএ) অপারেশন ১০২৭-এর অংশ হিসেবে রাথেডং, মংডু ও মিনবাইয়া শহরে পাঁচটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। ২০২২ সালের নভেম্বরে জান্তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ একটি অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি বাতিল করে বিদ্রোহীরা সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। তারা পুলিশ স্টেশন, সেনা ছাউনি দখল করে। আটক ও পরাজিত সেনাদের হত্যাও করে বিদ্রোহীরা। যার প্রভাবে সেনা ও সাধারণ মানুষ পালাতে গিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। কোথাও কোথাও তাদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষও হচ্ছে। যার কারণে বাংলাদেশে গুলি ও বোমা ছিটকে আসছে। বাংলাদেশের নাগরিকগণ আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাচ্ছেন।

মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধে সৃষ্ট চরম সংঘাতের ফলে বাংলাদেশের সীমান্ত সুরক্ষা জোরদার করা জরুরি, যাতে সে দেশের সংঘাত বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করতে না পারে এবং পরাজিত সেনা, বিদ্রোহী বা নাগরিকদের ঢল এদেশে আসতে না পারে। আগে থেকেই মিয়ানমার থেকে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এই চাপ আরও বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশ বহুমাত্রিক নিরাপত্তা সমস্যার সম্মুখীন হবে।

যদিও বাংলাদেশ সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তথাপি এতটুকুই যথেষ্ট কিনা, তা বাংলাদেশকে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। বাংলাদেশ কূটনৈতিক শিষ্টাচার সর্বোচ্চ করলেও অস্থিতিশীল ও ভঙ্গুর মিয়ানমার এমন একটি দেশ, যারা কূটনৈতিক শিষ্টাচারকে অনুসরণ করার মতো সক্ষম অবস্থানে আছে কিনা সন্দেহ। কারণ, সামরিক স্বৈরাচার, জাতি-নিধন, সংঘাত, গৃহযুদ্ধ, মাদক ব্যবসা, মানবপাচার ও অস্ত্রের চোরাচালান দেশটির সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে শিথিল করে দিয়েছে। যে দেশ নিজের বহুবিধ সমস্যায় ডুবন্ত এবং যার ক্ষমতাকাঠামো বহুধাবিভক্ত, তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সংকট সমাধানের প্রকৃত দিশা পাওয়া অসম্ভব।
ফলে মিয়ানমার পরিস্থিতির কারণে উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে বাংলাদেশকে নিজের সীমান্ত সুরক্ষা ও নিরাপত্তার দিকে অধিক মনোযোগী হতে হবে। কূটনৈতিক পন্থা ছাড়াও বিকল্প সমাধানসূত্র ধরে অগ্রসরের চেষ্টাও করতে হবে বাংলাদেশকে। কারণ মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ও সশস্ত্র সংঘাত দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকলে বাংলাদেশের জন্যেও নতুন নতুন বিপদ তৈরি হতে পারে।

বেসামরিক অভিমুখে মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপের পাশাপাশি মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের দেশসমূহ এবং আন্তর্জাতিক শক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে বাংলাদেশকে। কারণ, মিয়ানমারের সংঘাত বাংলাদেশ বা একক কোনো দেশের নয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। ফলে সমস্যাটি দ্বিপক্ষীয় নয়, বহুপক্ষীয়। যাকে আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে বেইজিং, নয়াদিল্লি, ওয়াশিংটন এবং জাতিসংঘের সঙ্গে দেন-দরবারে লিপ্ত হলে বাংলাদেশকে একাই মিয়ানমারের দিক থেকে আগত যাবতীয় চাপ সামলাতে হবে না।

সামরিক অভিমুখেও সতর্ক ও প্রস্তুত থাকতে হবে বাংলাদেশকে। সামরিক বাহিনীকে সদাপ্রস্তুত রেখে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে চেষ্টা করতে হবে যেন মিয়ানমারের বিবাদের কারণে আমাদের সীমান্তে সংঘাত পরিস্থিতি তৈরি না হয়। মিয়ানমার সেনা ও বিদ্রোহীরা যখন বাংলাদেশের প্রস্তুতি দেখবে, তখন এদিক থেকে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হবে। মিয়ানমারের বিদ্রোহী সশস্ত্র দল আরাকান আর্মিসহ অন্য ফ্যাক্টরগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ স্থাপন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাখাইনকে স্থিতিশীল করা বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি। এতে  সীমান্ত উত্তেজনা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি কমবে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ মসৃণ হবে।

সামগ্রিকভাবে মিয়ানমারের পরিস্থিতিগুলো বাংলাদেশের নীতিপ্রণেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক কৌশলী, গোয়েন্দা সংস্থা ও বিশেষজ্ঞ-গবেষকদের গভীর মনোযোগের আওতায় থাকা অপরিহার্য। সেখনকার চলমান ঘটনাপ্রবাহ এবং বিবদমান বিভিন্ন গোষ্ঠীর পরিকল্পনা ও কার্যক্রম সম্পর্কে স্বচ্ছ ও পর্যবেক্ষণমূলক ধারণা বাংলাদেশকে কার্যকর পন্থা ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে পথ দেখাতে পারবে।
লেখক: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

manabzamin