বাংলাদেশের বিভিন্ন নিয়োগ ও প্রার্থিতায় ভারত হস্তক্ষেপ করে: তৌহিদ হোসেন

বাংলাদেশের বিভিন্ন নিয়োগ ও প্রার্থিতায় ভারত হস্তক্ষেপ করে: তৌহিদ হোসেন

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের নানা তৎপরতা ছিল। বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের হস্তক্ষেপ, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নানা বিষয়ে কথা বলেছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন। বিস্তারিত তুলে ধরেছেন আরিফুল ইসলাম আদীব

বাংলা আউটলুক: ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াকে কীভাবে দেখছেন?
তৌহিদ হোসেন : আমি যেটা মনে করি যে, প্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত যা যা পাওয়া গিয়েছে সবই প্রত্যাশিত ছিল। কারণ ভারত, রাশিয়া, চীন সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করে আসছে অনেকদিন ধরে। সে অনুযায়ী সরকার নির্বাচন করেছে, ফলে তারা অভিনন্দন জানাবে খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। একইভাবে পাশ্চাত্যের দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,  যুক্তরাজ্য তারা প্রথম থেকে বলছিল যে, অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক কার্যকরী নির্বাচন হোক। সেটা তো হয়নি, আমরা জানি তারা যেভাবে চাচ্ছিল সেটা হয়নি। সরকার তার পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচন করে সরকার গঠন করেছে। তারা যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে সেটা সহজ, সামনে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে এটা আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি, এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে। সেক্ষেত্রে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা ব্যাপারটা হলো যে, ব্যক্তির নাম ঘোষণা হয় না, যাকে দেওয়া হয় তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের ভিসা দেওয়া হয় না। এটা যদি এমন হয় (নাম প্রকাশ না হলে), সরকার তাহলে সামলাতে পারবে। আর কোনো নিষেধাজ্ঞা আসবে কিনা তেমন ইশারা আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। যদি আসে তাহলে অবশ্যই অসুবিধা হবে দেশের জন্য। আর যদি শুধু ভিসা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সীমিত থাকে, তাহলে সরকার সেটা সামলাতে পারবে। অন্য কোনো বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আসবে কিনা, এখন পর্যন্ত লক্ষণ পাওয়া যায়নি। এমনিতে নির্বাচনের আগে তাদের লোকজন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা বা শ্রম আইন বিষয়ে কথা বলেছিল। সেটা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে দুমাস থেকে ছয় মাস।

বাংলা আউটলুক: ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয়কে কিভাবে দেখেন?
তৌহিদ হোসেন : ২০০১ সালে এরকম সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিএনপি পেয়েছিল। দুই পক্ষই সমান ভোট পেয়েছে। কিন্তু আসন পার্থক্য ছিল অনেক। ২০০৮ সালের বিপুল কথাটা নিয়ে আমার  আপত্তি আছে। বিপুল যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে আওয়ামী লীগ, ২০০৮-এর নির্বাচনে তারা কিন্তু অর্ধেক ভোট পায়নি। ৪৮.২ শতাংশ ভোট পেয়েছে, এটা প্রতিষ্ঠিত। আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় ত্রুটিটা হচ্ছে যে, ৪৮ শতাংশ ভোট পেয়ে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে যায়। এটা আমাদের এখানে এবং ভারতেও তাই। ভারতে দেখা গেছে, কংগ্রেস যখন ৪২ শতাংসের বেশি ভোট পেত, তখন তারা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যেত। এখন এটা একটা ত্রুটি যেটা ভারতের সমস্যা নয়, কিন্তু আমাদের এখানে সমস্যা। ভারতের তেমন ক্ষতি হয় নাই, কিন্তু আমাদের ক্ষতি হয়েছে । এরপর ইন্ডিয়ায় যেটা হয়, একতরফাভাবে কিছু হয় না। বিরোধী শক্তিগুলোকে সঙ্গে নিয়ে হয়। যেহেতু অনেক প্রদেশ আছে অনেক প্রদেশে বিরোধী দল ক্ষমতায় থাকে। এখনো কিছু রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতায় আছে, আমাদের এখানে সেই সুযোগ নেই। ৪৮ থেকে ৫০ শতাংশ ভোট হলেই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া যায়। এটা একটা ক্ষতিকর দিক, কাজেই বিশাল বিজয় যেটাকে আমরা দেখি, সেটাতে কিন্তু মানুষের অর্ধেক সমর্থন থাকে না। ২০১৮ সালে যে নির্বাচন হয়েছে, ওটি হয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এরকম নির্বাচন যতদিন চলতে থাকবে, ততদিন তার গ্রহণযোগ্যতা কম থাকবে। যখন গ্রহণযোগ্যতা কম থাকে, তখনই কিন্তু বিদেশি শক্তি সুযোগ পায়। ইন্টারফেয়ার বা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায়, ভারত বলুন বা চীন বলুন। ভারত তো ২০১৪ সালে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে।

বাংলা আউটলুক: ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও সেনাবাহিনীর সাথে সমঝোতায় হয়েছিল?
তৌহিদ হোসেন : আমি তখন পররাষ্ট্রসচিব। পররাষ্ট্রসচিব তো সব জানতে পারে না। ভেতরে কী হয়েছিল আমি জানি না। তবে এটুকু আমি বুঝতে পারি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রকৃত ক্ষমতা সেনাবাহিনীর কয়েকজনের হাতে ছিল, আমাদের চিফ উপদেষ্টার হাতেও ছিল না। সেনাবাহিনীর কয়েকজন তারা পেছনে কলকাঠি নেড়েছে। তারা চেয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ জিতুক। কিন্তু আওয়ামী লীগ এমনিতেও জেতার কথা। কারণ আমাদের জনসাধারণ যখন ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়, অবশ্যই আগে যে ক্ষমতায় ছিল তাকে ভোট দেয় না। তাদের (ক্ষমতায় যারা থাকে) নির্দিষ্ট যে ৩০ শতাংশ ভোট সেটা পায়। এমনিতেই বিএনপি হারতে ওই নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ জিতত।  কিন্তু কিছু সমর্থন, পদক্ষেপের কারণে; কিছু চাপ, কিছু সুবিধার কারণে আওয়ামী লীগ হয়তো আমি যেটা জাস্ট আনুমানিক সংখ্যা বলছি,  হয়তো তারা ১৮০ আসন পেত। সে জায়গায় পেয়ে গেছে অনেক বেশি। তবে রিগিং বা কারচুপি  হয় নাই। এটা হয়েছিল বলে তখনও কেউ অভিযোগ করেছিল। একটা টার্ম (কথা) আছে আমাদের এখানে, দৌড়ের ওপর রাখা। যেহেতু নিরাপত্তা সংস্থাগুলো চায় নাই বিএনপি জিতুক; বিএনপি জিতবে না তারা জানত, তারপরও ঝুঁকি নেয়নি। বিএনপি’র প্রচুর নেতাকর্মীকে তারা দৌড়ের ওপর রেখেছিল। যে কারণে বিএনপির প্রতিবন্ধকতায় পড়েছিল। মানুষ কিন্তু ভোট দিতে গিয়েছিল। তাদের কোনো চাপ দেওয়া হয় নাই, তোমরা নৌকায় দাও বা তোমরা ধানের শীষে দাও।

বাংলা আউটলুক: ভারতের সাথে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা চুক্তিগুলো কীভাবে দেখেন?
তৌহিদ হোসেন : পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাথে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম (বিনিময় কর্মসূচি) আছে। এগুলো তেমন কোনো বিষয় না। এটা সাধারণ একটা ব্যাপার, আমাদের এখানে আমেরিকাও এনডিসি করতে, স্টাফ কলেজ করতে আসে (জাতীয় প্রতিরক্ষা কলেজ বা ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ)। আমাদের ছেলেরা ওখানে যায় এনডিসিতে। আমি যখন এনডিসি করছিলাম, তখন আমরা সংখ্যায় খুব ছোট ছিলাম, ১৮ জন। এখন কলেজ অনেক বড়, আফ্রিকার দেশ থেকে আসে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে ইন্ডিয়া থেকে আসে বড় সংখ্যায়। ইন্ডিয়ার ছেলেরা আমাদের এখানে আসে, আমাদের ছেলেরা ইন্ডিয়ায় যায়। ‘৮৮ তে আমি দিল্লি এনডিসিতে ছিলাম। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও ভারতে এনডিসি করতে গিয়েছিলেন। আমাদের তখন কোনো এনডিসি ছিল না। এনডিসি হওয়ার পরও কিন্ত বিনিময় কার্যক্রম চালু আছে। পাকিস্তানের সাথেও আমাদের এনডিসি কার্যক্রম ছিল। ট্রেনিং ইনস্টিটিউটগুলোর মধ্যে এক্সচেইঞ্জ অপারেশন (বিনিময় কর্মসূচি) খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সামরিক কেনাকাটার বিষয়টা। কী রকম মানের জিনিস আমরা কিনছি। কারণ আমরা দেখছি, ভারত নিজেও কিন্তু আর্মস বাইরে থেকে আনে। একই জিনিস তারা তৈরিও করে হয়তো, কিন্তু মানসম্মত না দেখে তারা বাইরে থেকে আনে। আমরা সেনাবাহিনীর জন্য যেটা আনি ডলার দিয়ে, সেটা যেন মানসম্মত হয়। সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে পারে, সেটা তো আমাদেরই দেখতে হবে।

বাংলা আউটলুক: জাতিসংঘ সনদের ২(৪) ধারায় বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সকল সদস্য-রাষ্ট্র আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন থেকে এবং জাতিসংঘের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন কোনো উপায় গ্রহণ করা থেকে নিবৃত্ত থাকবে’। ভারত এ নীতি লঙ্ঘন করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে কিনা?

তৌহিদ হোসেন : জাতিসংঘ পুরোপুরি একটি ঠুটো জগন্নাথ, জাতিসংঘের আসলে ক্ষমতা নেই কিছু করার। কারণ পৃথিবীতে যে পাঁচটি দেশের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা আছে, তারা কখনো এক হয় না। তাদের ভেতর ভিশন আছে আলাদা। বৈশ্বিক পর্যায়ে তো তারা আলাদা, অন্যরকম।  চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এভাবে যদি আপনি দেখেন তাহলে দেখবেন যে এই সংঘাত যতদিন থাকবে… চিরদিন থাকবে। কারণ, সবার স্বার্থ কোনোদিন এক হবে না। কাজেই জাতিসংঘ তেমন কিছু করতে পারবে না কোনোদিন। আরেকটা বিষয় হলো, বিভিন্ন ধরনের টানাপোড়েন আছে। জাতিসংঘ বলবে যে, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। কেউ কি বলছে যে তারা হস্তক্ষেপ করছে। ভারত কি বলেছে যে তারা  হস্তক্ষেপ করেছে, আমরা কি বলেছি? বলিনি। ইউএন তো সরকারের কথা শোনে। সরকার যদি অভিযোগ করত যে আমাদের এখানে হস্তক্ষেপ  করছে তারা, হয়তো তখন এটা নিয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা করতে পারত। (তবে) এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারত না চাপ প্রয়োগ করার মতো, তাদের (জাতিসংঘ) সেই ক্ষমতা নেই। আমাদের এখান থেকে যে বিরোধী দলে থাকে, তারা বিভিন্ন জায়গায় (বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংস্থায়) চিঠিপত্র পাঠায়। আওয়ামী লীগ করতো এটা, বিএনপিও করে, আবার যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ ঠিক এটাই করবে।
আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমাদের কোনো স্বার্থের বিষয়ে আমাদের রাজনীতিকরা একমত হতে পারে না। আমাদের যে কমন স্বার্থ আছে, সে বিষয়ে তারা একমত হতে পারে না। এ সমস্যা চিরদিনই আছে। মালদ্বীপের মতো দেশে সরকারের অধীনে ফ্রি-ফেয়ার (অবাধ-সুষ্ঠু) নির্বাচন হয়, সরকার হেরে যায়। ভারতের কথা বাদই দিলাম। ভারতে অনেক দিনের ব্যবস্থা আছে। সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে এবং তারা হেরে গেছে। আমাদের এখানে আগেও কোনোদিন হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।

বাংলা আউটলুক: অনুচ্ছেদ ১৪৫(ক) অনুযায়ী বৈদেশিক চুক্তি জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সংসদের গোপন বৈঠকে পাস করা যায়, কীভাবে দেখেন? রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থে কোন গোপন চুক্তি করে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকিতে ফেলতে পারে কিনা?
তৌহিদ হোসেন : এটা কখনো এভাবে করা হয়েছে কিনা জানি না। যদি হয়েও থাকে আমার জানার মধ্যে নেই। কাজেই এটা নিয়ে জল্পনার কিছু নেই। এটা ঠিক যে রাষ্ট্রের স্বার্থে, দেশের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কখনো কখনো গোপন চুক্তি হতে পারে না তা নয়। তবে একটা জিনিস আমাদের মনে রাখতে হবে, যতই বলা হোক না কেন ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়- আসলে কোটারি স্বার্থ দেশের স্বার্থের উপরে চলে যায় সব সময়। অন্তত অনুন্নত, দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও অনুন্নত প্রতিষ্ঠান যেখানে আছে। এখানে আমি নিশ্চিত যে, যে সরকারই ক্ষমতা থাকুক না কেন, তারা তাদের ক্ষমতায় থাকাকে প্রাধান্য দেবে বেশি, এটা আমি গত ৪০ বছরে আমার  অভিজ্ঞতা থেকে দেখছি। আজকের যে সংকট তৈরি হয়েছে সেটা শুরু হয়েছিল কিন্তু জজদের বয়স বাড়ানো নিয়ে। ৬৫ থেকে ৬৭ করা নিয়ে। এটা নিয়ে কিন্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, যেটা করেছিল বিএনপি। আবার চিফ জাস্টিসের (প্রধান বিচারপতি) এক রায়ের ভিত্তিতেই কিন্তু সমস্যা হয়েছে। বিচারপতি খায়রুল হক করে দিয়ে গেছেন। উনারা সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইন বিশেষজ্ঞ। বিভাজিত রায় ছিল; অর্থাৎ বলা যায় খায়রুল হক সাহেব একা করেছেন। কারণ ছয়জন তো বিভাজিত তিন-তিনে, এটা তো আমরা জানতে পেরেছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা উচিত কি না, মতবিরোধ ছিল বিচারকদের মধ্যে তিন-তিন। জাস্টিস না সংবিধানে জাস্টিস শব্দ নেই। ছয়জন বিচারক কিন্তু ভাগ হয়ে গেছিল তিন-তিন সমানে। কাস্টিং ভোট হয়েছে কিন্তু প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক সাহেবের। খায়রুল হক সাহেব যে দেশের কত বড় ক্ষতিটা করে গেছেন, আরো পরে হয়তো এটার মূল্যায়ণ হবে। সংবিধান বলুন আর আইন বলুন মানুষের জন্য। উনি বলতেন যে, একটা গণভোট হোক।

বাংলা আউটলুক: এ নির্বাচনে ভারতের প্রার্থী হিসেবে একটা অভিযোগ উঠেছে। একজন প্রার্থীর ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। তিনি নিজে বলেছেন ভারতের প্রার্থী, শেখ হাসিনার প্রার্থী।
তৌহিদ হোসেন : দেখুন ৪০ জনের নমিনেশন ভারত দিয়েছে সেটার কোনো প্রমাণ নেই আমাদের কাছে। প্রমাণ একজন যে নিজেকে ভারতের নমিনি বলেছে। এটা হচ্ছে প্রমাণ, তাও সে কি মিথ্যা কথা বলেছে কি না; আমরা জানি না। জল্পনা চলছে, ৪০ জন নমিনি দিয়েছে। এটা নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন নিয়োগ ও প্রার্থিতায় ভারত হস্তক্ষেপ করে। কাজেই যদি তাদের সুযোগ দেওয়া হয়, তারা কিছু সমর্থন করতে পারে। মার্কিন কংগ্রেসের যে নির্বাচন, বাংলাদেশের কেউ ইচ্ছে করলে তাকে সমর্থন করতে পারে, সাপোর্ট দিতে পারে, টাকা দিতে পারে, দেওয়া সম্ভব। আইনগতভাবেই এটা সম্ভব আমেরিকাতে। আমাদের এ অঞ্চলে আইনগতভাবে সম্ভব না। আমরা তো কিছু নিদর্শন পাই, প্রণব মুখার্জির যে বইটা বেরিয়েছে (প্রণব মুখার্জির লেখা বই ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস’)। কীভাবে যে ভারত সমর্থন করে তার কিছু নিদর্শন সেখানে আছে।

বাংলা আউটলুক: অনুচ্ছেদ ২৫ অনুযায়ী বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের পক্ষে দাঁড়ানো আমাদের উচিৎ। কিন্তু ফিলিস্তিন – ইসরায়েল ইস্যুতে সরকার পাসপোর্ট থেকে ইজরাইল ব্যতিত শব্দটি উঠিয়ে দিয়েছে, কেন?
তৌহিদ হোসেন : এটা আমার মনে হয় পশ্চিমের দিক থেকেও একধরনের চাপ ছিল। একদম ইসরায়েলকে আলাদাভাবে নির্দিষ্ট করে লেখা থাকত আমাদের পাসপোর্টে। পৃথিবীর অনেক দেশ প্যালেস্টাইনকে সমর্থন করে, ইসরায়েলের দখলদারিত্ব পছন্দ করে না; তাদের পাসপোর্টেও এটা লেখা নাই। সে হিসেবে এটা তুলে দিয়েছে, কী কারণে দিয়েছে সেটা বলা কঠিন। পশ্চিমকে খুশি করার ইচ্ছা থাকতে পারে। আবার ইসরায়েল থেকে কেনাকাটার একটা ব্যাপার তো ছিল। সরকার স্বীকার করে নাই, কিন্তু বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গিয়েছে আড়িপাতার যন্ত্রপাতি ইসরায়েল থেকে আসছে। ইসরায়েলের প্রতি আমাদের যে বিরোধিতা, সেটা মূলত ফিলিস্তিনের জন্য। না হলে ইসরায়েলের সাথে আমাদের কোনো শত্রুতা তো নাই। দূর্ভাগ্যবশত ফিলিস্তিনরাও আরব, আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করছে। আমরা তো সম্পর্ক স্থাপন করছি না। যদিও এটা তুলে দেওয়ায় (পাসপোর্ট থেকে) একটা নিদর্শন দেখা যাচ্ছে সম্পর্ক স্থাপনের। ইসরায়েল বিরোধী নীতির কিছুটা শিথিলতা দেখা যাচ্ছে। আমাদের সমর্থন ফিলিস্তিনের যে খুব লাভ আছে তা নয়। পৃথিবীর অনেক দেশ ফিলিস্তিনকে সমর্থন করছে, তাতে কী লাভ হচ্ছে? ইসরায়েল যা ইচ্ছে তাই করছে। আমাদের একটা নৈতিক সমর্থন রয়ে গেছে, ফিলিস্তিনের প্রতি এবং ইসরায়েলকে আমরা এ কারণেই স্বীকৃতি দিই না। কালকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে পরশু আমরা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেব। ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করব। বিষয়টা এরকমই আসলে। ধরুন সৌদি আরব সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ইসরায়েলের সাথে, আমাদের না করার তো কোনো কারণ থাকত না। সৌদি আরব সেদিকে আগাচ্ছে। হামাসের সাথে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে সেটা যদি না হতো, তাহলে সৌদি আরব আরো অনেক কাছাকাছি চলে যেত ইসরায়েলের। ইতিমধ্যে বাহরাইন, মরক্কো, কাতার, সুদান, সবাই ইসরায়েলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখছে।

বাংলা আউটলুক: বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থানের কারনে স্থিতিশীলতার উপায় কি?
তৌহিদ হোসেন : আমি মনে করি যে উপায়ে একমাত্র হয়েছে এখানে অভ্যন্তরীণভাবে, একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহাল রাখা। যেখানে আমাদের জাতীয় স্বার্থ জড়িত, সেই বিষয়গুলোতে এক ধরনের ঐকমত্যে পৌঁছা। সব বিষয়ে একমত হবে তা নয়, আমি এক ধরনের ঐকমত্য চাচ্ছি। আমি আশাবাদী না, আমাদের রাজনীতিবিদদের চরিত্রের মধ্যে সেটা নেই।

বাংলা আউটলুক