বাংলাদেশের এমপি কেন কলকাতায় খুন হন

বাংলাদেশের এমপি কেন কলকাতায় খুন হন

বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য কলকাতায় খুন হলেন। আর খুনের মূল হোতা হিসেবে যাঁর নাম এসেছে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশি এবং ওই সংসদ সদস্যের বন্ধু।

আমাদের একজন আইনপ্রণেতা এই প্রথম দেশের বাইরে হত্যার শিকার হলেন। এর আগে একাদশ সংসদের লক্ষ্মীপুর-২ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলামকে কুয়েতের আদালত চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন অর্থ ও মানব পাচারের মামলায়। তিনি এখনো সেই দেশের জেলে আছেন। এই দুই ঘটনা রাজনীতির সঙ্গে অপরাধজগতের সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দেয়।

১৩ মে ভারতের কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম নৃশংসভাবে খুন হন। ঘটনাটি খুবই নির্মম ও বেদনাদায়ক। ১২ মে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন চিকিৎসার উদ্দেশ্যে।

গোয়েন্দা সূত্রের খবরে বলা হয়, আনোয়ারুল আজীমকে খুনের জন্য কলকাতার নিউ টাউন এলাকায় বাসা ভাড়া করেন বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আখতারুজ্জামান। আনোয়ারুলকে কৌশলে সেই বাসায় নিয়ে গিয়ে ভাড়াটে লোকদের দিয়ে খুন করা হয়। তাঁদের মধ্যে আমানুল্লাহ (প্রকৃত নাম শিমুল ভূঁইয়া) একসময়কার চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) অন্যতম নেতা। যাঁরা আগে সমাজবিপ্লবের জন্য শ্রেণিশত্রু খতমের রাজনীতি করতেন, তাঁরা এখন ভাড়া খাটছেন!

বাংলাদেশে রাজনীতির সঙ্গে অপরাধজগতের সম্পর্ক বেশ পুরোনো। একসময় বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কলকাতায় আস্তানা গেড়েছিলেন। এখন তাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন এবং সেসব স্থান থেকে দেশের অপরাধজগৎকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। ১৯ মে প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘বিদেশে থেকেই ঢাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তাঁরা।’

ঝিনাইদহ–৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের রাজনৈতিক উত্থান দলবদল ও ক্ষমতার বলয়ের মাধ্যমে। ১৯৮৮ সালে তৎকালীন বিএনপি নেতা ও পরে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবদুল মান্নানের হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন তিনি। ১৯৯২ সালে কালীগঞ্জ পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন বিএনপি নেতা হিসেবে।

১৯৯৫ সালে আবদুল মান্নান বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তখন আনোয়ারুলও তাঁকে অনুসরণ করেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে আনোয়ারুল ভারতে চলে যান।

তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি এবং চরমপন্থীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে ৯টির বেশি মামলা ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে ইন্টারপোল তাঁর নামে রেড অ্যালার্টও জারি করেছিল।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আনোয়ারুল আজীম ‘নির্বাসন’ থেকে দেশে ফিরে আসেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়ে পাননি। মনোনয়ন পেয়েছিলেন আবদুল মান্নান। অন্যদিকে ২০১৪ সালে আজীম মনোনয়ন পেলে আবদুল মান্নান বঞ্চিত হন। তখন থেকেই গুরু-শিষ্যের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। আবদুল মান্নান মারা যাওয়ার পর কালীগঞ্জ ও ঝিনাইদহ সদরের একাংশে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আজীমই হয়ে ওঠেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা।

তিনি ২০১৪ সালের দশম, ২০১৮ সালের একাদশ ও ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঝিনাইদহ-৪ আসন থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই সময়ে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্তের মালিক হন।

শুক্রবার কথা হয় ঝিনাইদহে প্রথম আলোর প্রতিনিধি আজাদ রহমানের সঙ্গে। আনোয়ারুল সম্পর্কে স্থানীয় জনগণের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, আজীম জনপ্রতিনিধি হিসেবে এলাকায় জনপ্রিয় ছিলেন। সবাইকে বিপদে–আপদে সহযোগিতা করতেন। অনেক সময় মোটরসাইকেলে করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াতেন। আবার তাঁর রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা ও সীমান্তকেন্দ্রিক ব্যবসা–বাণিজ্য নিয়ে দুর্নামও ছিল। আনোয়ারুল আজীম রাজনীতিতে আসার আগে ভিসিআর-ভিসিডির ব্যবসা করতেন। তিনি জাপান থেকে ভিসিআর ও ভিসিডি আমদানি করে ভারতে বিক্রি করতেন। ভারতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এভাবে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

জিজ্ঞেস করি, আখতারুজ্জামানের সঙ্গে এমপির সম্পর্ক কেমন ছিল? আজাদ বললেন, তাঁরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। দুজনই ভালো ফুটবল খেলতেন। আজীম পরে রাজনীতিকে সক্রিয় হন। আর আখতারুজ্জামান ডিভি ভিসায় যুক্তরাষ্ট্র চলে যান।

গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আখতারুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী হলেও তাঁর প্রধান ব্যবসা ছিল সোনা চোরাচালান। আবুধাবি থেকে সোনা নিয়ে এসে তিনি ভারতে বিক্রি করতেন, এই কাজে তাঁকে সহায়তা করেন আনোয়ারুল আজীম। সম্প্রতি কয়েকটি চালান এমপি গায়েব করে দিয়েছেন, যার দাম হবে ২০০ কোটি টাকা। এই টাকার জন্যই আখতারুজ্জামান পরিকল্পিতভাবে এমপিকে খুন করেছেন। অন্য একটি সূত্র বলেছে, বন্ধু শাহীনের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন এমপি আজীম। ওই টাকা গায়েব করে দিতে হত্যার পরিকল্পনা হতে পারে।

আনোয়ারুল আজীম ছিলেন একজন আইনপ্রণেতা। তাঁর নৃশংস হত্যার বিচার হতে হবে। সেই সঙ্গে রাজনীতির সঙ্গে অপরাধজগতের সম্পর্কটিও উন্মোচিত হওয়া প্রয়োজন। সেটি তখনই সম্ভব হবে, যখন মূল অভিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আখতারুজ্জামানকে আইনের আওতায় আনা যাবে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো দ্রুতই খুনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করেছে। ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও দুই আসামিকে পাকড়াও করেছে। তাদের একজন বাংলাদেশের নাগরিক। ভারতীয় নাগরিক একজন গাড়িচালক।

আনোয়ারুল আজীমের খুনের ঘটনাটি আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেক দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আমরা দেখলাম, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো নামে পাসপোর্ট করতে পারেন। ভিসা বের করতে পারেন। খুনিরা খুন করার উদ্দেশ্যে যেকোনো সময় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বিদেশে যেতে পারেন, আবার কার্য সম্পন্ন করে নির্বিঘ্নে দেশে ফিরেও আসতে পারেন।

তাহলে এত নিরাপত্তাব্যূহ, এত কড়াকড়ি, সেটা কি শুধু সাধারণ মানুষের জন্য? ভারতের ভিসার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। মেডিকেল ভিসার জন্যও মানুষকে দিনের পর দিন ধরনা দিতে হয়। অথচ খুনিরা অনায়াসে ভিসা পেয়ে গেল। খুনিদের কেউ কেউ গেছে ভিসা–পাসপোর্ট ছাড়াই। কী করে সম্ভব হলো?

মনে আছে, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার পর মূল আসামি নূর হোসেনও বিনা পাসপোর্ট–ভিসায় সীমান্ত পার হয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের আগ্রহে পরে তাঁকে পুশব্যাকও করা হয়েছিল।

বলার অপেক্ষা রাখে না, আনোয়ারুল আজীমের খুনের ঘটনায় বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ঘটনার পর হয়তো ভারতের পুলিশ প্রশাসন বাংলাদেশি নাগরিকদের আরও বেশি সন্দহের চোখে দেখবে। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যাওয়া বাংলাদেশিদের অনেকে বাড়ি ভাড়া দিতে চাইবেন না।

অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের রাজনীতি যেমন বাহাসে লিপ্ত হয়, আনোয়ারুল আজীমের হত্যার ঘটনায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম প্রশ্ন তুললেন, বন্ধুদেশ কেন আওয়ামী লীগের এমপির নিরাপত্তা দিতে পারল না? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পাল্টা প্রশ্ন করলেন, বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদকে কেন ভারত আদর–যত্নে রেখেছে এত দিন?

দুই পক্ষের বক্তব্যেই ভ্রান্তি আছে। সালাহউদ্দিন আহমদ ও আনোয়ারুল আজীম ভিন্ন দল করতে পারেন, তাঁরা আমাদের দেশের রাজনীতিক ও আইনপ্রণেতা। তাঁদের কেউ বিদেশে গিয়ে অপদস্থ হলে কিংবা খুন হলে সেটা বাংলাদেশের জন্য গৌরবের নয়; লজ্জার।

আশা করি, রাজনীতিকেরা দলের স্বার্থে দেশের স্বার্থ বিসর্জন দেবেন না।

prothom alo