বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বাড়তে পারে রাশিয়ার অংশগ্রহণ

বাংলাদেশে ২০২৩ পঞ্জিকাবর্ষে ২৭ লাখ টন গম রফতানি করেছিল রাশিয়া। বর্তমানে দেশটি থেকে আরো গম আমদানির পরিকল্পনা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে মেরিটাইম গেটওয়ে। বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ইউরেশীয় ইউনিয়নের (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর জোট) বাইরের দেশগুলোর মধ্যে রুশ গমের তৃতীয় শীর্ষ রফতানি গন্তব্য হলো বাংলাদেশ। এছাড়া বাংলাদেশে দেশটি থেকে সার আমদানিও বাড়ছে বলে দাবি করেছেন রুশ কূটনীতিকরা।

রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির প্রয়াস নিয়েছিল বাংলাদেশ। যদিও দেশের পরিশোধনাগারগুলোয় রুশ জ্বালানি তেল পরিশোধনের সক্ষমতা না থাকায় এখন তা সরাসরি আমদানি করা যাচ্ছে না। রুশ পর্যবেক্ষকদের দাবি, বাংলাদেশ এখন এ জ্বালানি তেল আমদানি করছে ভারত বা পশ্চিম এশিয়া থেকে পরিশোধন করে। এছাড়া দেশে গ্যাস খাতের অনুসন্ধান কার্যক্রমে রুশ কোম্পানি গ্যাজপ্রম যুক্ত রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে।

রুশ অর্থায়নে নির্মীয়মাণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ এখন প্রায় শেষের পথে। সবকিছু ঠিক থাকলে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের বিদ্যুৎ যুক্ত হতে পারে চলতি বছরেই। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের প্রায় ৮৫ শতাংশ কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেম সুইফট থেকে বাদ পড়ে যায় রাশিয়া। দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে নানা ধরনের অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ করে পশ্চিমা বিশ্ব। পেমেন্ট সমস্যার আশু সমাধান না থাকায় রাশিয়ার সঙ্গে অন্যান্য দেশের বাণিজ্য অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় একটি সমাধান মেলে মস্কোর মিত্র দেশ চীনের কাছ থেকে। রাশিয়ার সঙ্গে অন্যান্য দেশের বাণিজ্য চালানোর বড় একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে চীনা পেমেন্ট ব্যবস্থা ক্রস বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম (সিআইপিএস)।

বাংলাদেশে পেমেন্ট ব্যবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার রিয়েল টাইম গ্রস সিস্টেম বা আরটিজিএসভিত্তিক অটোমেটেড ক্লিয়ারিংয়ে চীনা মুদ্রা ইউয়ান যুক্ত হয় গত মাসে। এতে বাংলাদেশের পক্ষে চীনের ক্রস বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেমে যুক্ত হওয়া আরো সহজ হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন রুশ পর্যবেক্ষক ও বাংলাদেশী বিশ্লেষকরা। বিষয়টি এখানকার অর্থনীতিতে রাশিয়ার অংশগ্রহণ বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে বলে অভিমত তাদের।

এ বিষয়ে নয়াদিল্লিভিত্তিক থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান ওআরএফ ফাউন্ডেশনের গত ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক বিশেষজ্ঞ মতামতে রাশান একাডেমি অব সায়েন্সেসের ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো অ্যালেক্সেই জাখারভ লিখেছেন, ‘‌বেইজিংয়ের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার অর্থনৈতিক সংযুক্তি ধরে রাখা অসম্ভব ছিল। কৃষি হোক বা জ্বালানি, বর্তমানে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার লেনদেনের বড় একটি অংশ সম্পাদিত হয় চীনের সিআইপিএস ব্যবস্থার মাধ্যমে। চীনের আর্থিক অবকাঠামোর ব্যবহার বৃদ্ধি এখন এ অঞ্চলের রুশ অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলোর লাইফলাইন হয়ে উঠেছে।’  বিষয়টি নিয়ে জানতে ঢাকার রুশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাদের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের বিষয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি গত ৭ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‌দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হলো বাংলাদেশ। এমনকি মহামারীকালেও তা বাধাগ্রস্ত হয়নি। ২০২১ সালে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের আকার দাঁড়িয়েছিল ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২৯৭ কোটি ডলারে। ২০২২ সালে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর একতরফা বিধিনিষেধ আরোপ করে। উৎপাদন ও লজিস্টিকস চেইনে ব্যাঘাত ঘটার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশসহ বিদেশী অংশীদারদের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে বাণিজ্যের আকার কমে যায় ৬৪ কোটি ডলার। এবার তা ২০২১ সালের পর্যায়ে ফিরবে বলে প্রত্যাশা করার অনেক কারণ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাশিয়া বাংলাদেশে গম ও সার রফতানি বাড়াচ্ছে। রুশ কোম্পানিগুলো এখন জিটুজির ভিত্তিতে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য ও ৫ লাখ টন পটাশিয়াম ক্লোরাইড রফতানি করতে প্রস্তুত।’

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অংশগ্রহণ বাড়াতে দীর্ঘদিন ধরেই আগ্রহ প্রকাশ করছে রাশিয়া। ২০২২ সালের মে মাসে দেশটি জ্বালানি তেল বিক্রির জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসে। সে সময় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) বিষয়টি নিয়ে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। এর সম্ভাব্যতা পর্যালোচনায় সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও নির্দেশনা দেয়া হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে সেবার রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের নমুনা এনে বাংলাদেশে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের পরিশোধনাগারে রুশ জ্বালানি তেল পরিশোধন সম্ভব নয় বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে ইআরএলের টেকনিক্যাল কমিটি। পরে বিষয়টি রুশ জ্বালানি তেল সংস্থা রসনেফটকে জানিয়ে দেয়া হয়।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে বাংলাদেশকে ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। প্রকল্পটির সিংহভাগ কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ৮৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

দেশটির কূটনীতিকদের দাবি, রুশ বিনিয়োগকারীরা এখন বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করতেও আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ডিসেম্বরের ওই অনুষ্ঠানে রুশ রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘‌২০২২ সালের পর থেকে বহু আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড রাশিয়া ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ অবস্থায় রুশ ব্যবসায়ী মহলগুলো এখন বাংলাদেশসহ সরবরাহের নতুন নতুন উৎস অনুসন্ধান করছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগ কয়েকশ কোটি ডলারে পৌঁছতে পারে।’

আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি আরো বলেন, ‘‌বাংলাদেশের সঙ্গে আইসিটি, ফার্মাসিউটিক্যালস, মহাকাশ প্রযুক্তি, ভূতাত্ত্বিক জরিপ, মেরিটাইম, রেলওয়ে ও আকাশ পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে যৌথ প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার কোম্পানিগুলো প্রস্তুত।’

রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা বিধিনিষেধের প্রেক্ষাপটে বিকল্প ব্যবস্থা চালুর কথা বলছেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য পরিচালনাকারী ব্যবসায়ীরা। কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্ট স্টেটস-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (সিআইএস-বিসিসিআই) অনারারি অ্যাডভাইজর মাহবুব ইসলাম রুনু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্ভাবনা ব্যাপক। সে সম্ভাবনা বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন ধরে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। স্যাংশনের ফলে রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি ব্যবসা-বাণিজ্যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে আমরা চাই একটা বিকল্প ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে চীন বা ভারত যেকোনো দেশ সহযোগী হতে পারে। সম্প্রতি মস্কোয় আমি বাংলাদেশে শাখা স্থাপনের মাধ্যমে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি করার বিষয়ে চীনা ও ভারতীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গেও আলাপ করেছি।’

ব্যাংকাররা বলছেন, চীনা পেমেন্ট ব্যবস্থায় যুক্ত হয়ে কতটা লাভবান হওয়া যাবে তা নির্ভর করছে বাংলাদেশ সেখানে রফতানি বাড়ানোর কতটা সুযোগ তৈরি করতে পারছে তার ওপর। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের ব্যবসা এখনো অব্যাহত আছে। আমাদের লেনদেন হচ্ছে পোল্যান্ড হয়ে। তাছাড়া ব্রিকস জোট এখন বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। জোটটি নিজস্ব মুদ্রা চালুর বিষয়ে অনেক দূর এগিয়েছে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোও এখন নিজেদের মুদ্রায় লেনদেনের বিষয়ে একমত হচ্ছে। সুইফটের বিকল্প মাধ্যম হিসেবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে সিআইপিএস। তবে আরটিজিএসে ইউয়ানের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এখান থেকে বাংলাদেশ কতটা সুবিধা নিতে পারবে, তা নির্ভর করবে বাংলাদেশের এ মুদ্রানির্ভর রফতানি ভলিউমের ওপর।’

BONIK BARTA