বহু সেনা কর্মকর্তা নিহত : ৭৫০ নিখোঁজ

‘আল-আকসা ফ্লাড’ অভিযানে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের হাতে এ-পর্যন্ত অন্তত ৩০০ ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে অনেক সেনাসদস্য রয়েছেন। রোববার নিহত ২৬ সেনা কর্মকর্তার নাম প্রকাশ করেছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষাবাহিনী।

নিহতদের মধ্যে কর্নেল রয়েছেন একজন; লেফটেন্যান্ট কর্নেল একজন; মেজর একজন; ক্যাপ্টেন দুইজন; লেফটেন্যান্ট পাঁচজন; সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট দুইজন; সার্জেন্ট চারজন এবং স্টাফ সার্জেন্ট চারজন। ইসরায়েলি পুলিশ জানিয়েছে, যুদ্ধের প্রথম দিন তাদের ৩০ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। নিহতের সংখ্যা অনেক বাড়তে পারে। জেরুজালেম পোস্ট জানিয়েছে, শনিবার হামাসের অভিযান শুরুর পর থেকে প্রায় ৭৫০ ইসরায়েলি নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা স্পষ্ট নয়।

ফিলিস্তিনি সূত্র জানিয়েছে, গাজা অঞ্চলের জন্য নিযুক্ত সাবেক প্রধান ইসরায়েলি সেনা-কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নিমরোদ আলুনি হামাসের হাতে বন্দি হয়েছেন। একটি ছবিতে দেখা গেছে, নিমরোদ আলুনি-কে মাটির ওপর শোয়ানো অবস্থায় টেনে নিয়ে যাচ্ছেন হামাসের যোদ্ধারা। সামরিক-বেসামরিক সব বন্দিকে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

অভিযানে নিহত ৩০০ জনের মধ্যে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জনাথন স্টেইনবার্গ-ও রয়েছেন। স্টেইনবার্গ ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর প্রধান পদাতিক শাখা নাহাল ব্রিগেডের দায়িত্বে ছিলেন।

অভিযানে আহত হয়েছেন দুই হাজারেরও বেশি ইসরায়েলি। ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আহতদের মধ্যে প্রায় ৩৫০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাছাড়া, হামাসের হাতে বন্দি হয়েছেন বিপুল-সংখ্যক ইসরায়েলি। বন্দিদের মধ্যে অনেক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন। হামাস বড় বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে বলে মন্তব্য করেছেন সংগঠনটির নেতা ইসমাইল হানিয়া।

২.
যুদ্ধের প্রথমদিনই ফিলিস্তিনি অন্য প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। এবার হামাসের প্রতি সংহতি জানিয়ে যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়েছে লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহ। হিজবুল্লাহ-র অংশগ্রহণে যুদ্ধ আরও একটি ফ্রন্টে বিস্তৃত হলো। এতে ইসরায়েলের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ আরও প্রকট হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অনেক বিশ্লেষক। এরমধ্যেই গাজা থেকে ড্রোন হামলার খবর দিয়েছে গণমাধ্যমগুলো।
ফিলিস্তিনিদের ওপর সাম্প্রতিক হত্যাযজ্ঞ ও নৃশংসতার প্রতিবাদে এবং মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল-আকসা মসজিদে বারবার ইহুদিবাদীদের অবমাননার প্রতিশোধ নিতে শনিবার সকালে হামাসের যোদ্ধারা স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথে গাজা থেকে ইসরায়েলের অনেক ভেতরে আকস্মিকভাবে ঢুকে পড়ে।
রোববার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তীব্র লড়াই চলছিল। ইসরায়েলের বেশ কিছু এলাকা দখলে রেখেছেন তারা। রোববার দুপুরে হামাসের সশস্ত্র শাখা আল কাস্সাম ব্রিগেডের যোদ্ধারা ইসরায়েলের ভেতর বেশ কয়েকটি শহরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। টেলিগ্রাম চ্যানেলে আল-কাস্সাম জানিয়েছে, তীব্র লড়াই চলা শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে- ওফাকিম, সদেরোত, ইয়াদ মোরদেচাই, কফার আজ্জা, বিয়িরি এবং কিস্সুফিম।
টাইমস অব ইসরায়েলের খবরে বলা হয়, রোববার লেবানন থেকে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে বিপুল পরিমাণ মর্টার শেল ছুড়েছে হিজবুল্লাহ। এর জবাবে লেবাননে কামান ছুড়েছেন ইসরায়েলি সেনারা। এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহ হামলার কথা স্বীকার করে জানিয়েছে, বিপুল পরিমাণ আর্টিলারি শেল ও গাইডেড মিসাইল ছোড়া হয়েছে। শেবা ফার্ম এলাকার ইসরায়েল অধিকৃত তিনটি সামরিক অবস্থানকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয়। হামলায় ইসরায়েলি অবস্থানগুলো সরাসরি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। লেবানন সীমান্তে গোলা বিনিময়ের পর আপার গালিলি-র বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলেছে ইসরায়েল।

৩.
ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজ জানায়, রোববার গাজা থেকে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর তেকুমায় একটি সন্দেহভাজন ড্রোন ঢুকে পড়ে। এরপর শহরে বিপদ সতর্কতার সাইরেন বাজানো হয়। হামাসের মুখপাত্র গাজি হামাদের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, ইসরায়েলে হামলা পরিচালনায় ইরানের সহায়তা পেয়েছে প্রতিরোধ আন্দোলনটি। হামাস, ইসলামিক জিহাদ এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ-কে প্রধানত ইরান সহায়তা দেয় বলে উল্লেখ করে বিবিসি।
হামাসের রাজনৈতিক শাখার উপপ্রধান সালেহ আল-আরুরি জানিয়েছেন, এই অভিযান আরও তীব্র হবে। ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতা এবং পবিত্র স্থানগুলোর পবিত্রতা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ইসরায়েলি আগ্রাসন চলতে থাকলে হামাসের সামরিক শাখা অলস বসে থাকবে না। আরোরি আলজাজিরাকে বলেন, বন্দি ইসরায়েলিদের মুক্তিপণ হিসেবে ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্ত করা হবে।
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, অবৈধ বসতি স্থাপনকারী এবং দখলদার সেনাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার অধিকার ফিলিস্তিনি জনগণের রয়েছে। শনিবার রামাল্লায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন তিনি।
হামাসের অভিযানকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেছেন, এই কঠিন সময়ে আমরা ইসরায়েলের পাশে আছি। শনিবার এক এক্স বার্তায় মোদি লেখেন, ‘ইসরায়েলে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার খবর শুনে গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছি। নিরীহ ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের জন্য প্রার্থনা করছি। এই সময়ে আমরা ইসরায়েলের প্রতি সংহতি প্রকাশ করছি।
৪.
এদিকে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৩১৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে; এর মধ্যে ২০টি শিশুও রয়েছে। আহত হয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৯৯০ ফিলিস্তিনি। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনিদের গাজা-উপত্যকা ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, হামাসের সব আস্তানা গুঁড়িয়ে ধুলোয় মিশিয়ে গাজাকে মরুদ্বীপে পরিণত করা হবে। এই অবস্থায় গাজায় ইসরায়েলের স্থল হামলার আশঙ্কা বেড়েছে বলে জানিয়েছে আলজাজিরা।
শনিবার হামাসের অভিযানের জবাবে শুরু হওয়া ইসরায়েলি অভিযান ‘সোর্ড অব আয়রন’ রোববারও অব্যাহত ছিল। নির্বিচারে বেসামরিক লোকদের ওপর বোমাহামলা করেছেন তারা। গাজার প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দা গতকাল শনিবার সারারাত অন্ধকারে কাটিয়েছেন। ইসরায়েলি বাহিনী গাজার বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
রোববার আলজাজিরা জানিয়েছে, মধ্য-গাজার একটি ১৪-তলা ভবন গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যেখানে প্রতিরোধ আন্দোলনের অফিস এবং কয়েক ডজন অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। ইসরায়েলি আর্মি রোববার জানিয়েছে, তাদের বিমানবাহিনী হামাসের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানের বাড়িতেও হামলা করেছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর বরাতে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ রোববার জানিয়েছে, কিছু বন্দিকে দক্ষিণ ইসরায়েল থেকে উদ্ধার করেছেন দেশটির সেনারা। দৈনিকটি জানায়, ইসরায়েলি সেনাদের হাতে হামাসের ৪০০ যোদ্ধা নিহত হয়েছেন; অনেককে আটক করা হয়েছে।

৫.
এদিকে, বিশাল শক্তি আর নজরদারি সরঞ্জাম থাকার পরও ইসরায়েলের গোয়েন্দারা কেন হামাসের অভিযানের বিষয়টি টেরই পেলেন না, তা নিয়ে দেশটিতে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছেন, এই অভিযান ছিল তাদের গোয়েন্দাদের ধারণার বাইরে; আগাম কোনো তথ্যই ছিল না তাদের হাতে।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত, বিশে^র বিভিন্ন দেশে দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা তৎপরতায় নিয়োজিত মোসাদ এবং ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সব ধরনের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে ফাঁকি দিয়ে হামাস কীভাবে এতবড় অভিযান শুরু করল, তা নিয়ে সরব হয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, এই ব্যর্থতার মাশুল ইসরায়েলকে বহু বছর ধরে দিতে হবে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা ইসরায়েলিদের বোকা বানানোর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি হস্তগত করেছেন, এই ঘটনা তারই প্রমাণ।

৬.
আরব বিশ্বে হাজার হাজার মানুষ হামাসের অভিযানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে মিছিল করেছে। ইয়েমেন ও ইরাকের জনগণ ফিলিস্তিনিদের অভিযানের পক্ষে অবস্থান ঘোষণা করেছে। দেশটির প্রভাবশালী সংগঠন হাশ্দ আশ-শাবি ও নুজাবা আন্দোলন ফিলিস্তিনি অভিযানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।
সিরিয়ার সরকারও বিবৃতি দিয়ে ইসরায়েল-বিরোধী হামলার প্রশংসা করেছে। কাতার সরকার ফিলিস্তিনের চলমান পরিস্থিতির জন্য দখলদার ইসরায়েলকে দায়ী করেছে। ইরান সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি ফিলিস্তিনিদের অভিযানকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেওয়া হয়। ইরানি পার্লামেন্টের পক্ষ থেকে হামাসের অভিযানে অকুণ্ঠ সমর্থন জানানো হয়েছে। তেহরানে বহু মানুষ উল্লাস প্রকাশ করেছে, মসজিদে মসজিদে দোয়া হয়েছে।
মিসরের রাজধানী কায়রোর আল-আজহার আল-শরিফ মসজিদ এক বিবৃতিতে হামাসের অভিযানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। মসজিদ কর্তৃপক্ষ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বৈতনীতিরও সমালোচনা করেছে।
এই অভিযান শুরু হওয়ার পর সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে কথা বলেছেন। ফয়সাল বলেছেন, তার দেশ নিরস্ত্র বেসামরিক লোকদের ওপর হামলাকে সমর্থন করে না। তিনি সহিংসতা এড়াতে সমন্বিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন।
মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, উত্তেজনা প্রশমনে তারা সৌদি আরব ও জর্ডানের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। দেশটি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির গুরুতর পরিণতি সম্পর্ক সতর্ক করেছে।
জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি অস্থির পরিস্থিতির ব্যাপারে সতর্ক করে বলেছেন, পশ্চিমতীরের কোন্ কোন্ শহর এবং এলাকায় ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েল হামলা করছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, তার আলোকে এটি বিবেচনা করতে হবে।
কুয়েত এই উত্তেজনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গাজায় নির্মম হামলার জন্য ইসরায়েলের নিন্দা জানিয়েছে।
রাশিয়া বলেছে, তারা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন উত্তেজনা বাড়ার পর ইসরায়েল, ফিলিস্তিন এবং আরব দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। সঙ্ঘাত বেড়ে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে চীন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন। পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে- এমন বৈরী কাজ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
হামাসের অভিযানের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে ইউরোপিয়ান কমিশন, ন্যাটো, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, ইতালি, পোল্যান্ড ও স্পেন। এ-নিয়ে রোববার জাতিসংঘ জরুরি বৈঠকে বসার কথা।