বসিয়ে রেখেই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে ৪,২৩২ কোটি টাকা

 

ইসমাইল আলী: দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৯৫১ মেগাওয়াট। আরও ৭২৯ মেগাওয়াটের চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চলতি মাসেই জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। জুন পর্যন্ত আরও যুক্ত হওয়ার কথা দুই হাজার ৭১১ মেগাওয়াট। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াবে ২৯ হাজার ৩৯১ মেগাওয়াট। তবে গত জুলাইয়ে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ১৫ হাজার ১৬৪ মেগাওয়াট। আগামী এপ্রিলে তা ১৬ হাজার ৩৭৮ মেগাওয়াটে উঠতে পারে।

আগামী জুনে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৪৩৬ মেগাওয়াট। অর্থাৎ জুনে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ১৩ হাজার ৯৫৫ মেগাওয়াট বা ৪৭ শতাংশের বেশি বসে থাকবে। আর ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৭৩৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে সর্বোচ্চ। এতে চলতি মাসে বসে থাকবে ১৫ হাজার ৯৪৭ মেগাওয়াট বা প্রায় ৬০ শতাংশ।

এদিকে চলতি অর্থবছর মোট ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে (প্রাক্কলিত) ১৮ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলোর জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) এ চার্জ পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে শুধু শীতের মাসগুলোয় বসে থাকা কেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে চার হাজার ২৩২ কোটি টাকা।

বৈদেশিক দেনাবিষয়ক কর্মজোট বিডব্লিউজিইডি প্রকাশিত ‘বিটার উইন্টার টু বাইট দ্য পাওয়ার সেক্টর অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব উঠে এসেছে। গতকাল প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিদ্যুৎ খাত অতিরিক্ত সক্ষমতার বোঝা নিয়ে ধুঁকছে। জুলাইয়ে অতিরিক্ত সক্ষমতা অলস বসে ছিল ৯ হাজার ৭৪৭ মেগাওয়াট, যা পিক আওয়ারে উৎপাদনের ৬৪ শতাংশ ছিল। নভেম্বরে অলস বসে থাকা সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৩৪৩ মেগাওয়াট, পিক আওয়ারের উৎপাদনের ১০৬ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিসেম্বরে অসল বসে থাকা সক্ষমতা রেকর্ড ১৪৯ শতাংশে উঠবে, যা মার্চে ১৩ হাজার ৫৫৭ মেগাওয়াট বা ৯৩ শতাংশে নেমে আসবে। এমনকি জুনে গরমের সময়ও সক্ষমতার ১৩ হাজার ৯৫৫ মেগাওয়াট বা ৯০ শতাংশ বসে থাকবে। অন্যান্য মাসের মধ্যে জানুয়ারিতেও সক্ষমতা বসে থাকবে ডিসেম্বরের সমান। ফেব্রুয়ারিতে পিক আওয়ারে উৎপাদনের ১২৮ শতাংশের সমান বসে থাকবে। এপ্রিল ও মে মাসে এ হার দাঁড়াবে যথাক্রমে ৭২ ও ৮১ শতাংশ।

পিডিবির ২০২৩ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, স্বাভাবিকভাবে গরমের মাসগুলোর তুলনায় শীতে বিদ্যুতের চাহিদা ২৯ থেকে ৩৪ শতাংশ হ্রাস পায়। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিদ্যুতের ব্যবহার আরও কমিয়ে দেবে। এতে অতিরিক্ত সক্ষমতা বেড়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, পিক আওয়ারে বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়ানো যাচ্ছে না। গত জুলাইয়ে পিক আওয়ারে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ১৬৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। নভেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৬০৮ মেগাওয়াট। চলতি মাসে তা আরও কমে ১০ হাজার ৭৩৩ মেগাওয়াটে নেমে যাবে। জানুয়ারিতে তা মাত্র দুই দশমিক ৭ শতাংশ ও ফেব্রুয়ারিতে ১১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়তে পারে।

উৎপাদন সক্ষমতার ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাইয়ে দেশে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ৩৫৪ গিগাওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব ছিল। নভেম্বরে তা ১৮ হাজার ৬৮৫ গিগাওয়াট ঘণ্টায় উন্নীত হয়েছে। চলতি মাসে এ সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১৮ হাজার ৮৫০ গিগাওয়াট ঘণ্টা। প্রতি মাসে এ সক্ষমতা গড়ে এক দশমিক ১৮ শতাংশ হারে বাড়ছে। এতে বছরে বাড়বে ১৪ দশমিক ১৮ শতাংশ।

যদিও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার সর্বোচ্চ ৫১ দশমিক ১ শতাংশ উৎপাদন হয়েছে গত সেপ্টেম্বরে। আর জুলাইয়ে সক্ষমতার ৪৯ দশমিক ৯ ও আগস্টে ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। অক্টোবরে সক্ষমতার মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ৪৫ দশমিক ১ শতাংশ ও নভেম্বরে ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ। ডিসেম্বরে সক্ষমতার ৩২ দশমিক ৩ ও জানুয়ারিতে সক্ষমতার ৩২ দশমিক ৪ শতাংশ উৎপাদন হতে পারে।

পরের মাসগুলোর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে সক্ষমতার ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ, মার্চে ৩৯ দশমিক ১, এপ্রিলে ৪৭ দশমিক ৬, মে মাসে ৪১ দশমিক ৬ ও জুনে ৪৩ দশমিক ৪ শতাংশ ব্যবহার হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে থাকলেও বা সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার না হলেও ক্যাপাসিটি চার্জ ঠিকই দিতে হয়। বছর শেষে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুতের গড়ে এক টাকা ৮০ পয়সা হারে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়।

বর্তমান সরকার ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত এক লাখ চার হাজার ৯৬২ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করেছে। গত অর্থবছর পিডিবিকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ১৮৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়। এর আগের (২০২১-২২) অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৭০১ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছর ১৩ হাজার ২১ কোটি টাকা ও ২০১৯-২০ অর্থবছর ১০ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরগুলোয় ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১০ হাজার কোটি টাকার কম। ২০০৭-০৮ অর্থবছর এ বাবদ পিডিবিকে পরিশোধ করতে হয়েছিল মাত্র এক হাজার ২৮১ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। গত ১৫ বছরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় চার দশমিক ৪০ গুণ হয়েছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ছিল প্রতি ইউনিট দুই টাকা ৩৩ পয়সা। গত অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ টাকা ১৭ পয়সা। ২০২১-২২ অর্থবছরও যা ছিল আট টাকা ৮৪ পয়সা ও ২০২০-২১ অর্থবছর ছয় টাকা ৬১ পয়সা। এর আগের কয়েক বছর তা পাঁচ থেকে ছয় টাকার মধ্যেই ওঠানামা করেছে।

অপচয়ের এ চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ ডলারের পরিবর্তে স্থানীয় মুদ্রা তথা টাকায় পরিশোধের চুক্তি করা, বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি সংশোধন করে ক্যাপাসিটি চার্জের বিধান বাতিল করে ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ তথা বিদ্যুৎ উৎপাদন নাই মূল্য পরিশোধ নাই ভিত্তিতে চুক্তি করা, পাইপলাইনে থাকা কয়লা, এলএনজিসহ জ্বীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি বাতিল করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়াসহ বেশকিছু সুপারিশ রয়েছে।

শেয়ার বিজ