৮ মার্চ ২০২৩
ডঃ মো আজাবুল হক
২০১৬ থেকে ২০২২ এই ৬ বছরে বৃটেনে ৬ জন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। আভ্যন্তরীণ রাজনীতি, ব্রেক্সিট ব্যার্থতা, দুর্নীতি, অদক্ষতা বিভিন্ন অভিযোগে একেকজন অভিযুক্ত হয়ে হয় বিদায় নিয়েছেন অথবা বিদায় হয়েছেন। প্রতিবারই প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে গোটা মন্ত্রীসভাই বিলুপ্ত হয়। প্রশ্ন হলঃ এই পরিবর্তনে এদেশের ছাত্রদের বা ছাত্র রাজনীতির কি কোন ভূমিকা ছিল? শুধু এই ৬ জনের ক্ষেত্রেই নয় এর আগেও কি সরকার পরিবর্তনে ছাত্রদের কোন হাত ছিল? উন্নত বিশ্বের রাজনৈতিক পরিবর্তনে কি ছাত্ররা আদৌ কোন নিয়ামক বা প্রভাবক হিসাবে কাজ করে? বৃটেনের মত কানাডা, নিউজিল্যান্ড, মালেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার মত রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায়ন অথবা ক্ষমতাচ্যুত করতে সেদেশের ছাত্ররা কি কোন আন্দোলন করেছিল? এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতের সরকার পরিবর্তনেই বা ছাত্ররা কতটুকু ভুমিকা রেখে আসছে? এসব দেশের নেতারা ছাত্রদেরকের পড়াশুনা বাদ দিয়ে অথবা পড়াশুনার পাশাপাশি ছাত্রদেরকে রাজনীতি এবং ক্ষমতার চর্চা করতে দেয় না কেন?
আসলে এসব দেশের সরকারী নীতি নির্ধারক আর রাজনীতিবিদরা একেবারে গাধা (!) কারণ এরা ছাত্রদের রাজনীতি চর্চা বন্ধ করে দিয়ে তাদেরকে শুধুমাত্র পড়াশুনায় নিযুক্ত, নিমগ্ন এবং ব্যাস্ত রেখেছে যার কারণে এই ছাত্ররা সরকার পরিবর্তনে বাংলাদেশের রাজনীতির মত ঐতিহাসিক কোন ভুমিকা রাখতে পারছে না। আর এই কারনে এই দেশগুলোতে খুন, ধর্ষন, নির্যাতনের মাত্রাতিরিক্ত ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস তৈরী হয় না। কি বোকা; এরা ইতিহাস বিমুখ জাতি! তাছাড়া এসব দেশের ছাত্রদের এত মেধা আছে নাকি যে এরা পড়াশুনার পাশাপাশি হলে সিট বানিজ্য, সমান্তরাল প্রশাসনিক দায়িত্ব, ধর্ষন আর খুন ও ডাকাতির পাশাপাশি পড়াশুনাও করবে? বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রিদের রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী মেধা ও যোগ্যতা আর সেই কারনেই এরা পড়াশুনা বা ছাত্র হবার পাশাপাশি, রাজনীতিবিদ হতে পারে, হিরোইনের ব্যবসা করতে পারে, ঠিকাদারি করতে পারে, চাকরী বাণিজ্য করতে পারে, আর র্যাগিং এর নামে অভিনব সব অপরাধের রেকর্ড করতে পারে – এসবের জন্য বুদ্ধিমত্তা এবং ভাল আই কিউ এর দরকার যা ঐ সব দেশের ছাত্রদের নেই । আপনাদের কি মনে হয়?
উন্নত এইসব দেশের মত আমাদের ছাত্রদের শুধুমাত্র যদি পড়াশুনার মধ্যে রাখা হয় তবে দেশের বড় বড় নেতা হবার পরিবর্তে তাঁরা বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সমালোচক, আবিস্কারক, ভাষাবিদ, গবেষক এবং মহাকাশ বিজ্ঞানী তৈরী হবে এবং এর ফলে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস এবং ঔতিহ্য হারিয়ে ফেলবে কারণ একমাত্র ছাত্ররাই এদেশের স্বাধীনতা আন্দলনে মুল, মুখ্য এবং অভুতপুর্ব ভুমিকা রেখেছে; আর অন্যদিকে মেধাবী সেনারা, আমলারা, এবং সাধারন মানুষেরা বসে বসে আংগুল চুষেছে। এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্য কারও কোন গৌরবজ্জ্বল ভুমিকা নেই; আছে শুধুমাত্র ছাত্রদের!
বর্তমানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকরাই হলেন দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য পন্ডিত; তা না হলে ফুলটাইম শিক্ষকতার পাশাপাশি এরা কিভাবে ফুলটাইম রাজনীতি করেন? এদেশে অসাধারন যোগ্য লোকে একেবারেই ভরপুর ; যেমন আপনি সুপ্রিম কোর্টের অনেক বড় বিচারককেও দেখবেন চাকুরী থাকা অবস্থাতেই বহাল তবিয়তে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রন করছেন (দৈনিক মানবজমিন)। রাজনীতির মত এত পবিত্র এবং সোনার পরশ পাথরের সাথে প্রেম ভালবাসা না হলে এখানে কক্ষনই ছাত্রদের পড়াশুনা, শিক্ষকদের শিক্ষাদান, বিচারকদের বিচারকার্য, পুলিশের অপরাধদমন এবং ব্যুরোক্র্যাটদের ব্যুরোক্র্যাসি পূর্নতা পায় না এবং ইতিহাসও তৈরী করা যায় না। ক্ষমতাসীনদের অনুসরন এবং অনুকরন করার রাজনীতি এদেশের আইন, প্রশাসন এবং নির্বাহী বিভাগের সাথে সাথে ছাত্র, শিক্ষক, এবং কিছু মানুষের রক্ত, অস্থি মজ্জায় এমনভাবে ঢুকে গেছে যে এটা তাদেরকে চরম এক উচ্চ মর্যাদায় পৌছে দিয়েছে এবং বর্তমান সময়ে এমন ইতিহাস আর কেউ গড়তে পারেনি! দেখুন মোটামুটি এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে সম্প্রতি দেশের একটি সরকারি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক রাজনীতিবাদী ছাত্রীর দ্বারা আরেক অরাজনৈতিক ছাত্রীর নির্যাতনের যে ঘটনা ঘটেছে তা যে কোন মাত্রায় পৃথিবীর যে কোন ইতিহাসকে হার মানাবে! বুয়েট, মেডিক্যাল কলেজ, ইডেন মহিলা (বিশ্ববিদ্যালয়) কলেজ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেয়েদের হলগুলোতেও — সবক্ষেত্রেই রেকর্ড! ছাত্র রাজনীতির এ এক অনন্য ইতিহাস! আমি আবারও বলছি, পড়াশুনার পাশাপাশি এগুলো করতে হলে তার জন্য দক্ষতা, মেধা এবং যোগ্যতার প্রয়োজন হয় যা কেবলমাত্র আমাদের দেশের ক্ষমাতাসীন এবং ক্ষমাতাশালী ছাত্র/ছাত্রীরা যথাযোগ্য মর্যাদায় ধারন করে আসছে গত ৫০ বছর ধরে !
শিক্ষার পাশাপাশি রেপিস্ট, খুনি, ঠিকাদার, নেতা, সুবক্তা, চাঁদাবাজ, নেশাগ্রস্ত, মাদকব্যবসায়ী – এসব গুনালবলীর চেয়েও বড় যে ঐতিহাসিক এবং গৌরবময় (!) গুনটি তারা অর্জন করেছে তা হল স্যাডিজম। স্যাডিস্টরা সেক্স করবেনা কিন্তু বীপরিত লিংগের সেক্সুয়াল অরগ্যানগুলোকে ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত করে মজা পায়। আপনি আপনার শত্রুকে দুইটার কাছে কষে চারটা থাপ্পড় মারলে অথবা দুই চারটা উত্তম মধ্যম দিলেই সে আপনাকে যমের মত ভয় করবে -কিন্তু আপনি যদি তাঁকে মেরে অর্ধমৃত পংগু করে দিয়ে আবার মৃত্যুর ভয় দেখান (চট্রগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ); অথবা আপনার শত্রুকে যেখানে হকস্টিকের পাঁচটা আঘাতেই মেরে ফেলতে পারেন সেখানে তাঁকে ১২/১৩ জন মিলে সারারাত মেরে ফেলে তারপরও অতৃপ্ত থাকেন (বুয়েট); অথবা আপনি আপনার হলে ছাত্রদেরকে পর্নগ্রাফির মত অভিনয় করিয়ে মজা পান (শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়); অথবা আপনি আপনার সমলিংগের ছাত্র/ছাত্রীদের গোপন অঙ্গের ছবি তুলে মজা পান, সেগুলো ভাইরাল করে মজা পান এবং তাদেরকে অন্যদের সাথে সেক্স করিয়ে বা করার ভয় দেখিয়ে মজা পান ( ইডেন কলেজ, ইসলামী এবং রাজশাহী বিদ্যালয়) তাহলে এদেরকে স্যাডিস্ট না বলে আর কিইবা বলা যায়? হাউজ টিউটর, প্রভোস্ট এবং অন্যান্য দায়িত্বশীল ব্যাক্তিরা এসব জেনেও কোন উদ্যোগ নেন না এবং সেটা একজন দুজনের ক্ষেত্রে নয়- অনেক জনের ক্ষেত্রে অনেক দিন ধরে; খুব সম্ভব এরাও মজা পায় – এদেরকে স্যাডিস্ট বলা যায় কিনা তা আপনারাই নির্ধারন করুন।
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি করা, বিশেষত ক্ষমতাসীন ছাত্র রাজনীতিকদের জন্য, সত্যিই গ্লরিয়াস; এটা কবি জন মিল্টনের বিখ্যাত এপিক প্যারাডাইস লস্টের শয়তান এবং মাইকেল মধুসুদুন দত্তের বিখ্যাত মেঘনাদ বধ কাব্যের সীতা-গুমকারী হনুমানের মতই গ্লরিয়াস এবং সাবলাইম। হুমায়ন আহমেদের নন্দিত নরকের মত এরা শুধু নন্দিতই নয় – পুরস্কৃতও হয়। এদেশে বলিউডের ফেইক মারামারিকে হার মানানো বিশ্বজিৎ হত্যার আসামীদের কোন বিচার হয় না, প্রকাশ্য দিবালোকে বদরুলরা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে একটি মেয়েকে কোপাতে পারে; জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মত উচ্চ বিদ্যাপীঠে নামাজ পড়ার দায়ে একজন ছাত্রকে পিটিয়ে মেরে ফেলা যেতে পারে; এবং এসবের কি কোন বিচার হয়? যারা মারে তারা কি সন্ত্রাসী হয়ে জন্মায়; নাকি ভিন্ন কোন গ্রহ থেকে আসে; নাকি ডঃ জেকিল এবং মিঃ হাইডের মত দিনে ভদ্রলোক এবং রাতে খুনি বা দৈত্যতে পরিণত হয়? এদের জন্ম দেয় কারা; লালিত পালিত করে কারা; ক্ষমতায়ন করে কারা; আশ্রয় দেয় কারা; পদায়ন করে কারা; পুষে কারা; জেলে থাকলে ছাড়িয়ে আনে কারা; শাস্তি হলে সে শাস্তি আবার বাতিল করে কারা? যে দলের রাজনীতি করে সেই রাজনৈতিক দল নয় কি? কিন্তু এরাই আবার বলে; এদের দায় দায়িত্ব দল নেবে না, অথবা এরা বহিরাগত। কি এক তামাসা ; সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসীর জন্ম দিচ্ছে, তাদের লালন পালন করছে আর এখন বলছে এগুলোর দায় তারা নিবে না। এদেশে এসব সন্ত্রাস বন্ধ হবে কিভাবে?
লক্ষ্য করলে দেখবেন যে গত ৫০ বছর ধরে ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতাশালী ছাত্র সংগঠনের ছাত্ররা তাদের অপরাধের জন্য একরকম আইনি নিরাপত্তা (immunity) ভোগ করছে এবং তারা মনে করে এটা তাদের অধিকার। অপরাধ করার এই অধিকার তাদেরকে দেওয়া হয়েছে আর সেই কারনে খুন, নির্যাতন, ধর্ষন থামছে না। কঠোর আইনের আওতায় না আনলে এই ধ্বংসযজ্ঞ থামবে না। মনে হয় কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি করলেই সে আইনের উর্ধে উঠে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠে অপরাধের একটা নিরাপদ এলাকা বা সেইফ জোন। ভিন্ন মতের যে কেউঃ সে নামাজী হোক আর বিরোধী ছাত্র সংগঠনের কেউ হোক – তাকে টর্চার করা, মেরে ফেলা, অপমান অপদস্থ করা এটা তাদের রাজনৈতিক অথবা স্বাধীনতার চেতনাভিত্তিক অধিকার। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র এবং শিক্ষক রাজনীতি যেমন অকল্পনীয় ঠিক একইভাবে আমাদের দেশে রাজনীতিবীহিন বিশ্ববিদ্যালয় অবাস্তব এবং চেতনাবিরোধী। দুনিয়ার সব চেতনা শুধু আমরাই বুঝি আর অন্যরা সব গরু!
ছাত্র রাজনীতি হল ক্ষমতায় যাবার সবচেয়ে বড় সোপানঃ আপনি বাংলাদেশে এমন কোন রাজনৈতিক দল পাবেন না যে এই তত্ত্বে বিশ্বাস করে না; এমনকি এখন অনেক পীর সাহেবরাও ছাত্র সংগঠন খুলেছেন। বুঝেন এবার ছাত্ররা কত যোগ্য এবং ক্ষমতাবান্ধব! প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল যে করেই হোক ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী কাজ করে; তারা ধরেই নিয়েছে যে একমাত্র তাদের মাধ্যমেই এদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন করা যাবে, ক্ষমতায় আসা যাবে এবং টিকা যাবে। ফলে ছাত্রদের আর রেহাই নেই; যে দলই হোক আপনাকে করতেই হবে। আপনি যদি ক্ষমাতাসীন দলের অথবা ক্ষমতাশালী কোন ছাত্র সংগঠনের নেতা হতে পারেন – আপনার কি চাই? ক্ষমতা, বাড়ি, গাড়ী, নারী—আপনি সব পাবেন। এবং আপনার কোন কিছু চাইতে হবে না – চাওয়ার আগেই আপনার ছাত্র সংগঠনের ছেলে এবং মেয়ে কর্মীরা আপনাকে সব পৌছে দেবে। গত পঞ্চাশ বছরে কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া আমাদের যোগ্য নেতৃত্ব এভাবেই তৈরী হয়েছে। এমন একটি সংগঠন যদি থাকত যারা ছাত্রদের শুধু পড়াশুনা, গবেষণা, সংস্কৃতি আর জ্ঞান চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখত এবং লেখাপড়াকালীন সময়ে রাজনীতির বাহীরে রাখত!
বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যাকান্ডের পর সবাই ভেবেছিল যে এবার বোধ হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হত্যা এবং নির্যাতনের সংস্কৃতি বন্ধ হবে; কিন্তু সেটা বন্ধ তো হয়ইনি বরং বিভিন্ন ফর্ম বা রূপে আরও বৃদ্ধি হয়েছে। আমরা এক পাগল জাতি! প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১৫-২০ মিলিয়ন লোক মারা যাবার পর সবাই ভেবেছিল এমন ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ বোধ হয় আর হবে ন; নিষ্ঠর রাজনীতির অবসান হবে এবং মানুষ এথেকে শিক্ষা নিবে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মারা গেল ৫০-৫৫ মিলিয়ন লোক। যুদ্ধ কি থেমেছে? নিষ্ঠরতা কি থেমেছে না কমেছে? খেয়াল করেছেন কি এ বিশ্বযুদ্ধের পরে এক আফগান-সোভিয়েত-আমেরিকান যুদ্ধেই মারা গিয়েছে প্রায় ৩ মিলিয়ন লোক, ইরাক-সিরিয়া-ইয়েমেন যুদ্ধে প্রায় ৩ মিলিয়ন। এসবই হচ্ছে মিনি এবং প্রক্সি বিশ্বযুদ্ধ। অর্থনীতির যেমন মাইক্রো এবং ম্যাক্র ক্রেডিট আছে তেমনি এখন পৃথিবীতে চলছে মাইক্রো-ওয়ার। যারা ভাবছেন এসব থামবে তারা বোকার রাজ্যে বসবাস করছেন। যুদ্ধ এখন মাইক্রো এবং ম্যাক্রো –দুই লেভেলেই চলবে।
ঠিক একইভাবে বাংলাদেশে দুর্নীতি, কু-রাজনীতিকরন এবং অপরাধের বিস্তার ঘটেছে মাইক্রো লেভেলে। ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে পড়াশুনা করতে এবং এটাই তাদের একমাত্র কাজ। কিন্তু এটা কি কল্পনা করা যায় যে একজন ছাত্র বা ছাত্রী একজন শিক্ষককে হলের সিট বরাদ্দের ব্যাপারে ডিকটেট করবে এবং ধমকাবে? এটা কি ভাবা যায় যে একজন ছাত্র আরেকজন ছাত্রকে হাতুড়ি দিয়ে পেটাবে বা সারারাত ধরে পেটাতে পেটাতে মেরে হয় পংগু করবে বা মেরেই ফেলবে? আপনি কি চিন্তা করতে পারেন যে মেয়েরা মেয়েদের নখে সূচ ফুটিয়ে দেবে, নগ্ন করে ভিডিও করবে, ময়লা গ্লাসে পানি খাওয়াবে, নিজের থুতু নিজেকেই চাটাবে, সিটের জন্য টাকা নিবে, জোর করে ছেলেদের কাছে পাঠাবে? এবং শুধু একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানে নয়; দেশের প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই। এই সংস্কৃতি তো আর একদিনে তৈরী হয় না। সারা দেহে ম্যালিগন্যান্ট ক্যান্সার এর মতই এটা সারা দেশে মাইক্রো লেভেলে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে এটার চিকিৎসার জন্য এখন কোমায় রাখার পরিবর্তে ঔ অংগটাকেই কেটে ফেলতে হবে। যারা ভাবছেন যে পরিস্থিতি ভাল হবে তারা আরও খারাপের জন্য অপেক্ষা করুন। মনে রাখবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্যাডিস্ট, নির্যাতনকারী, খুনি ছাত্র নেতারাই আগামী দিনে দেশের নেতৃত্ব দিবে – তা আপনি চান বা না চান। আফসোস, গত ৫০ বছরে এমন কোন ক্ষমতাসীন এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল পাওয়া যাবে না যে ছাত্রদেরকে নিজেদের স্বার্থে ব্যাবহার করেনি।
এটা হল লজিক্যাল কনসেকুয়েন্স বা যৌক্তিক পরিনাম। মহাবিশ্বের অন্য কোথাও কোন দেশ থাকলেও আমাদের দেশের মত এই নিয়ম আছে কিনা বলা মুশকিল। এদেশে সবার অপরাধের বিচার হবে, পুলিশি তদন্ত হবে, জেল-জরিমানা হবে, অপরাধে অপরাধী সাব্যাস্ত হবে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানার মধ্য ছাত্রদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের কোন পুলিশি তদন্ত হবে না, পুলিশ যেতে পারবে না, বিচার হবে না। ছাত্রদেরকে কিভাবে সব ভয়ংকর অপরাধী বানানো হচ্ছে। একজন ছাত্র একটু বুদ্ধি এবং চালাকির সাথে চললেই সে ভয়ংকর অপরাধ করেই পার পেতে পারে এবং গত ৫০ বছর ধরে সেটাই হচ্ছে। স্বাধীনতার ঠিক পর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একরাতে ৬/৭ ছাত্রকে খুন করা হয়েছিল। খুনিদের কি হয়েছে? ১৯৮২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারজন ছাত্রকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল; খুনিদের কি হয়েছে? কিছুই হয়নি; সবাই বহাল তবিয়তে আছে; চাকুরি করছে; এমপি হয়েছে। খুন, রাহাজানি, রেইপ, চাঁদাবাজি, সীটে উঠতে না দেওয়া, বুলিয়িং, সেক্সুয়াল হ্যারেজমেন্ট, রেসিজম, ডিসক্রিমিনেশন -এসব করা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্বাভাবিক প্র্যাকটিস এবং কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসবের কোন বিচার নেই। একপক্ষ বিচার করলে আবার আর এক পক্ষ সেটা উল্টিয়ে দেয়। এখানে অপরাধীরাই গৌরবান্বিত বা গ্লরিয়াস, তারাই মর্যাদাবান বা ডিগনিফাইড, তারাই সুরক্ষিত বা ওয়েল-প্রটেক্টেড এবং সর্বপরি তারাই উদিয়মান নেতা বা ফিউচার লিডার। রাস্ট্র এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোই এই ছাত্র/ছাত্রীদেরকে অপরাধী বানাচ্ছে একটা স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মত। এরা ইতিমধ্যেই ভয়ংকর সব স্যাডিস্ট এবং ক্রিমিনাল তৈরি করেছে যারা রাস্টের বিভিন্ন অংগে কাজ করেছে এবং অদুর ভবিষ্যতে করবে। এ রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই সুবিচার করতে হবে এবং বিচারের পাল্লা ও দন্ড ছাত্র, অছাত্র সবার জন্য সমান হতে হবে। বরং বিশ্ববিদ্যাল্যয়গুলোকে ১০০% অপরাধ্মুক্ত রাখতে হবে কারন আমরা কেহই এটা চাইনা যে এখান থেকে তৈরী হোক সব মারাত্মক অপরাধী যারা আগামীদিন রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।
ধুর্ত রাজনীতিবিদরা স্বাধীনতার গৌরবজ্জ্বল চেতনা আর স্বৈরাচার বিরোধী সৈনিকের কথা বলে ছাত্র রাজনীতিকে ক্ষমতার মুল সিড়ি হিসাবে ব্যবহার করছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ছাত্ররা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল – সেটা ছিল একটা রাষ্ট্রের জন্মকালীন সময় – প্রসবের সময় একটা বাচ্চাকে বের করে আনতে সাহায্য করা; কিন্তু এখন সেই বাচ্চার বয়স হয়েছে ৫০ বছর ; এখন আর ঝাঁপিয়ে পড়ার দরকার নেই; এখন এই বাচ্চাকে সুখী, সাহসী এবং আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার সময়। পোলাও, কোর্মা, কাবাব, বিরিয়ানী খাবার পরে একফোটা বিষ খেলে যেমন সব শেষ হয়ে যায় ঠিক একইভাবে বর্তমানের সন্ত্রাস নির্ভর ছাত্র রাজনীতি আমাদের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে ফেলছে। পুলিশ এবং আদালতের কাজ যৌথভাবে অপরাধ দমন করা আর শিক্ষকদের কাজ পড়ানো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত যে কোন কর্ম-কান্ড যা অপরাধের মধ্যে পড়ে তা পু্লিশ এবং আদালতের হাতে ন্যাস্ত করতে হবে। যে কাজ পুলিশ এবং আদালতের তা শিক্ষকরা কক্ষনই করতে পারবে না। কায়েমী স্বার্থপর, আজীবন ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদরা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের মধ্যেই আর একটি দেশ বানিয়ে রেখেছে; স্বায়ত্তশাসনের নামে অপরাধের এক স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। কমলামতি নিস্পাপ মেধাবী তরুণ ছাত্র ছাত্রীদেরকে ভয়ংকর অপরাধী বানাচ্ছে।
দেখুন কিভাবে ছাত্রদেরকে দিয়ে সমান্তরাল প্রশাসনিক কাঠামো দাড় করা হয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্রীটি নির্যাতনের শিকার হয়েছে তার জন্য ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করেছে। আদালত থেকে একটি তদন্ত কমিটি করার কথা বলা হয়েছে আবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি করবে। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনটি কি আদালত বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত লিগ্যাল এস্টাবলিশমেন্ট যে এটা তদন্ত করার অধিকার এবং যোগ্যতা রাখে? এটা কি একটা সমান্তরাল প্রশাসন হয়ে গেল না? আমরা আরও জেনেছি বা জানি যে ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতাশালী ছাত্র সংগঠনগুলো হলে ছাত্র/ছাত্রীদের সিট নির্ধারন করে ; এটা কি ছাত্র/ছাত্রীদের কাজ? তাদেরকে কি রাষ্ট্র নাকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই দায়িত্ব দিয়েছে? তারা কি প্রশাসনের পার্ট বা অংশ; নাকি কোন এন জি ও? তারা কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে এসেছে নাকি অপরাধের তদন্ত করতে এসেছে। তাদেরকে এ দায়িত্ব বা অধিকার কে দিয়েছে? পড়াশুনা বাদ দিয়ে এভাবেই ছাত্র ছাত্রীদেরকে কক্ষন বানানো হচ্ছে রাজনৈতিক নেতা, কখনোবা প্রশাসক, কখনোবা পুলিশ, কখনোবা বিচারক, কখনোবা ক্যামেরাম্যান, কখনোবা লাঠিয়াল, কখনোবা ধর্ষক আর কখনোবা সিংহের মত রাজা । আর এই রাজাদের শিকার হয় এদেরই ভিন্নমতের সহপাঠী্ প্রজারা যারা ফুলপরীর মত নিস্পাপ গ্রামের সাধারন কর্মজীবী এক পিতার কন্যা।
আপনাদের কাছে সব শেষে বিনীতভাবে প্রশ্ন করতে চাই? আচ্ছা বিভিন্ন ক্ষমতাসীন সরকারের ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা যে সমস্ত ছোট এবং জঘন্যতম এমনকি খুন এবং ধর্ষণের মত অপরাধ করছে, তারা যদি ছাত্র রাজনীতি না করত তবে কী এই অপরাধগুলো করত? অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে যেভাবে বিভিন্ন অপরাধ এবং খুন-ধর্ষনের বিচার হয়, ঠিক একইভাবে যদি ছাত্র ছাত্রীদেরও বিচার হত, তাহলে কি এইরকম অপরাধগুলো সংঘঠিত হত? বন জংগলের সিংহ, বাঘ, সজারু, হায়েনা এবং কুমিরের মত পশুরা প্রাকৃতিক স্বর্গীয় পরিবেশে থাকে এবং তাদের মধ্যে দয়া মায়া থাকলেও তারা বিচারহীনতার রাজ্যে বসবাস করে; দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার – এটাই এখানকার নিয়ম। আমরাও কি আমাদের রাজ্যকে বিচারহীনতার রাজ্যে পরিণত করব বা করতে দেব?