সুদের হার আরো বাড়াতে হবে। কমিয়ে আনতে হবে বাজেটের আকার। এ রকম আগ্রাসী পদক্ষেপ নিলে মূল্যস্ফীতির রাশকে টেনে ধরা সম্ভব। তবে বর্তমান বাস্তবতায় এ ধরনের আগ্রাসী পদক্ষেপ নেয়াটা সরকারের জন্য অনেকটাই দুরূহ ব্যাপার। সুদহার ও বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার মতো ভারসাম্যমূলক পদক্ষেপে এখনই হাঁটতে চায় না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ধীরে ধীরে পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে চান নীতিনির্ধারকরা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রক্ষেপণ হচ্ছে, ২০২৪ সালে এ ধরনের ধীরগতির পদক্ষেপের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনা অনেকটাই দুঃসাধ্য ব্যাপার।
আইএমএফ বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে তাদের সাম্প্রতিক এক মূল্যায়নে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তিনটি পথের কথা বলেছে। অ্যাকটিভ, হকিশ ও দোভিশ। অ্যাকটিভ পলিসির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি প্রান্তিকে প্রত্যাশার তুলনায় মূল্যস্ফীতি কমানোর বিষয়ে নীতি সুদহার নির্ধারণ করবে, চাহিদার চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখবে এবং নীতি সুদহারের কাছাকাছি পর্যায়ে যাতে কলমানি সুদের হার বজায় থাকে সেটি নিশ্চিত করবে। হকিশ পলিসির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরের মধ্যে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রায় মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেবে। হকিশ পলিসি অনুসরণ করলে দ্রুত মূল্যস্ফীতি কমতে থাকবে, তবে এটি হবে ব্যয়বহুল। এক্ষেত্রে আগ্রাসীভাবে সুদের হার বাড়াতে হবে, অন্যদিকে রাশ টানতে হবে সরকারের ব্যয়ে। আর দোভিশ পলিসির ক্ষেত্রে সংস্থাটি বলছে, এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান নীতির সঙ্গে যায় এবং এ নীতি চলতি অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ নীতি অনুসরণ করলে পুরো ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী থাকবে এবং সুদের হার বাড়ানো শুরু করার পর সেটি কমতে থাকবে। আইএমএফ মনে করছে বাংলাদেশের জন্য হকিশ ও দোভিশ পলিসির মাঝামাঝি নীতি অনুসরণ করাটা সুবিধাজনক হবে।
আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হকিশ নীতি অনুসরণ করলে খুব তাড়াতাড়ি মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। দোভিশ অনুসরণ করলে তাড়াতাড়ি সেটি কমবে না। আর এর মাঝামাঝি করলে কিছুটা দেরিতে হলেও কমবে। হকিশ নীতির ক্ষেত্রে সুদের হার বাড়ানোর পাশাপাশি বাজেটে কাটছাঁট করতে হবে, তাহলে মূল্যস্ফীতি দ্রুত কমবে। আমি মনে করি, সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে এবং বাজেটের আকার ১ লাখ কোটি টাকা কমানো হলে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা খুবই সম্ভব। এর সঙ্গে বিনিময় হারকে একক করার পাশাপাশি মোটামুটিভাবে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।’
২০২২ সালের শুরুতেও দেশের মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। যেটি গত বছরের মে মাসে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠে যায়, যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত বছরের অক্টোবরে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর পরের মাস অর্থাৎ নভেম্বরে এটি কমলেও তা দুই অংকের ঘরেই রয়েছে। মূল্যস্ফীতির এ বাড়বাড়ন্ত নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে। অবশ্য বড় আকারে না বাড়ানোর কারণে সেটিও খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখেনি। অথচ দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে থাকা শ্রীলংকা আগ্রাসীভাবে সুদহার বাড়ানোর পাশাপাশি কঠোর নীতি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। গত ১২ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পর্ষদে বাংলাদেশের জন্য ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় অনুমোদন করা হয়। ঋণ ছাড় অনুমোদনের পর সংস্থাটির এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা আছে। দেশটির উচিত হবে এ সময়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি জোর দেয়া।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিয়েছে দেরিতে। ফলে শুধু কঠোর ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না, এর সঙ্গে ডলারের সরবরাহ বাড়ানো ও বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, এটা ঠিক। তবে এর বাইরে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডলার সংকট ও বাজার ব্যবস্থাপনা এ দুটি বিষয় মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। ডলারের অভাবে এলসি খুলতে না পারার কারণে আমদানি ব্যাহত হয়েছে। এ কারণে ভোগ্যপণ্যের জোগানে টান পড়েছে ও শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এমনকি কৃষির উৎপাদনেও এর প্রভাব পড়ছে। এগুলো মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দিচ্ছে। ডলার সংকটের সমাধান শুধু সুদের হার বৃদ্ধি ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে হবে না। বৈদেশিক মুদ্রা ও বাজার ব্যবস্থাপনার যে নীতি সেটারও মূল্যায়ন ও পরিবর্তন প্রয়োজন। খাদ্য মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব ছিল। বিশ্বজুড়েই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছিল। পরে আবার সেটি কমেছেও। কিন্তু এ কমার প্রভাব আমাদের এখানে দেখা যায়নি। বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি থাকার কারণে বড় বড় খেলোয়াড় বাজার কারসাজির মাধ্যমে একেক সময়ে একেক পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। দৃশ্যমান কোনো যৌক্তিক কারণে এসব পণ্যের মূল্য বেড়েছে এমন দেখা যায়নি। বাংলাদেশ যেহেতু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেরিতে পদক্ষেপ নিয়েছে সেহেতু দোভিশের তুলনায় হকিশ নীতি অনুসরণ করাটাই শ্রেয়।’
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্বব্যাপী বহুল প্রচলিত নীতি হচ্ছে সুদের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারে অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু বেসরকারি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এ বিবেচনায় দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে সুদের হারে হাত দেয়া হয়নি। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে বেঁধে রাখা হয়েছিল। তবে গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধের পর এটি পরিবর্তন করা হয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ২০২৩ সালে কয়েক দফায় নীতি সুদহার সামান্য বাড়ানো হয়। সর্বশেষ গত ২৬ নভেম্বর রেপো রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়। বর্তমানে রেপো রেট দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে মূল্যস্ফীতি যতদিন পর্যন্ত নেমে না আসবে ততদিন পর্যন্ত আমাদের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বজায় রাখতে হবে। তবে শুধু এটার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে সেটি প্রত্যাশা করা উচিত নয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নীতি, কঠোর বাজার নজরদারি ও পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতি পরিবর্তন না করলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারকে ঋণ দিতে গিয়ে টাকা ছাপিয়ে মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। সারা পৃথিবীতে দাম কমলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কয়েকটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলেও সেটি বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওঠানামা করেনি। বাংলাদেশের কাঠামোগত যে সমস্যা—যেমন বাজার ব্যবস্থাপনার যে একচেটিয়াকরণ সেখানে কোনো কার্যকর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যেসব পণ্য বাংলাদেশে উৎপাদন করা হয় সেগুলোর ক্ষেত্রে আমদানি মূল্য বাড়ার কারণে দেশে দাম কমেনি। সেখানেও ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় কোনো ভূমিকা গ্রহণ করা হয়নি। মধ্যস্থতাকারীদের দৌরাত্ম্যের কারণে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাননি, অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের ঋণের পরিমাণ ২০১৯ সাল থেকে ৩২২ শতাংশ বেড়েছে। ঋণ শোধ করতে গেলে আরো অর্থের প্রয়োজন হবে। ফলে ভবিষ্যতেও মূল্যস্ফীতির বিষয়টি থেকে যাবে। এসব কারণেই প্রলম্বিত মূল্যস্ফীতি বজায় রয়েছে। বাংলাদেশে প্রেক্ষাপট অনুযায়ী দেখতে হবে কেন মূল্যস্ফীতি ঘটেছে এবং এর কী ধরনের সমাধান দরকার। রাষ্ট্রনৈতিক, নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারির অভাব ও বাজার সিন্ডিকেটের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতির কারণেই এ দীর্ঘ ও প্রলম্বিত মূল্যস্ফীতি দেখা যাচ্ছে। এগুলোর সংস্কার করা না হলে কেতাবি কায়দায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর পরের ২০২১-২২ অর্থবছরে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ১৫ শতাংশে। আর সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালের পুরোটা সময়ই মূল্যস্ফীতি ৮ থেকে প্রায় ১০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। এর মধ্যে গত বছরের জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ, মার্চে ৯ দশমিক ৩৩ ও এপ্রিলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। গত বছরের মে মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে। গত জুনে ৯ দশমিক ৭৪, জুলাইয়ে ৯ দশমিক ৬৯, আগস্টে ৯ দশমিক ৯২, সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৬৩, অক্টোবরে ৯ দশমিক ৯৩ ও সর্বশেষ নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে।
বনিক বার্তা