বন্যার পূর্বাভাসের ব্যাপারে ভারতের কাছ থেকে তিন ধরনের তথ্য চেয়েছিল বাংলাদেশ। প্রথমত, অভিন্ন নদীগুলোর উজানে কী পরিমাণে বৃষ্টি হচ্ছে। সেই পানি কত গতিতে নিচের দিকে নেমে আসছে। দ্বিতীয়ত, আগামী তিন দিনে বৃষ্টির পরিমাণ ও পানি বৃদ্ধির গতি কেমন হতে পারে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের উজানে ভারতীয় অংশের নদীগুলোয় যে ৬০টি বাঁধ রয়েছে, তা কোন সময়ে খুলে দেওয়া হবে এবং সেখান থেকে কী পরিমাণে পানি ভাটির দিকে আসতে পারে।
গত বছরের আগস্টের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশনের সভায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব তথ্য চাওয়া হয়। পরে একাধিকবার চিঠি দিয়ে একই তথ্য চাওয়া হলেও ভারত কোনো সাড়া দেয়নি।
ভারত শুধু অভিন্ন নদীগুলোর ১৪টি পয়েন্টের পানি বৃদ্ধির তথ্য দিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ চেয়েছিল ২৮টি পয়েন্টের বিস্তারিত তথ্য। ১৯৭২ সালের যৌথ কমিশন চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ এই একটিমাত্র তথ্য দৈনিক দুবার পায়। বাংলাদেশে বন্যার পানির ৯২ শতাংশের উৎস হচ্ছে উজান থেকে আসা ঢল। ফলে উজান থেকে আসা পানির পরিমাণ, গতিবেগ ও ব্যাপ্তিকাল বিস্তারিত না জানলে বন্যার সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়।
গতকাল রোববার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি সভা হয়। এ সভায় ফেনী ও কুমিল্লার বন্যার পূর্বাভাস নিয়ে আলোচনা হয় এবং ভারতের কাছ থেকে বন্যার পূর্বাভাসের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। চলতি মাসে যৌথ নদী কমিশনের যে সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, তা আগামী সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তার আগেই অভিন্ন নদ–নদীগুলোর পানির তথ্য চাওয়ার ব্যাপারে সভায় নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্যার পূর্বাভাস এবং ব্যবস্থাপনার জন্য ভারতের কাছ থেকে আমাদের আরও বিস্তারিত তথ্য জানা দরকার। এসব তথ্য আমরা কীভাবে পেতে পারি, তা নিয়ে আমরা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কথা বলেছি। খুব শিগগির আমরা এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে তথ্য চাইব।’
একটি তথ্য যথেষ্ট নয়
গত বছরের আগস্টে যৌথ নদী কমিশনের কাছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে একটি উপস্থাপনা তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের উজানে ভারতের নদ-নদীগুলোর ১৪টি পয়েন্টের পানি বৃদ্ধির তথ্য দিনে দুবার করে দেওয়া হচ্ছে। ১৯৭২ সাল থেকে এ তথ্য দেওয়া হলেও তা বন্যার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের দরকার কমপক্ষে ২৮টি পয়েন্টের পানি বৃদ্ধির বিস্তারিত তথ্য। এসব অভিন্ন নদ–নদীর উজানের পানি ও বৃষ্টির তথ্য দিনে দুবার পাওয়াও যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের দরকার তাৎক্ষণিক তথ্য। যাতে হঠাৎ করে আসা বৃষ্টি ও ঢল মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়া যায়। বন্যার পানি কোথায় কী পরিমাণে এবং কত উচ্চতায় আসতে পারে, অন্তত তিন দিন আগে সেই তথ্য জানা দরকার।
যে ১৪টি পয়েন্টের তথ্য বাংলাদেশ পায়, সেগুলো হচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের চারটি, ধরলা ও দুধকুমারের একটি করে, তিস্তার চারটি, গঙ্গার তিনটি এবং মেঘনার একটি। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ব্রহ্মপুত্রের আরও চারটি, তিস্তার দুটি, গঙ্গার সাতটি, মেঘনার তিনটিসহ মোট ২৮টি পয়েন্টের বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের কাছে দেওয়া লিখিত উপস্থাপনায় বলা হয়, আকস্মিক বন্যার সময় খুব অল্প সময়ের মধ্যে সীমান্ত নদীগুলো দিয়ে দ্রুত পানি আসে। এতে বাংলাদেশের মানুষের জীবন, জীবিকা ও সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশেষ করে তিস্তা, মনু, খোয়াই, মুহুরী, ফেনী নদীর ক্ষেত্রে এ ধরনের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। কারণ, এসব নদী বাংলাদেশের সীমানার খুব কাছে, পানিও দ্রুত বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে।
যৌথ নদী কমিশনের সদস্য আবুল হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কয়েকটি সভায় ভারতের কাছে বন্যা ও বৃষ্টির তথ্য চেয়েছি। একই সঙ্গে সীমান্ত নদীগুলোর ভূপ্রকৃতিও জানা দরকার। বাঁধগুলোর অবস্থান, পানি ধরে রাখার ক্ষমতা ও কখন বাঁধগুলোর গেট খুলে দেওয়া হবে, সেই তথ্যও আমাদের প্রয়োজন। এসব তথ্য ছাড়া বন্যার সঠিক পূর্বাভাস জানা–বোঝা কঠিন। এ জন্য আমরা আবারও আনুষ্ঠানিকভাবে বিস্তারিত তথ্য চাইব।’
যৌথ নদী কমিশনের সর্বশেষ সভায় ভারতীয় অংশের নদীগুলোয় তৈরি করা অবকাঠামোর বিষয়টিও তুলে ধরা হয়। বাঁধের গেট খুলে ছেড়ে দেওয়া পানির ব্যাপারে তথ্য জানা গেলে বাংলাদেশের পক্ষে জীবন, জীবিকা ও অবকাঠামো রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে পাঁচ দিন আগে থেকে পূর্বাভাস দেওয়া উচিত। অন্তত দুই দিন আগেও যদি এসব তথ্য বাংলাদেশ পায়, তাহলেও পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব।
পূর্বাঞ্চলের নদীর ন্যূনতম তথ্যও পাওয়া যায় না
বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের তুলনায় বরাক, মনু, গোমতী, খোয়াই ও মুহুরী নদীর পানি দ্রুত প্রবাহিত হয়। সঠিক ও বিস্তারিত তথ্য ছাড়া এসব নদীর বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন। এসব নদী সরু ও উঁচু–নিচু পথ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এবং উজানে পাহাড় থাকায় পানি দ্রুত ভাটির দিকে নেমে আসে। এতে প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই বন্যার পানিতে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বরাক, মুহুরী ও গোমতী নদীর ক্ষেত্রে অন্তত এক দিন আগেও পূর্বাভাস দিতে হলে ভারতের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া দরকার বলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
আর দেশের পূর্বাঞ্চলের মুহুরী ও খোয়াই নদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে ন্যূনতম তথ্যও পায় না। ফলে বন্যা ও দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এসব এলাকায় যেসব বাঁধ, নিষ্কাশন অবকাঠামো রয়েছে, তা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করে। আকস্মিক বন্যার কারণে এসব অবকাঠামোর ব্যবস্থাপনাও কঠিন হয়ে পড়ে।
যৌথ নদী কমিশনের সাবেক সদস্য ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বজুড়ে বন্যা মোকাবিলায় আঞ্চলিক সহযোগিতাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আর বাংলাদেশের মতো ভাটি দেশের জন্য উজানের সব কটি দেশের সঙ্গে মিলে কাজ করতে হবে। নেপাল, ভুটান ও ভারতের কাছ থেকে পানিপ্রবাহের তথ্য জানতে হবে। অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার দিকে যেতে হবে।
prothom alo