বন্ধ ব্যাংক থেকে যেভাবে শক্তিশালী ইস্টার্ন ব্যাংক

Prothom Alo

ঢাকা

বহুজাতিক ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল (বিসিসিআই) ১৯৯২ সালে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ব্যাংকটির বাংলাদেশ কার্যক্রম পুনর্গঠনের মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকে গঠন করা হয় ইস্টার্ন ব্যাংক। তৎকালীন সরকারের সময়োপযোগী এই সিদ্ধান্তে বিসিসিআইয়ের বড় অঙ্কের আমানতকারীরা হয়ে যান ইস্টার্ন ব্যাংকের মালিকানার অংশীদার। সরকারও ৬০ শতাংশ নিয়ে ব্যাংকটির পর্ষদে যুক্ত হয়। পরে ওই শেয়ার বিক্রি করে দেয় সরকার। আমানতকারী থেকে মালিকানার অংশীদার হওয়া পরিচালকেরা পরবর্তী সময়ে ইস্টার্ন ব্যাংককে দেশের আন্তর্জাতিক মানের ব্যাংকে রূপান্তরের উদ্যোগ নেন।

সুশাসন, সঠিক নির্দেশনা, আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার কারণে এখন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের একটি ইস্টার্ন ব্যাংক। একসময়ের বন্ধ হয়ে যাওয়া বিসিসিআইয়ের বাংলাদেশ শাখায় এখন দেশের শক্তিশালী ব্যাংকগুলোর একটি। ২০ বছর ধরে ইস্টার্ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশের ঘরে। আর্থিক সূচকের পাশাপাশি ভাবমূর্তিতেও অনেক শক্তিশালী ব্যাংকটি। সেবার মানেও ব্যাংকটি এগিয়ে। গত বছর শেষে ইস্টার্ন ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

ইস্টার্ন ব্যাংককে দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যাংকে উন্নীত করতে নেতৃত্ব দিয়েছেন বহুজাতিক ব্যাংকের অভিজ্ঞ ব্যাংকাররা। ব্যাংকটির পরিচালকেরাও এতে সমর্থন জুগিয়ে গেছেন। ২০০৭ সাল থেকে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন আলী রেজা ইফতেখার।

শওকত আলী চৌধুরী
শওকত আলী চৌধুরী

শুরুতে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ব্যাংক চালাবে ব্যাংকাররা, আমরা কোনো হস্তক্ষেপ করব না। ব্যাংক মুনাফায় না যাওয়া পর্যন্ত আমরা প্রথম পাঁচ বছর লভ্যাংশ, সভার সম্মানীসহ কোনো সুবিধা নিইনি। এর ফলে ইস্টার্ন ব্যাংক এখন বাজারের সেরা

– শওকত আলী চৌধুরী, চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ব্যাংক

ব্যাংকটিকে আজকের এই পর্যায়ে পৌঁছাতে কী কৌশল কাজে দিয়েছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইস্টার্ন ব্যাংক শুরুতেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশের ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রাহক হিসেবে বেছে নেয়। এ জন্য শুরুতে এসএমই ও খুচরা ঋণ ছিল না। শুরু থেকে আমরা ব্যক্তি নয়, প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া শুরু করি। এ জন্য আমাদের ব্যাংকে সবকিছু লিখিত আছে। ইস্টার্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদের ভূমিকা কী হবে, তা পরিষ্কার করা আছে। এসব কারণে ইস্টার্ন ব্যাংক আজ এই পর্যায়ে।’

আলী রেজা ইফতেখার আরও বলেন, ‘আমাদের গ্রাহক কে হবেন, এ ব্যাপারে আমরা খুব সচেতন। সব নিয়ম লিখিত। এ জন্য আমার কাছে কোনো ফাইল পড়ে থাকে না। আমার সিদ্ধান্তের জন্য কাউকে অপেক্ষায়ও থাকতে হয় না। আমি কখনো কাউকে ঋণ দেওয়ার জন্য কোনো নির্দেশনা বা পরামর্শ দিইনি। ঋণ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ আছে। তারাই এটা দেখে।’

বিসিসিআই থেকে ইস্টার্ন ব্যাংক

পাকিস্তানি ব্যাংকার আগা হাসান আবেদি ১৯৭২ সালে ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল (বিসিসিআই) প্রতিষ্ঠা করেন। বিসিসিআইয়ের ২৫ শতাংশ মূলধন ছিল ব্যাংক অব আমেরিকার এবং ৭৫ শতাংশ মূলধন ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবির শাসক শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের। ব্যাংকটি লুক্সেমবার্গে নিবন্ধিত ছিল এবং তার প্রধান কার্যালয় ছিল পাকিস্তানের করাচি ও যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। ব্যাংকটি চালুর এক দশকের মধ্যেই ৭৮টি দেশে ৪ হাজারের বেশি শাখার মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্প্রসারণ করে। এর মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। ব্যাপকভাবে কার্যক্রম সম্প্রসারণের কিছুদিন যেতে না যেতেই ব্যাংকটিতে অর্থ পাচার এবং অন্যান্য আর্থিক অনিয়মের ঘটনা ঘটে। এ কারণে বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যাংকটির সম্পদ জব্দ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ সালে এসে ব্যাংকটি বন্ধ হয়ে যায়।

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বড় তিনটি বিদেশি ব্যাংকের একটি ছিল বিসিসিআই। অন্য দুটি ছিল এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ও আমেরিকান এক্সপ্রেস। বিসিসিআই ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলে আমানতকারীদের নিরাপত্তার পাশাপাশি বিদেশি লেনদেন বাধাগ্রস্ত হবে, এ জন্য ব্যাংকটির বিষয়ে তখনকার সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯১ সালের ৬ জুলাই রাতে বিসিসিআইয়ের কার্যক্রম সীমিত করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ৮ জুলাই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ব্যাংকটির কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত জাতীয় সংসদকে অবহিত করেন। জাতীয় সংসদে ইস্টার্ন ব্যাংক পুনর্গঠন স্কিম পাস করা হয়। তখন ব্যাংকটির আমানত ছিল ৫৫০ কোটি টাকা। এসব আমানতকারীর একটি অংশকে আমানতের বিপরীতে ব্যাংকের শেয়ার নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। যদি তাঁরা শেয়ার নিতে আগ্রহী না হন, তবে আমানত ফেরত পেতে ৫-১০ বছর লাগবে বলে জানানো হয়। এই প্রস্তাব পাওয়ার পর আমানতকারীদের একটি অংশ ব্যাংকের শেয়ার নিতে আগ্রহী হন। তখন ১০০ টাকা জমার বিপরীতে ১০০ টাকার শেয়ার দেওয়া হয়। যাঁরা ওই সময় শেয়ার নিয়েছিলেন, তাঁরাই এখন ব্যাংকটির বড় শেয়ারধারী ও পরিচালক। বড় আমানতকারীদের পাশাপাশি সরকারও ব্যাংকটির ৬০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়।

আলী রেজা ইফতেখার
আলী রেজা ইফতেখার

ইস্টার্ন ব্যাংক শুরুতেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশের ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রাহক হিসেবে বেছে নেয়। এ জন্য শুরুতে এসএমই ও খুচরা ঋণ ছিল না। শুরু থেকে আমরা ব্যক্তি নয়, প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া শুরু করি। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদের ভূমিকা কী হবে, তা পরিষ্কার করা আছে

–আলী রেজা ইফতেখার, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইস্টার্ন ব্যাংক

আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯২ সালে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, বিভিন্ন ব্যাংকের এমডিদের নিয়ে পুনর্গঠিত ব্যাংকটির পর্ষদ গঠন করা হয়। নাম দেওয়া হয় ইস্টার্ন ব্যাংক। ৩৬৫ কোটি টাকা ঘাটতি নিয়ে ব্যাংকটির যাত্রা শুরু হয়। ব্যাংকটির প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন নুরুল হোসেন খান, তিনি ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান। পর্ষদ গঠনের পর সিদ্ধান্ত হয়, যত দিন পর্যন্ত ব্যাংক মুনাফায় যাবে না, তত দিন সভার ফি, যাতায়াত ফি, গাড়িসহ কোনো সুবিধা কেউ নেবেন না। নতুন পর্ষদ ঋণ আদায়ে সবচেয়ে বেশি জোর দেন। কারণ, ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক গ্রাহক ঋণ ফেরত দিতে চাইছিলেন না। ঋণ আদায়ের পাশাপাশি আমানতকারীদের টাকাও সময় অনুযায়ী ফেরত দেওয়া হয়। এভাবে লোকসান কাটিয়ে উঠতে ও আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে ব্যাংকটির ছয় বছর সময় লেগে যায়। লাভে ফেরার পর সরকার তার হাতে থাকা শেয়ার ছেড়ে দেওয়া শুরু করে। এই শেয়ারের বড় অংশ কিনে নেয় আমানতকারী থেকে শেয়ারধারী হয়ে যাওয়া পরিচালকেরা। তাঁরা ব্যাংকটিকে নতুন রূপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে তখন থেকে এখনো রয়েছে ফিনলে, এমজিএইচ, ইউনিক ও মীর গ্রুপের প্রতিনিধি।

নতুনরূপে ইস্টার্ন ব্যাংক

২০০০ সালের আগস্টে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন এমজিএইচ গ্রুপের চেয়ারম্যান গাজীউল হক। বেসরকারি উদ্যোক্তারা তখন সিদ্ধান্ত নেন, ব্যাংকটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং মডেলে পরিচালিত হবে। তখনই ব্যাংকটির প্রকৃত রূপান্তর শুরু হয়। ওই বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকটিতে এমডি হিসেবে যোগ দেন কাজী মাহমুদ সাত্তার। তিনি ছয় বছর ব্যাংকটির দায়িত্বে ছিলেন। এর আগে তিনি এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংক, বাংলাদেশের করপোরেট ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান ছিলেন। ওই বছর এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের কার্যক্রম কিনে নেয় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড। ২০০০ ও ২০০১ সালে কাজী মাহমুদ সাত্তারের সঙ্গে আর কিউ এম ফোরকান, সোহেল আর কে হুসেইন, নাজিম সাফকাত চৌধুরী ব্যাংকটিতে যোগ দেন। ২০০৩ সালে ব্যাংকটিতে যোগ দেন মাসরুর আরেফিন, ২০০৪ সালে আলী রেজা ইফতেখার ও ২০০৫ সালে শেখ মোহাম্মদ মারুফ। এর আগে তাঁরা আমেরিকান এক্সপ্রেস, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, গ্রিন্ডলেজ ও এবি ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। তাঁদের হাত ধরে বড় ধরনের রূপান্তর হয় ইস্টার্ন ব্যাংকের। এ কারণে তাঁদের ব্যাংকটির গেমচেঞ্জার হিসেবে ধরা হয়।

তাঁদের উদ্যোগে শাখা ব্যাংকিং থেকে কেন্দ্রীভূত ব্যাংকিং চালু হয়। ২০০২ সালে কোর ব্যাংকিং সলুশন (সিবিএস) বাস্তবায়ন করে ইস্টার্ন ব্যাংক, যা দেশে প্রথম। এতে নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার হয়, অনিয়ম-জালিয়াতি কমে আসে। জনবল নিয়োগ, ব্যাংক পরিচালনা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে বিদেশি ব্যাংককে অনুসরণ করা শুরু করে ইস্টার্ন ব্যাংক। পরে খুচরা ঋণ, কার্ড সেবা চালু করা হয়।

কাজী মাহমুদ সাত্তার
কাজী মাহমুদ সাত্তার

ইস্টার্ন ব্যাংকে যোগ দিয়ে শুরুতে আমরা আর্থিক বিবরণী পৃথক করি। খেলাপি ঋণ আদায়ে পৃথক দল গঠন করা হয়। খেলাপি ঋণের বিপরীতে আগে থেকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখা হয়েছিল। তাই খেলাপি ঋণ যা আদায় হতো, তা পুরোপুরি মুনাফায় যুক্ত হতো। ব্যাংক পরিচালনায় ব্যাংকিংয়ের আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা অনুসরণ করি

– কাজী মাহমুদ সাত্তার, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক,ইস্টার্ন ব্যাংক

ব্যাংকটির রূপান্তর বিষয়ে কাজী মাহমুদ সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইস্টার্ন ব্যাংকে যোগ দিয়ে শুরুতে আমরা আর্থিক বিবরণী পৃথক করি। খেলাপি ঋণ আদায়ে পৃথক দল গঠন করা হয়। খেলাপি ঋণের বিপরীতে আগে থেকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখা হয়েছিল। তাই খেলাপি ঋণ যা আদায় হতো, তা পুরোপুরি মুনাফায় যুক্ত হতো। আমি যখন ব্যাংকটিতে যোগ দিই, তখন খেলাপি ঋণের হার ছিল ৫০ শতাংশ। আর যখন দায়িত্ব ছেড়ে আসি, তখন খেলাপি ঋণের হার কমে ৬ শতাংশে নেমে আসে। ইস্টার্ন ব্যাংক পরিচালনায় ব্যাংকিংয়ের আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা অনুসরণ করা শুরু করি। যাঁর যা কাজ, তা তাঁকে করতে দেওয়া হয়। ফলে ইস্টার্ন এখন সেরা ও শক্তিশালী ব্যাংকে পরিণত হয়েছে।’

ব্যাংকটির নথিপত্র অনুযায়ী, ২০০০ সালে ইস্টার্ন ব্যাংকের আমানত ছিল ১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা। আর ঋণ ছিল ৮১৪ কোটি টাকা। ওই বছর নিট মুনাফা হয় ২৫ কোটি টাকা। ২০০৫ সালে আমানত বেড়ে হয় ১ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। ঋণও বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকায়। ওই বছরে নিট মুনাফা হয় ৫৫ কোটি টাকা।

সোহেল আর কে হুসেইন এখন ব্যাংক এশিয়ার এমডি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিসিসিআই কার্যক্রম বন্ধ করে দিলে ব্যাংকটির অনেক ঋণ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মাহমুদ সাত্তারের নেতৃত্বে আমরা যোগ দিয়ে ব্যাংকটির কেন্দ্রীভূত ব্যাংকিং, ঋণ প্রশাসন, পরিচালন বিধিমালা, করপোরেট ব্যাংকিং, ট্রেজারিসহ বিভিন্ন ব্যবসার ক্ষেত্রে বিদেশি ব্যাংককে অনুকরণ শুরু করি। সেভাবে নীতিমালাও প্রস্তুত করা হয়। তাতে ইস্টার্ন ব্যাংকের রূপান্তর সম্ভব হয়। ২০০০ সালে ইস্টার্ন ব্যাংক ছিল দেশের ৩০ নম্বর ব্যাংক, ২০০৭ সালে যখন আমরা ছেড়ে সিটি ব্যাংকে যাই, তখন সেটি ১০ নম্বরের মধ্যে চলে আসে। আমরা যোগদানের সময় ব্যাংকের ১০০ টাকা শেয়ারের মূল্য ছিল ১২১ টাকা। যখন ছেড়ে দিই, তখন শেয়ারের দাম কয়েক গুণ বেশি ছিল। ইস্টার্ন ব্যাংক পুনর্গঠন স্কিম ছিল যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এই মডেল ব্যবহার করে এখনকার সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোরও পুনর্গঠন সম্ভব।’

ব্যাংকিং নানা সূচকে ব্যাংকটির ভালো অবস্থানে পৌঁছালেও দেশের সব জেলায় শাখা নেই ব্যাংকটির। এটির মোট শাখা ৮৫টি ও উপশাখা ৪৫টি। এরপরও ব্যাংকটিতে গত বছর ১ লাখের বেশি নতুন গ্রাহক যুক্ত হয়েছে। চলতি বছর প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার নতুন গ্রাহক যুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ব্যাংকটি। খরচের তুলনায় আয় অনুপাত বা কস্ট টু ইনকাম রেশিও ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকা আয় করতে ৪০ টাকা খরচ হয়।

দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকটির এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আলী রেজা ইফতেখার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিসিসিসিআই আন্তর্জাতিক ব্যাংক ছিল। তাই আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী ইস্টার্ন ব্যাংককে চালানো একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল। আমরা ২০০২ সালে সিবিএস বাস্তবায়ন করি, ফলে ইস্টার্ন ব্যাংক এগিয়ে আছে। আগ্রাসী কোনো ঋণ ইস্টার্ন ব্যাংক দেয়নি। এটা সম্ভব হয়েছে পরিষ্কার নির্দেশনা, জবাবদিহি, সুশাসন নিশ্চিত করার কারণে। আমরা শাখা ও উপশাখার মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে না গিয়ে আমাদের প্রতিনিধি ও প্রযুক্তির মাধ্যমে সারা দেশে পৌঁছে গেছি।’

উদাহরণ হতে পারে ইস্টার্ন ব্যাংক

গত এক দশকে দেশের বেশ কটি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। এই সময়ে ইস্টার্ন ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার ভিত আরও মজবুত হয়েছে। কীভাবে এটি সম্ভব হলো, জানতে চাইলে আলী রেজা ইফতেখার বলেন, ‘আমরা বাজারে এই ধারণা দিতে পেরেছি যে যথাযথ যাচাই–বাছাই ছাড়া গ্রাহক করা হবে না। এ কারণে আমরা কখনো সমস্যায় পড়িনি। অনেকে আমাদের কাছে আসেনি, আবার অনেকে এসে ফিরে গেছে। আমরা জেনেশুনে এমন কোনো গ্রাহককে ঋণ দিইনি, যা ফেরত পেতে ভোগান্তি পোহাতে হবে। চলতি বছরও নতুন গ্রাহকের কাছে না গিয়ে পুরোনো গ্রাহকদের ব্যবসা বাড়াতে চায় ইস্টার্ন ব্যাংক।’

এখনকার সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো সম্পর্কে আলী রেজা ইফতেখার বলেন, পুনর্গঠন স্কিম করে ইস্টার্ন ব্যাংককে দাঁড় করানো হয়েছিল। এখন যেসব ব্যাংক সংকটে আছে, এসব ব্যাংক একই কৌশল নিতে পারে। যদি একটা বন্ধ ব্যাংক দাঁড় করানো সম্ভব হয়, তাহলে চালু থাকা ব্যাংকও ঠিক করা যাবে। এ জন্য ৫-১০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। প্রতিবছর কী কী কাজ করবে, তার তালিকা করতে হবে। বিসিসিআইয়ের বিষয়টি মাথায় রেখে পরিকল্পনা করলে এখনকার সব ব্যাংককে ঘুরে দাঁড় করানো সম্ভব।

ইস্টার্ন ব্যাংকে ২০১৮ সাল থেকে চেয়ারম্যান হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শওকত আলী চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইস্টার্ন ব্যাংকের পরিচালক কারা হবেন, তা ১৯৯২ সালে শেয়ারধারীদের মধ্য থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে ঠিক করা হয়েছিল। তখন ৫ জন পরিচালক নির্বাচিত করা হয়ে। আমরা তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ব্যাংক চালাবে ব্যাংকাররা, আমরা কোনো হস্তক্ষেপ করব না। চাকরিতে নিয়োগ ও ঋণের ক্ষেত্রে পর্ষদ থেকে কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। ব্যাংক মুনাফায় না যাওয়া পর্যন্ত আমরা প্রথম পাঁচ বছর লভ্যাংশ, সভার সম্মানীসহ কোনো সুবিধা নিইনি। এর ফলে ইস্টার্ন ব্যাংক এখন বাজারের সেরা। যখন ব্যাংকের পরিচালক হস্তক্ষেপ শুরু করবেন, তখনই সেই ব্যাংক খারাপ হওয়া শুরু করে। হস্তক্ষেপ না করলে সব ব্যাংকই ধীরে ধীরে ভালোর দিকে যাবে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here