- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ৩০ আগস্ট ২০২১
‘দয়া করে আমার বাবাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেন। আমি আমার বাবার সাথে স্কুলে যেতে চাই। স্কুলের বন্ধুরা সবাই তাদের বাবার সাথে স্কুলে আসে, আমি তাকিয়ে থাকি। আমার খুব কষ্ট হয়। আমার বাবাকে ফিরিয়ে দেন।’ এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিল এক শিশু। এমন কথা উঠে এসেছে সেখানে আসা অন্য শিশুদের কাছ থেকেও। আবার কেউ মিনতি করেছেন বাবা, ভাই কিংবা স্বামীকে ফিরিতে দিতে।
আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে খুন, গুম ও অপহৃত হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে এসব কথা উঠে আসে।
গুম হওয়া আবদুল কাদির মাসুমের মা প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমার ছেলে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি স্কলারশিপ পেয়ে পড়াশোনা করেছে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র বলে তার পড়াশোনার চিন্তা আমার ছিল না। প্রশাসনে কাজ করে দেশ এবং দেশের মানুষের সেবা করা ছিল তার উদ্দেশ্য। কিন্তু কেন তাকে অপহরণ করা হয়েছে? কি অপরাধে তাকে গুম করা হয়েছে তা আজও আমার অজানা। সে কোনো রাজনীতিক দলের সাথেও সম্পৃক্ত ছিল না। তাহলে কেন আমার বুক থেকে আমার মানিককে নিয়ে যাওয়া হয়েছে?’
তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে মিনতি করেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনিও একজন মা। আপনি আপনার সন্তানকে নিয়ে যেমন অনেক স্বপ্ন দেখেন, আমিও আমার সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি। দয়া করে আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিন।’
কুষ্টিয়া থেকে আসা জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া বলেন, ‘ছয় বছর ধরে গুম হওয়া স্বামীর কথা বলে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দরখাস্ত দিয়ে আসতেছি। র্যাব ব্যাটেলিয়ান ১, ২, ৩সহ প্রশাসনের ধারে ধারে ঘুরেছি কিন্তু আমার স্বামীর কোনো সন্ধান দিতে পারেনি কেউ। আমার সন্তানদের ১২টি ঈদ কেটেছে তাদের বাবাকে ছাড়াই। এখন তারা বলে, মা আমাদের কথা কেউ শুনে না, কেউ আমাদের কথা শুনবে না। এরপরও তারা অপেক্ষায় আছে একদিন তাদের বাবা ফিরে আসবে, তাদের আদর করবে, একসাথে ঈদ করবে।’ তিনি সরকারের কাছে দাবি জানান যেন তার স্বামীকে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
খুন হওয়া ইসমাইল হোসেনের মা শিরিন আক্তার বলেন, ‘আমার ছেলের লাশ নদীতে পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু প্রথমে তাকে অপহরণ করা হয়। অপহরণ হওয়ার পর থেকে প্রশাসনের ধারে ধারে ঘুরেছি কিন্তু কেউ আমার ছেলের খোঁজ করেনি।’
এভাবেই একের পর এক গুম-খুন হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনের আহাজারি আর কান্নায় ভারি হতে থাকে প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণ।
গুম থেকে ফিরে এসেও যেন আতঙ্ক থেকে বের হতে পারছে না মেহেদী হাসান। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারিতে গুম হওয়ার ছয় মাস পর নিজের বাসায় ফিরে এলেও আতঙ্ক এবং ভয় কাটেনি এখনো। নিজের কথা এভাবেই জানালেন তিনি।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার বক্তব্যের শুরুতে ‘মায়ের ডাক’ পরিবারের সকল সদস্য এবং গুম-খুন হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের কাছে নিজের অপারগতার কথা স্বীকার করেন এবং দুঃখ প্রকাশ ক্ষমা চান। তিনি এসব গুম ও খুনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করে বলেন, ‘এটা সরকারের ব্যর্থতা। এর জন্য সরকারকে অবশ্যই দায় স্বীকার করতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আসিফ নজরুল প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘সন্তান হারানোর বেদনা কতটা কষ্টের আমার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বুঝেন, তাহলে এদের বেদনা উনি বুঝেন না কেন? তাহলে কেন এদের বের করার ব্যবস্থা করেন না? তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি না, এদের গুমের সাথে রাষ্ট্রীয় কারণ জড়িত। কারণ যেখানে একটা কমেন্ট কিংবা একটা পোস্ট করলে তাকে প্রশাসন খোঁজে বের করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসে, সেখানে এতগুলো মানুষ কিভাবে বছরের পর বছর গুম হয়ে থাকে। অবশ্যই এর সাথে প্রশাসন এবং সরকার জড়িত।’ তিনি দ্রুত তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাবস্থা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘যাদের কাছে সরকারের কিংবা তার দলের কারো গোপন তথ্য থাকবে, তাদের অপরাধ কিংবা দুর্নীতির প্রমাণ থাকবে, তাদেরকেই সরকারি বাহিনী গুম, নির্যাতন এবং হত্যা করবে।’
তিনি বলেন, ‘এর বিচার হবে। একদিন এই দেশের মাটিতেই তাদের বিচার হবে। প্রধানমন্ত্রীকে জনগণের মুখোমুখি হতে হবে।’
সকাল ১০টায় শুরু হওয়া অনুষ্ঠানটি চলে প্রায় তিন ঘণ্টা। এসময় উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষ।