বন্দুকযুদ্ধের নাটক করে ছাত্রদল নেতাকে হত্যা: ডিএমপির সাবেক কমিশনারসহ ১৫ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা খারিজ করল আওয়ামী আদালত

 আমার দেশ
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
পুলিশ হেফাজতে গুলি করে ছাত্রদল নেতা মো. নুরুজ্জামান জনিকে হত্যার ঘটনায় তার বাবার দায়ের করা মামলা খারিজ করে দিয়েছে আওয়ামী আদালত

পুলিশ হেফাজতে গুলি করে ছাত্রদল নেতা মো. নুরুজ্জামান জনিকে হত্যার ঘটনায় তার বাবার দায়ের করা মামলা খারিজ করে দিয়েছে আওয়ামী আদালত

নিজস্ব প্রতিনিধি
পুলিশ হেফাজতে গুলি করে ছাত্রদল নেতা মো. নুরুজ্জামান জনিকে হত্যার ঘটনায় তার বাবার দায়ের করা মামলা খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে নুরুজ্জামান জনিকে পুলিশ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর রাতে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁর শরীরের ১৬টি গুলির চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল।
এই ঘটনায় ১৫ জন পুলিশকে আসামী করে মামলা করেছিল নুরুজ্জামান জনির বাবা। সোমবার (৬ই ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ঢাকা মেট্রোপলিটন সেশন জজ আদালতের আওয়ামী বিচারক মো. আসাদুজ্জামান মামলাটি খারিজ করেন। আওয়ামী বিচারকের আদেশে বলা হয়েছে, আসামীদের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণের মত পর্যাপ্ত কোন কারণ খুঁজে পায়নি আদালত।
ঢাকা মেট্রোপলিটনের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল জানান, আসামীদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর্যাপ্ত কারণ না পেয়ে আদালত মামলা খারিজ করেছেন।
জনি ছাত্রদল খিলগাঁও থানা ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পুলিশ জানায়, ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় বন্দুযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে হত্যা করা হয় জনপ্রিয় এই ছাত্রদল নেতাকে। হত্যার আগে তাকে হাতকড়া পরিয়ে নির্জন মাঠে নেয়া হয়েছিল। সেখানেই সাজানো হয়েছিল বন্দুকযুদ্ধের নাটক।
ওই ঘটনায় সোমবার (৬ই ফেব্রুয়ারি) জনির বাবা মো. ইয়াকুব নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ১৫(২) ধারায় মামলা করার পর বিচারক আসাদুজ্জামান বাদীর অভিযোগ রেকর্ড করেন।
উল্লেখ্য, এর আগেও ছাত্রদল নেতা জনিকে (৩০) তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার অভিযোগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া ও বর্তমান চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়সহ ১৫ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করা হয়েছিল। গত বছরেরর ৭ই ডিসেম্বর সকালে মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলার আবেদন করেছিলেন নিহত ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনির বাবা ইয়াকুব আলী। সেই মামলাও খারিজ করে দিয়েছে আওয়ামী আদালত।
মামলায় অন্য আসামিরা হলেন- রমনা জোনের তৎকালীন দায়িত্বরত এস আই দীপক কুমার দাস, সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার হাসান আরাফাত, ডিবি দক্ষিণের সিনিয়র সরকারি পুলিশ কমিশনার মোঃ জাহিদুল হক তালুকদার, পুলিশ পরিদর্শক ফজলুর রহমান, পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান, পুলিশ পরিদর্শক এসএম শাহরিয়ার হাসান, এসআই শিহাব উদ্দিন, এসআই বাহাউদ্দিন ফারুকী, এসআই মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, কনস্টেবল মো. সোলাইমান, মো. আবু সাঈদ, পুলিশ সদস্য মো. লুৎফর রহমান।

সেদিন যা ঘটেছিল:

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত নুরুজ্জামান জনি ছিলেন খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক। ২০১৫ সালের ২০শে জানুয়ারী রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এর সদস্যরা তাকে ঠাণ্ডা মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে হত্যা করে।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেইট থেকে তাঁকে দিনের বেলায় উঠিয়ে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশের সদস্যরা। রাতে খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ার জোড়পুকুরমাঠ এলাকায় নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। হত্যার পর তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা গণমাধ্যমের কাছে বর্ণনা করে পুলিশ। দালাল গণমাধ্যমগুলোও পুলিশের মিথ্যা ব্যাখ্যাকে হুবহু প্রকাশ ও প্রচার করে।

নির্মম এই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ২০১৫ সালের ২১-২২শে জানুয়ারি (বুধবার ও বৃহস্পতিবার) ঢাকায় হরতাল ডেকেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রদল।

রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার জনপ্রিয় ছাত্রদল নেতা ছিলেন নুরুজ্জামান জনি। বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত  খিলগাঁও এলাকার অনেক ছাত্রদল নেতাকে এর আগে গুম করা হলেও, নুরুজ্জামান জনিকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়। ছাত্রদলের নেতাদের দাবি, এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের মাঝে ভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করে আওয়ামী লীগ।

নুরুজ্জামানকে হত্যার পর ডিবি পুলিশ জানায়, রাজধানীর মৎস্য ভবন মোড়ে পুলিশের গাড়িতে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপকারীদের অন্যতম সদস্য ছিলেন জনি। এ ছাড়া আরও কিছু সহিংস ঘটনায় তার জড়িত থাকার তথ্য আছে।

বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও সেই সময় পুলিশের মিথ্যাচারে সঙ্গ দেন। তখন তিনি ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পান।

কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনিকে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এটা ক্রসফায়ার নয়। তারা ভয়ানক সন্ত্রাসী। পুলিশকে লক্ষ্য করে তারা গুলি ছোড়ে। পুলিশ বাধ্য হয়েই তাদের গুলি করেছে।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গ সূত্র জানায়,  জনির শরীরে অন্তত ১৫টি গুলির চিহ্ন ছিল। ধারণা করা হয়, জনিকে অন্ধকার মাঠে দৌঁড়াতে বলে ডিবির খুনীর দল হায়নার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের একাধিক সদস্যের গুলিতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান এই তরুণ।

জনি হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের ছাত্র ছিলেন। ছাত্ররাজনীতি করলেও তিনি ছিলেন বিবাহিত। যখন জনিকে হত্যা করা হয়, তখন তার স্ত্রী মুনিরা পারভীন ছিলেন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা।