ভর্তুকির চাপ সামলাতে বছরে চারবার বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করবে সরকার। আগামী তিন বছর এই প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ খাতে মোট ভর্তুকি কমিয়ে আনা হবে। এই সময়ে মোট ১২ দফায় বিদ্যুতের দাম নিয়ে আসা হবে উৎপাদন খরচের সমান বা কাছাকাছি।
সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ ঢাকা সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদলকে এ কথা জানিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে আইএমএফের প্রতিনিধিদল বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে। ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের বিষয়টি বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
অবশ্য বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিয়ে আসছে। তাই দাম সমন্বয়ের নামে ভর্তুকি কমানোর মানে হলো বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি। তবে খরচ কমিয়েও সরকার ভর্তুকি সমন্বয় করতে পারে। অনিয়ম, দুর্নীতি, অপচয় রোধ করে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমানোর দিকে সরকারের মনোযোগ নেই। বরং চাহিদা না থাকলেও দরপত্র ছাড়া একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে এ খাতের খরচ আরও বাড়াচ্ছে।
আইএমএফের প্রতিনিধিদল গতকাল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, পেট্রোবাংলা, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সঙ্গেও আলাদা বৈঠক করেছে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, পেট্রোবাংলা ও বিপিসি প্রায় একইভাবে আইএমএফকে জানিয়েছে, গ্যাস ও জ্বালানি তেলে নতুন করে ভর্তুকির চাপ নেই। তেলের দাম নিয়ে স্বয়ংক্রিয় যে পদ্ধতি (আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে দেশে বাড়বে, কমলে কমবে) চালু করার কথা আইএমএফ বলেছিল, তা হয়েছে। প্রতি মাসে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। এতে জ্বালানি তেলে আর কখনো ভর্তুকি দিতে হবে না। প্রথম দুই দফায় দাম কিছুটা কমানো হলেও শেষ দফায় দাম বেড়েছে। তিন মাস ধরে এ চর্চা করা হচ্ছে।
আইএমএফ ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি অনুমোদন করে। এ সময় অন্য অনেক শর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনা, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুসরণ করা হচ্ছে অন্যতম। ঋণ কর্মসূচি শুরুর পর দুই কিস্তিতে ১০০ কোটি ডলারের বেশি বাংলাদেশ পেয়েছে। তৃতীয় কিস্তিতে ৭০ কোটি ডলার পাওয়ার কথা চলতি মে মাসে। আইএমএফের বর্তমান দলটি ২৪ এপ্রিল থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করছে, যা শেষ হবে ৮ মে।
বিদ্যুতের ভর্তুকি কমাতে দাম সমন্বয়
গতকাল সচিবালয়ে বৈঠকে বিদ্যুৎ বিভাগের নেতৃত্ব দেন বিদ্যুৎ–সচিব মো. হাবিবুর রহমান। আইএমএফের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির গবেষণা বিভাগের সামষ্টিক অর্থনীতি শাখার প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে যে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়, তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আইএমএফ। প্রসংগত, বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন করুক বা না করুক, চুক্তি অনুসারে প্রতিটি কেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ (বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া) দিতে হয়। গত বছর ৪১ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অলস বসে ছিল। তার মানে অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দেওয়া হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ আইএমএফকে জানিয়েছে, চুক্তি থাকায় ক্যাপাসিটি চার্জ দিতেই হবে। তবে সরকার ইতিমধ্যে ‘বিদ্যুৎ নেই, বিলও নেই’ পদ্ধতি চালু করেছে। নতুন করে চুক্তি নবায়নের ক্ষেত্রে ক্যাপাসিটি চার্জ বাদ দেওয়ার সুযোগ আছে।
বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে বেশি হারে বিদ্যুৎ বিল নেওয়া, বিপরীতে প্রান্তিক বা স্বল্প আয়ের বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে কম হারে বিল নেওয়া হচ্ছে কি না, তা জানতে চেয়েছিল আইএমএফের প্রতিনিধিদল। বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, বহু বছর ধরেই এ পদ্ধতি চলমান।
বৈঠক সূত্র আরও জানিয়েছে, দেশে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি বৈঠকে এসেছে। বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট পরীক্ষামূলক ও বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাবে আগামী বছরের মার্চের দিকে। এ ক্ষেত্রে আইএমএফের প্রশ্ন ছিল, এরপর বিদ্যুতে ভর্তুকি আরও বাড়বে কি না। বিদ্যুৎ–সচিব তাঁদের জানান, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ভর্তুকি বাড়বে না। কারণ, এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ প্রচলিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম হবে।
ধাপে ধাপে দাম বাড়বে
এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ খাতে সরকার কীভাবে এবং কতটা ভর্তুকি কমাবে, তা জানতে চেয়েছিল আইএমএফের প্রতিনিধিদল। বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, বিদ্যুতের দাম প্রতিবছর চার দফা সমন্বয় করা হবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত ফেব্রুয়ারিতে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হয়। ঘাটতি মেটাতে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। আগামী তিন বছর ধরে ধাপে ধাপে দাম সমন্বয় করা হবে।
এর অংশ হিসেবে গত মার্চ মাসে বিদ্যুতের দাম সরকার একবার বাড়ায়। পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিক্রি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। সরকারকে ওই অর্থবছরে ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখতে হয়। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পাইকারি দাম গড়ে ৭ টাকা ৪ পয়সা। তবে আইএমএফের পরামর্শ মেনে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে এ দর ১২ টাকার ওপরে নিয়ে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভোক্তাপর্যায়ে গড়ে বিদ্যুতের দাম হবে প্রায় ১৫ টাকা, যা এখন ৮ টাকা ৯৫ পয়সা।
এর আগে গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে তিন দফায় বাড়ানো হয়েছিল বিদ্যুতের দাম। গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরায় ১৪ দফা বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম।
গরমে বিদ্যুৎ পাচ্ছে না মানুষ
দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়লেও তিন বছর ধরে গরমে মানুষকে লোডশেডিংয়ে ভুগতে হয়েছে। কারণ, উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালিত হয়নি। এতে করে ২০২২ সালে ঘোষণা দিয়ে পরিকল্পিত লোডশেডিং শুরু করে সরকার। এরপর গত বছর ঘোষণা না দিলেও গ্রীষ্মের সময় দিনে সর্বোচ্চ সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করা হয়েছে। এ বছরও ঢাকার বাইরে দিনে গড়ে সর্বোচ্চ দুই হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করা হয়েছে। এতে দেশের কোনো কোনো গ্রামাঞ্চলে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছাড়া কাটাতে হচ্ছে মানুষকে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে যখন সমন্বয়ের কথা বলা হয়, তখন তা হচ্ছে মূল্যবৃদ্ধি। কল্পিত উচ্চ চাহিদা দেখিয়ে কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে। আর ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে গিয়েই সরকার বারবার দাম বাড়াচ্ছে বিদ্যুতের।
২০২২–২৩ অর্থবছরে পিডিবি ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া পরিশোধে। সিপিডি বলছে, গত বছর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৪১ শতাংশ সক্ষমতা অলস বসে ছিল। মানুষ লোডশেডিংয়ে ভুগেছে। ব্যাহত হয়েছে শিল্পকারখানার উৎপাদনও।
বাড়তি দামের চাপ নিতে পারবে না ভোক্তা
দাম না বাড়িয়ে বরং মেয়াদ শেষে বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন না করা, ‘বিদ্যুৎ নেই, বিল নেই’ শর্তে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি করা, পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রকে চুক্তি সংশোধন করে একই শর্তে আনা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়ে খরচ কমানোর উপায় আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানিকে কৌশলগত পণ্য হিসেবে দেখেন অর্থনীতিবিদেরা। তাঁরা বলছেন, এর সামাজিক প্রভাব বিচার করে দাম নির্ধারণ করতে হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়লে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। তাই এটি বছরে কয়েকবার বাড়ানো হলে বাজারে জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে চলে যাবে। এমনিতেই সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। এত চাপ ভোক্তা নিতে পারবে না। বিদ্যুৎ খাতে মূল্যবৃদ্ধি করে পুরো ভর্তুকি সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী।
বৈঠক সূত্রে পাওয়া তথ্যের কথা উল্লেখ করে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম. তামিম গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানোর ভালো বিকল্প হচ্ছে দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচ কমিয়ে ভর্তুকি কমানো।
ম. তামিম আরও বলেন, ‘মনে করি না যে আইএমএফের চাওয়া অনুযায়ী পুরোপুরিভাবে ভর্তুকি কমানো সম্ভব হবে। ভালো দিক যে তেল-গ্যাসে এখন ভর্তুকি নেই। তবে আমাদের মতো দেশে বিদ্যুতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকিকে বেশিই বলব। তারপরও গ্রাম পর্যায়ে বিদ্যুতে ভর্তুকি দিতেই হবে।’
prothom alo