ফেসবুক–অ্যাপে যেভাবে চলছে ডলার কেনাবেচার রমরমা ব্যবসা

মার্কিন ডলার
মার্কিন ডলারছবি: রয়টার্স

দেশজুড়ে বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার কেনাবেচার রমরমা ব্যবসা চলছে। ডলার–সংকটের সময়ে এ ঘটনা ঘটছে সবার নজরের মধ্যেই। ডিজিটাল মাধ্যমে চলছে এ ব্যবসা। এর মাধ্যমে একদিকে দেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া দেশে এ ধরনের ব্যবসার কোনো বৈধতা নেই।

অবৈধ এ ব্যবসা ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের যেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না, চুপচাপ আছে সংশ্লিষ্ট অন্য দপ্তরগুলোও। কেউ অভিযোগ করেননি বলে অজুহাত তাদের। অন্য দপ্তরগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা (এসবি), গোয়েন্দা শাখা (ডিবি), তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। সবার মধ্যেই নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে অন্যের ঘাড়ে দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে।

সম্প্রতি মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ (এমটিএফই) নামের দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা করে দেশের মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে পালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

যেসব প্রতিষ্ঠান বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ব্যবসা করছে বা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, তাদের মধ্যে হচ্ছে ফরেক্স ট্রেডিং বাংলাদেশ, গিগামেক্স পিআরও বাংলাদেশ, মারফিন-ইনভেস্টমেন্ট ডট ওআরজি, প্লাটিন কয়েন, প্লাটিন আই-এক্স, ক্রাউড ওয়ান, হিলটন মেটা টিআর, মোবিক্রিপ, ইমপেরর, ফিনটচসহ শতাধিক অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠান।

সচিবালয়ে গত মঙ্গলবার ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সভাপতিত্বে ‘অনলাইনের মাধ্যমে আর্থিক প্রতারণা এবং অবৈধ ও যাচাইবিহীন আর্থিক লেনদেন বন্ধে করণীয়’ শীর্ষক বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে মোস্তাফা জব্বার অবৈধ বৈদেশিক মুদ্রার এ ব্যবসা বন্ধ না হওয়ার জন্য দায়ী হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকে ইঙ্গিত করেন।

বৈঠকে এ ধরনের ব্যবসা ও প্রতারণা বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করা হয়। ছয়টি চ্যালেঞ্জকে চিহ্নিত করে অনলাইনের মাধ্যমে আর্থিক প্রতারণার জন্য প্রধানত মানুষ ও এরপর বিটিআরসিকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, মানুষের সচেতনতার অভাব এবং অল্প সময়ে বেশি লাভবান হওয়ার মনোবাসনাই এ ক্ষেত্রে মূলত দায়ী। যথাযথ আইন না থাকা এবং এর অভাবে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারার অক্ষমতাও আছে সরকারের। আরও আছে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব।

বিটিআরসির পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রতারকেরা খুব সহজেই নিজের পরিচয় গোপন করে ফেলে এবং একটি অ্যাপ বন্ধ করলে দ্রুততার সঙ্গে প্রযুক্তির সহায়তায় নতুন অ্যাপ চালু করে।

বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রধান করে একটি টাস্কফোর্স গঠন এবং প্রয়োজনীয় আইন করার সুপারিশ করা হয়।

ফরেক্স ট্রেডিং কী, কারা করছে

বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচার ব্যবসাকে ইংরেজিতে বলা হয় ফরেন এক্সচেঞ্জ ট্রেডিং, সংক্ষেপে ফরেক্স ট্রেডিং। কারেন্সি ট্রেডিং নামেও তা পরিচিত। যে কেউ চাইলেই তা করতে পারে এবং স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ার কেনাবেচার মতোই এ মাধ্যমেও ক্রেতার সঙ্গে বিক্রেতার সরাসরি দেখা হওয়ার কোনো দরকার পড়ে না।

ফরেক্স ট্রেডের সঙ্গে কতজন জড়িত, এ বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান দেশে নেই। তবে ব্যবসা যাঁরা করছেন, তাঁদের কেউ কেউ অনুমান করছেন, এসব প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে দেশে ৫০ হাজারের মতো ব্রোকার রয়েছে, যারা নতুন নতুন গ্রাহক ধরছে। রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি এ অবৈধ ব্যবসা প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে তরুণসমাজের একাংশ স্মার্টফোন ব্যবহার করে নেশার মতো ঝুঁকে পড়েছে এ ব্যবসায়। আর এর মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। মাত্র পাঁচ ডলার দিয়েই ব্যবসা শুরু করতে পারছেন কেউ কেউ।

ফেসবুকে ফরেক্স ট্রেডিং বিডি নামের গ্রুপটির সদস্য ৩৫ হাজার। ফরেক্স ট্রেডিং করে কীভাবে আয় করা যায়, তার বিশদ বিবরণ ফেসবুকেই রয়েছে। একই গ্রুপে রয়েছে ‘একজন ঝরে পড়া ট্রেডারের গল্প’। আল মামুন নামের একজনের স্ট্যাটাস হচ্ছে, ‘ফরেক্স এমন একটা আয়ের পথ, যেখানে পরিশ্রম দিয়ে সফলতা অর্জন করতে হবে। নতুন অনেকেই এসে কান্নাকাটি করেন না–বুঝে। মনে করেন ১০০ ডলার দিয়ে এক হাজার ডলার আয় করে ফেলবেন। ১০ ডলার দিয়ে শুরু করা ভালো।’

মনিরুজ্জামান রিবন নামের একজন একটা স্ট্যাটাস দিয়ে বলেন, ‘গিগামেক্সে আমার ৩০০ ডলার বিনিয়োগ আছে। সামনের মাস থেকে কি আমি লাভ তুলতে পারব না? আমাকে কি আরও ২০০ ডলার বিনিয়োগ করতে হবে?’

ফরেক্স ট্রেডিং বাংলাদেশ পেজ তৈরিকারী তারিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি বলেন, তিনি নিজে ব্যবসা করেন না। ডলার কেনাবেচা অবৈধ হলেও ফরেক্স ব্যবসা অবৈধ নয়। তিনি শখের বশে ব্লগ করেন, যাতে দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশিরা শিখে ফরেক্স ব্যবসা করতে পারেন।

অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত দুজনের সঙ্গে কথা বলে এ ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেছে। জানা গেছে, ফেসবুক বা ওয়েবসাইট থেকে জেনে বা ব্যবসা করছে, এমন কারও মাধ্যমে প্ররোচিত হয়ে নতুন নতুন গ্রাহক তৈরি হচ্ছে। এরপর প্রথমেই একটি হিসাব খোলা হয়, যাতে নাম, ঠিকানা ও ক্রেডিট কার্ডের তথ্য উল্লেখ করতে হয়।

পরে বলতে হয়, কোন মাধ্যমে ব্যবসা করতে চান এবং কী ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করতে চান—বিটকয়েন নাকি লাইটকয়েন। এর পরের ধাপ হচ্ছে ডেমো ট্রেড। অর্থাৎ নিজের অর্থে ব্যবসা শুরুর আগে ব্যবসার চর্চা। তারপর ডলার জমা করতে হয়।

ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার জমা দিলে ধরা পড়ার ভয় থাকার কারণে নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা হয়। কারও যদি ক্রেডিট কার্ড না থাকে, তাহলে গ্রাহকের পক্ষে ব্রোকারদের কেউ ডলার জমা দেয় এমন শর্তে যে ওই ডলারের সমপরিমাণ টাকা তিনি এমএফএসের মাধ্যমে ব্রোকার বা ব্রোকারের পক্ষে কারও কাছে জমা দেবেন।

অনলাইনে এ অবৈধ ব্যবসায়ের জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম এক্সএম ও মেটাট্রেডার। মেটাট্রেডার ফোর ও মেটাট্রেডার ফাইভ—এ দুটি এখন বেশি চলছে।

বিটিআরসি গত মঙ্গলবারের বৈঠকে বলেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন বেড়েছে ৩৭ শতাংশ, আর এমএফএসের মাধ্যমে ২৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক, না বিএফআইইউ?

বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অনুমোদিত ডিলার ব্র্যাঞ্চ এবং মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচা করতে পারে। এর বাইরে যারাই এ ধরনের ব্যবসা করছে, তারাই অবৈধ। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বিদ্যমান বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্সধারী অনুমোদিত ডিলার ও মানি চেঞ্জার ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনলাইন বা অন্যান্য মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার কেনাবেচা বেআইনি ও দণ্ডযোগ্য অপরাধ।

এ খাতের ব্যবসায়ীরা নিজেদের দাবি করেন ‘ক্ষুদ্র ও মধ্যম পর্যায়ের বিনিয়োগকারী’ হিসেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েক বছর পরপর বৈদেশিক মুদ্রার সব ধরনের অবৈধ কেনাবেচা বন্ধে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এলেও কিছুদিন ধরে তা–ও বন্ধ। অথচ গত প্রায় বছরখানেক ধরে এ ব্যবসা রমরমা আকার ধারণ করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রচারণা করে যাচ্ছি। তবে ফেসবুক বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে চলা বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচার ব্যবসা বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের তেমন কিছু করার থাকে না। অর্থটা কোন জায়গা থেকে কোন জায়গায় গেল, তা হয়তো ধরা যাবে। কিন্তু অর্থ কে, কোন খাতে ব্যয় করবে, এটা একান্তই ব্যক্তির বিষয়।’

অবৈধ এ কার্যক্রম বন্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ে অন্যদের ভূমিকা মুখ্য—এমন ইঙ্গিত করে মেজবাউল হক বলেন, ‘এক ব্যাগ অবৈধ ড্রাগ নিয়ে গেলে পুলিশ যদি ধরতে পারে, অবৈধ আর্থিক লেনদেন কেন ধরতে পারবে না?’

বিটিআরসির নজরে এসেছে, ক্রেডিট কার্ড ও মোবাইলে সেবাদাতা কোম্পানির (এমএফএস) মাধ্যমে লেনদেনের অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে। গত মঙ্গলবারের বৈঠকে বিটিআরসি বলেছে, এসব ব্যাপারে বিএফআইইউর দায়িত্ব রয়েছে। তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর পাশাপাশি বিটিআরসিকেও তথ্য দেবে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কী করছে

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মঙ্গলবারের বৈঠকে এ অবৈধ ব্যবসা বন্ধে সরকারের অন্য দপ্তরগুলোর দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সূত্র জানায়, বৈঠক থেকে বলা হয়েছে, অবৈধ আর্থিক লেনদেন–সম্পর্কিত বিষয়, অনলাইন জুয়া, অ্যাপস ব্যবহার করে আর্থিক লেনদেন তদারক করা, তদন্ত করা এবং অ্যাপ বন্ধ করার কাজ করবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) এবং গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে তাদের সাহায্য করবে।

তবে ঘটনা ঘটার পর অভিযোগের ভিত্তিতে সিআইডি কাজ করলেও ঘটনা ঘটার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব এসবির। প্রতিরোধের কাজটি তেমন হচ্ছে না বলে বৈঠকের সূত্রগুলো জানায়।
সিআইডির মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আজাদ রহমান গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সাইবার ইউনিট ও আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট অবৈধ আর্থিক লেনদেন নিয়ে কাজ করছে। প্রতারিত অন্তত ২০০ জনের মতো যোগাযোগ করেছেন। তাঁদের একটাই চাওয়া—টাকা ফেরত পাওয়া। কেউ লিখিত অভিযোগ দিতে রাজি নন।’

অধ্যাপক সুবর্ণ বড়ুয়ার মতে, টাস্কফোর্স যদি গঠন করা হয়, তার প্রধান কাজ হওয়া উচিত সমীক্ষা করা। কারণ, এ বিষয়ে সরকারের কাছে কোনো তথ্য নেই। পাশাপাশি দেশ বা বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক এনে এ বিষয়ে সরকারি দপ্তরগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া খুবই জরুরি। নইলে টাস্কফোর্স করেও কোনো লাভ হবে না।