- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৭ জুন ২০২১
ফুটবল বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের একটি ম্যাচে আজ সোমবার মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের ফুটবল দল। কাতারের রাজধানী দোহার জসিম বিন হামাদ স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায় শুরু হবে ম্যাচটি।
এর আগে বাংলাদেশ ও ভারত সর্বশেষ মুখোমুখি হয়েছিল কলকাতার সল্ট লেক স্টেডিয়ামে। ২০১৯ সালের ওই ম্যাচে খেলায় এগিয়ে থেকেও বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ভারতের সাথে ড্র করে মাঠ ছাড়ে।
কিন্তু তবে ম্যাচ শেষে সামাজিক মাধ্যমে বাংলাদেশের সমর্থকদের যে প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল, তাতে মনে হয়েছে যে তাদের বেশিরভাগই নিজেদের টিমের খেলা দেখে তৃপ্তই ছিলেন। এর একটি কারণ ছিল – ভারত যে বাংলাদেশের চেয়ে র্যাংকিং বিবেচনায় অনেক এগিয়ে! তাই এমন একটি দলের সাথে ড্র-ও বাংলাদেশকে স্বস্তি দিয়েছিল।
সেই ম্যাচের গোলদাতা সাদ উদ্দিন দেশে ফেরার পর রীতিমতো তারকা বনে যান।
গত ২০ বছরের পারফরমেন্স হিসেব করলে দেখা যায়, ভারতকে কখনোই ফিফা র্যাংকিংয়ে পেছনে ফেলতে পারেনি বাংলাদেশ। কিন্তু ব্যবধান ছিল কম; যেমন ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ ছিল ১৩০তম স্থানে, ভারতের অবস্থান ছিল ১০৬।
কিন্তু এখন বাংলাদেশ আছে ১৮৪তম স্থানে, আর ভারত আছে ১০৫-এ।
অর্থাৎ ফিফা র্যাংকিং বিবেচনায় বাংলাদেশ বেশ অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে ভারতের তুলনায়।
প্রশ্ন হলো, কীভাবে প্রতিবেশী দেশটি ফুটবলে এতোটা এগিয়ে গেল?
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা
এশিয়ার ফুটবলে ভারত নিজেদের অবস্থান জোরদার করতে দীর্ঘমেয়াদী একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের কাজের ধরনের অন্যতম একটি দিক হচ্ছে তৃণমূল থেকে ফুটবলার তুলে আনা।
বাংলাদেশের ফুটবল বিশ্লেষক ও সাবেক খেলোয়াড় ডালিয়া আক্তার সম্প্রতি ভারতে গিয়েছিলেন দেশটির ফুটবল সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে। সেখানে তিনি দেখেছেন, ভারতের রাজ্য পর্যায়ে যেসব একাডেমি আছে, সেগুলোর নানা পর্যায়ের দল আছে।
‘বয়সভিত্তিক দল থেকে শুরু করে পেশাদার দল পর্যন্ত তাদের আছে। এরা বিভিন্ন পর্যায়ে ফুটবল খেলে এবং যারা ভালো পারফরম করে, তারা কেন্দ্রের নজরে আসে।’
ডালিয়া আক্তারের মতে, একজন ফুটবলারকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের জন্য গড়ে তুলতে যে ভিত্তি গড়ে তোলার প্রয়োজন, সেটি ভারত করেছে এবং এটিই এখন ভারতের ফুটবলের মূল শক্তির জায়গা।
অনেকটা একই সুরে কথা বলেন কলকাতাভিত্তিক ক্রীড়া সাংবাদিক জয়ন্ত চক্রবর্তী। তার কথায়, ভারতের ফুটবল ফেডারেশন একদম ছোট বয়স থেকে ফুটবলার তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করে থাকে।
‘একদম মিল্কটিথ বয়স থেকে অর্থাৎ দুধের শিশুকে এই প্রক্রিয়ায় আনা হয়। তাকে গড়ে তোলা হয় একজন ফুটবলার হিসেবে, যাতে সে ফুটবলকে ধ্যানজ্ঞান করে বেড়ে ওঠে।’
‘একটা বেশ চমকপ্রদ ব্যাপারও লক্ষ্য করা গেছে’ – ভারতের দলটিতে যে পার্বত্য অঞ্চলের খেলোয়াড় বেশি, সেদিকে ইঙ্গিত করে বিবিসি বাংলাকে আরো বলছিলেন জয়ন্ত চক্রবর্তী।
তার মতে, ভারতীয় দলে পার্বত্য অঞ্চলের ছেলেদের প্রাধান্য দেয়া হয়, কারণ তাদের কর্মক্ষমতা বেশি। পাহাড়ী পরিবেশে বেড়ে ওটার কারণে তাদের শারীরিক সামর্থ বেশি, তাই তারা লম্বা সময় ধরে এক নাগাড়ে কাজ করতে পারে।
যথাযথ ফুটবল লিগ
বাংলাদেশের ফুটবল প্রায় ২৫ বছর ধরে অনুসরণ করেন খেলাটির একজন নিয়মিত দর্শক ইয়াম্মুম টম্বা। সেই নব্বইয়ের দশকে লিগ যখন জনপ্রিয় ছিল, প্রচুর দর্শক হতো বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে, স্মৃতি হাতড়ে সেখানে চলে যান তিনি।
‘ঘরোয়া লিগের এখনকার যে অবস্থা, তাতে সেই জমজমাট ভাবটা আর নাই। যে কারণে আমি এখন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ইংলিশ লিগ আর লা লিগা দেখি। আগে দেখতাম বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবল। এখন ফুটবলারদের যত্ন নেয়া হয় না, দেশে খেলোয়াড়দের অভাব, সংগঠকের অভাব।’
ঘরোয়া লিগ আয়োজন হলেও যথেষ্ঠ সংখ্যক ফুটবল মাঠ না থাকাটা যে বাংলাদেশে এই লেখা পিছিয়ে পড়ার একটি কারণ, সেটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আদতে শ্রীমঙ্গলের বাসিন্দা ইয়াম্মুম টম্বা।
‘দেখেন প্রতিটা ক্লাবের আলাদা মাঠ না থাকলে, এলাকায় মাঠ না থাকলে প্রতিযোগিতামূলক পেশাদার ফুটবল কীভাবে হবে?’ – প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি। তার মতে, একটি দলের নিজস্ব মাঠ থাকলে সেই মাঠে দলের সমর্থকেরা আসবে, খেলার দিনে উত্তেজনা তৈরি হবে, আর ‘এভাবে খেলাটার প্রতি একটা আলাদা প্যাশন তৈরি হবে।’
প্রতি বছর লিগের আয়োজন করা এবং আর বেশি মাঠে ম্যাচ আয়োজনের প্রতি জোর দেন এই পুরনো সমর্থক।
তবে ভারতের চিত্রটি একেবারেই ভিন্ন। সেখানে সারা বছর ধরেই চলে ফুটবল। নানা পর্যায়ে আয়োজন করা হয় প্রতিযোগিতার।
র্যাংকিংয়ে পরিবর্তন আসার কৌশলগত কারণ
মামুন হোসেন বাংলাদেশের একজন ফুটবল বিশ্লেষক, যিনি বিগত দশকে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে দলগুলোর পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করেছেন। তার মতে, র্যাংকিংয়ে ভারতের উন্নতির পেছনে আছে নিয়মিত ম্যাচ খেলা।
‘ওদের আগের যে কোচ ছিল, কনস্ট্যানটাইন, তিনি আসার পর দলটি টানা তিন বছর বিভিন্ন ধরণের আন্তর্জাতিক ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলেছে। এভাবে তারা র্যাংকিংয়ে উন্নতির দিকে জোর দিয়েছে।’
২০১৬ সাল থেকে শুরু করে টানা আড়াই বছরের মধ্যে কোনো ম্যাচ হারেনি ভারত।
‘পরিকল্পনা করেই ম্যাচ খেলেছে ভারত, আগের কোচের পরিকল্পনা ছিল এটি। নিজের কাছাকাছি শক্তিমত্তার দলের সাথে টানা ম্যাচ খেলার ফলেই ১০০ বা তার কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে ভারত,’ বলছিলেন মামুন হোসেন।
আরো পড়ুন :
ভারতের সামনে আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ
ফুটবলারদের বিনামূল্যে হিজাব দিচ্ছে ফিনল্যান্ড
খেলা নিয়ে পুরো বছর ব্যস্ত থাকা
প্রায় প্রতি বছরই বাংলাদেশের ফুটবল ফেডারেশনের অন্যতম একটা প্রতিশ্রুতি থাকে পরিপূর্ণ ফুটবল ক্যালেন্ডার তৈরি। তবে খেলা সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে যে বাস্তব চিত্রটি পাওয়া যায় তা হলো, বাংলাদেশের ফুটবল খেলোয়াড়রদের বেশিরভাগ জানেনই না কবে লিগ শুরু হয়, আর কবে শেষ হয়।
ফলে, একজন পেশাদারীত্বের ক্ষেত্রে এটি একটি নেতিবাচক প্রভাব রাখে। খেলোয়াড়দের অনেকেই ফুটবলের বাইরে বিকল্প আয়ের নজর দেন, কারণ তারা নিশ্চিত থাকেন না যে লিগ শেষ পর্যন্ত হবেই, কিংবা হলেও ক্লাবগুলো যথাযথ বিনিয়োগ করে তাতে অংশ নেবে।
কিন্তু ভারতের চিত্রটি ভিন্ন বলেই দেখেছেন ডালিয়া আক্তার, তিনি দেখেছেন পুরো বছরজুড়েই সেখানে ফুটবল মাঠে থাকে।
ভারতে ইন্ডিয়ান লিগ এবং ইন্ডিয়ান সুপার লিগ অর্থাৎ দুটি প্রতিযোগিতা হয় যেখানে বিশ্বের নানা দেশ থেকে বিশেষত তরুণ, এবং কখনো কখনো একটু বয়স্ক, আন্তর্জাতিক ফুটবলারদের নিয়ে আসা হয়। তারা খেলেন ভারতের ফুটবলারদের সাথে।
ডালিয়া আক্তারের মতে, দুটো পূর্ণাঙ্গ লিগে প্রতি দলের সেরা খেলোয়াড় বাছাই করলেও বেশ ভালো একটা স্কোয়াড পাওয়া যায়।
খেলা হিসেবে ফুটবলের জনপ্রিয়তা
ভারতের সাথে খেলা থাকলে কিংবা হুটহাট বাংলাদেশ যদি দু’একটি ম্যাচ জিতে যায়, তখন বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অথবা ক্রীড়া ভক্তদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা হয়।
কিন্তু অন্য সময়ে ক্রিকেট নিয়েই মেতে থাকে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন।
বিশ্লেষকদের মতে, এর কারণ পারফরমেন্স। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাকিব আল হাসান বা মাশরাফি বিন মর্তুজার মতো ক্রিকেটারা যে তারকাখ্যাতি পেয়েছেন, বাংলাদেশের এমন কোনো ফুটবলার নেই যাকে নিয়ে অন্য দেশে আলোচনা হয়।
খুব গর্ব করার মতো অর্জন বলতে গেলে বাংলাদেশর ফুটবলের নেই, ফলে সমর্থকেরা এই দল নিয়ে প্রায়শই হতাশ থাকেন। অন্যদিকে, ভারতীয় ফুটবলের চিত্র কিছুটা হলেও ভিন্ন – সেখানে সুনীল ছেত্রীর মতো তারকা ফুটবলার আছেন, যিনি আন্তর্জাতিক ফুটবলে সেরা গোলদাতাদের একজন।
তবে গত ১২ বছরে বাংলাদেশ কোনো ম্যাচে হারেনি ভারতের কাছে। এ সময়ে বাংলাদেশ ও ভারত তিনটি ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল, আর এই তিনটি ম্যাচই ড্র হয়েছে।
ডালিয়া আক্তার বলেন, সবসময় অবশ্য র্যাংকিং বিচার করে মাঠের খেলা হয় না। ভারতের সাথে যেকোনো পর্যায়ের খেলাতেই বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা একটু বাড়তি প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনুভব করেন।
তবে সার্বিক ফলাফলে যোজন যোজন এগিয়ে ভারত – এখন পর্যন্ত ২৯টি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ মাত্র ২টি ম্যাচে জয় পেয়েছে, সাথে ১৫টিতে হার এবং ১২টি ম্যাচ ড্র।
সূত্র : বিবিসি