ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ইতিবাচক ধারায় না ফিরলে থামবে না রিজার্ভের ক্ষয়

 

দেশে যে পরিমাণ ডলার ঢুকছে, বেরিয়ে যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি। এ কারণে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বা আর্থিক হিসাবের ঘাটতি বড় হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৯৩ কোটি ডলার। দেশের ইতিহাসে এ পরিমাণ ঘাটতি এর আগে কখনই দেখা যায়নি। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারণেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় থামানো যাচ্ছে না, বরং দিন দিন পরিস্থিতি বেশি নাজুক হয়ে উঠছে।

দেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বিওপি) সর্বশেষ তথ্য গতকাল প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৭৫৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে তা ১৮১ কোটি ৮০ লাখ ডলারে নেমে এসেছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমার এ ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স বা চলতি হিসাবের ভারসাম্যে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে চলতি হিসাবে ৮৯ কোটি ২০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে চলতি হিসাবে ৩৬৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার ছিল ঘাটতি।

চলতি হিসাব উদ্বৃত্তের ধারায় ফিরলেও ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে বড় অংকের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে এ ঘাটতির পরিমাণ ৩৯২ কোটি ৯০ লাখ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। তীব্র ডলার সংকট সত্ত্বেও গত অর্থবছরের একই সময়ে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ৮৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। দেশের বেসরকারি খাত থেকে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ চলে যাওয়া, নতুন করে বিদেশী ঋণ আসার প্রবণতা কমে যাওয়া, দেশের পুঁজিবাজার থেকে বিদেশী বিনিয়োগ প্রত্যাহার ও বিদেশী দান-অনুদান কমে যাওয়ার কারণেই ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বিওপির ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতির পরিমাণ ৩৩১ কোটি ৫০ লাখ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল।

বিওপির ঘাটতি কিছুটা কমিয়ে আনতে পারাকে প্রাথমিক সাফল্য হিসাবে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনার ইতিবাচক প্রভাব এরই মধ্যে বিওপিতে দেখা যাচ্ছে। চলতি হিসাব এখন উদ্বৃত্তের ধারায় ফিরেছে। তবে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি কমানো সম্ভব হয়নি। সুদের হার অনেক বাড়িয়ে দেয়ায় বিদেশী বিনিয়োগ এখন যুক্তরাষ্ট্রমুখী। আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার না কমলে বাংলাদেশে বিদেশী ঋণপ্রবাহ বাড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এ কারণে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি কমানো যাচ্ছে না। আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্তের ধারায় না এলে রিজার্ভের ক্ষয় থামানো খুবই কঠিন। তবে আশা করছি, জাতীয় নির্বাচনের পর এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে।’

কোনো দেশে আন্তর্জাতিক সম্পদের মালিকানা বাড়া বা কমার বিষয়টি পরিমাপ করা হয় ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। এ হিসাবে ঘাটতি তৈরি হলে দেশের রিজার্ভ ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়হারের ওপর চাপ বাড়ে। চলতি শতকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ সময়ই বাংলাদেশের আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত ছিল। বিশেষ করে ২০১০ সাল-পরবর্তী এক যুগে কখনোই ঘাটতি দেখা যায়নি। কিন্তু ডলার সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়। গত অর্থবছর শেষে এ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২১৪ কোটি ২০ লাখ ডলারে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৪৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরেও আর্থিক হিসাবে ১ হাজার ৪০৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে ৮৬৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫১৩ কোটি ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯০১ কোটি ১০ লাখ ডলার ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪২৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

আর্থিক হিসাবের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই), পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, অন্যান্য বিনিয়োগ এবং রিজার্ভ অ্যাসেট বিবেচনা করা হয়ে থাকে। অন্যান্য বিনিয়োগের মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক সহায়তা, সরকারের মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, ঋণের কিস্তি পরিশোধ, বাণিজ্যিক দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ, ট্রেড ক্রেডিট বা রফতানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ ও অন্যান্য সম্পদ এবং দায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশে ডলার প্রবাহের প্রায় সবকটি খাতই সংকুচিত হয়েছে।

ডলার প্রবাহ কমে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় বেড়েই চলছে। বুধবার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল মাত্র ২ হাজার ৬৬ কোটি বা ২০ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। সে হিসাবে গত দুই বছরের ব্যবধানে রিজার্ভের পরিমাণ অর্ধেকেরও অনেক নিচে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলোর আমদানি দায় পরিশোধে প্রতি মাসে রিজার্ভ থেকে অন্তত ১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারের ঋণ পরিশোধ করতে গিয়েও রিজার্ভের ক্ষয় বাড়ছে। আগামী সোমবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেশগুলো থেকে আমদানি বাবদ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) পরিশোধ করতে হবে ১২১ কোটি ডলার। এ দায় পরিশোধের পর দেশের রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসবে।

বনিক বার্তা