তার সাজসজ্জা– পারিপাট্য, তার বিরাট– বিশালত্ব, তার প্রচার– প্রসারত্ব, আরও অনেক কিছু– এই মুহূর্তে বিশ্বকাপের ফাইনালকে আকর্ষণ করে চুম্বুকের মতো যেন বিশ্বক্রিকেটকে টানছে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম। আজ বাদে কাল এই স্টেডিয়ামেই ভূমিপুত্রদের মুখোমুখি হবে অস্ট্রেলিয়া। ১ লাখ ৩২ হাজার আসন সাজিয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্টেডিয়াম স্বাগত জানাতে চাইছে সবাইকে। কিন্তু পারছে কি? ১২ বছর পর ফের ভারতের ট্রফি জয়ের সুযোগ, পুরো শহর বুঁদ হয়ে আছে তাতে। একটি টিকিটের জন্য অনন্ত চাপ স্টেডিয়ামের সামনে। অনলাইনে ‘সোল্ড আউট’ লেখা আসার পরও রাত পর্যন্ত স্টেডিয়াম ঘিরে উন্মত্ত জনতার ভিড়। ফুটপাতের মার্কেটে চাঁদরাতের মতো বিক্রি হচ্ছে বিরাট কোহলিদের জার্সি। সব মিলিয়ে মাঠে কোহলিদের ১১ জনের সঙ্গে প্রস্তুত গ্যালারির লাখ ছাড়িয়ে যাওয়া দর্শকও। ফুটবলে যেমন রিও ডি জেনিরোর মারাকানা ৭৮ হাজার ৮৩৮ আসন নিয়ে ইতিহাস আর ঐতিহ্যে ব্রাজিলের সঙ্গে মিশে আছে। তেমনি নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম ক্রিকেটের সঙ্গে তার বিশালত্ব নিয়েই জুড়ে থাকতে চাইছে। এত কিছুর মধ্যেই ভারতের বিপক্ষে মাঠে নামতে হবে প্যাট কামিন্সদের।
১২ বছর আগে এই মাঠেই ভারতের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল অসিদের।
সেদিন সেঞ্চুরি করেছিলেন রিকি পন্টিং। অস্ট্রেলিয়ার ২৬০ রান তাড়া করতে নেমে যুবরাজের দারুণ এক ইনিংসে ম্যাচ জিতেছিল ভারত। অবশ্য সেদিন এই মাঠের নাম ছিল সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল স্টেডিয়াম। তখন মেরেকেটে এই মাঠে ২২ হাজার দর্শক বসে খেলা দেখতে পারতেন। এখানকার মানুষ বলেন, সময় অনেক বদেলেছে, লোকাল ট্রেনের পাশাপাশি হয়েছে মেট্রোরেল। হাইরাইজ বিল্ডিং উঠছে চোখের পলকে। ঠিক সেভাবে নিজের চেহারাও বদলে নিয়েছে মোতেরার এ মাঠ। ৫০ একর জায়গা নিয়ে অবকাঠামো, প্রায় আটতলা সমান এই স্টেডিয়ামের গ্যালারি। গুজরাট স্টেডিয়ামের তত্ত্বাবধানে প্রায় ৮০০ কোটি রুপি খরচ হয়েছে বিশ্বের যে কোনো খেলাধুলার সর্ববৃহৎ এই মাঠটি গড়তে। গুগল বলছে উত্তর কোরিয়ার পিয়ংইয়ংয়ের রুংগার্দু মে স্টেডিয়ামে সর্বোচ্চ ১ লাখ ১৪ হাজার দর্শক বসে খেলা দেখতে পারেন। দর্শকদের আসন সংখ্যার বিচারে তাই নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামই সবচেয়ে বড়। তবে এই বৃহতের একটা অহংকার আছে আহমেদাবাদের। আইপিএলের ফাইনালসহ বড় টুর্নামেন্টের বড় সব মঞ্চ ধরেই এই মাঠ করা হয়েছে। অমিত শাহ পুত্র জয় শাহ এখন ভারতীয় বোর্ডের সচিব, তাঁর এই শহর থেকেই ৫ অক্টোবর শুরু হয়েছিল বিশ্বকাপের উদ্বোধন, সেই মাঠেই শেষ হতে যাচ্ছে এবারের আসর।
লক্ষাধিক মানুষের গগনবিদারী চিৎকার আর উল্লাসের মাঝে নিজেদের অস্বস্তির কথা জানিয়েছিল পাকিস্তান। এই মাঠে তারা ভারতের সঙ্গে ম্যাচ খেলতে চাইনি। সময় বদলে অবশ্য খেলতে হয়েছিল তাদের। আইসিসিই চেয়েছিল বড় ম্যাচে বড় স্টেডিয়ামে খেলা দিয়ে কোষাগার ভারী করতে। শেষ পর্যন্ত এই মাঠের নীল সমুদ্রে এসে হাবুডাবু খেয়েছিলেন বাবর আজমরা। ১৯১ রানে অলআউট হন তারা। ১৯ রানে ২ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন বুমরাহ। ভারতীয় পেসাররা নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। গতকাল প্রেসবক্স থেকে এক ভারতীয় সাংবাদিক দেখাচ্ছিলেন সেই পিচটাকে। কিন্তু এত বিশাল মাঠে এত দূর থেকে খালি চোখে পিচের রঙ বোঝা আদতেই সম্ভব নয়। মাঠে ঐচ্ছিক অনুশীলনে আসা ভারতীয় ক্রিকেটারদেরও চেনা সম্ভব নয়। তাই একজন তাঁর কাছে থাকা দুরবিন লাগিয়েই বললেন রোহিত শর্মা, রবীন্দ্র জাদেজা আর প্রসিদ্ধ কৃষ্ণকে দেখা যাচ্ছে। আরও দেখা যাচ্ছে, পিচের কাছে গিয়ে কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে রোহিত শর্মাকে কথা বলতে।
ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকেই বেশি করে চাইছিলেন ভারতীয় সাংবাদিকরা। রোহিত শর্মারাও কি তা চাইছিলেন। ২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে সৌরভ গাঙ্গুলির ভারত পন্টিংয়ের সেই অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারার পর একটা অবিশ্বাস তো রয়েইছে। যদিও সেই বিশ্বকাপের কোনো স্মৃতি এই প্রজন্মের কাছে মূল্য নেই। ‘আমিতো দুদিন আগের কথাই মনে রাখতে পারি না। আর সেটা তো সেই কুড়ি বছর আগে, আমি শুধু জানি ওই বিশ্বকাপ জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া।’ মিচেল স্টার্কের কাছে লক্ষাধিক ভারতীয় সমর্থকে ভরা গ্যালারিও তেমন কোনো সমস্যার কারণ নয়। ‘আমরা বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলতে যাচ্ছি। সেখানে সেরা দলের সেরা খেলোয়াড়রা মুখোমুখি হবে। সেই মঞ্চটা যদি এক লাখের বেশি মানুষ বসে উপভোগ করতে পারে, তাহলে সেটাও সেরা হবে।’ কলকাতায় সেমিফাইনাল জিতে ভীষণভাবে উৎফুল্ল ছিলেন স্টার্ক। ২০১৫ সালের ফাইনালে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে এই অস্ট্রেলিয়া এক লাখ দর্শকের সামনে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। গুগল বলছে অফিসিয়ালি ১ লাখ ২৪ আসন রয়েছ মেলবোর্নে। নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম হয়তো আসন সংখ্যায় মেলবোর্নকে ছাপিয়ে গেছে। কিন্তু অসিদের মনোবলে এখনও ভাঙন ধরাতে পারেনি।