‘ফাঁকা মাঠে’ ভোট বেশি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকা আসনগুলোতে ভোটের পরিমাণ বেশি পড়েছে। এছাড়া ভোটের হার বেশি থাকা এসব আসনে পরাজিত প্রায় সকল প্রার্থীই জামানত হারিয়েছেন। অন্যদিকে তুমুল লড়াই হওয়া আসনগুলোতে ভোটের হার কম। যদিও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের কারণে এসব আসনেই ভোটার উপস্থিতি বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। নির্বাচন কমিশনের দেয়া পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

সিরাজগঞ্জ-১ আসনে অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। আসনটিতে ভোট পড়ার হার ৭২ দশমিক ৩২ শতাংশ। এখানে নৌকা প্রতীকে তানভীর শাকিল জয় ভোট পেয়েছেন ২ লাখ ৭৮ হাজার ৯৭১। অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী জহিরুল ইসলাম মাত্র ৩ হাজার ১৩৯ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন।  একই অবস্থা মাদারীপুর-১ আসনেও। এই আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী নূর-ই আলম চৌধুরী ১ লাখ ৯৬ হাজার ৭৩১ ভোট পেয়েছেন।

তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির মোতাহার হোসেন সিদ্দীক ১ হাজার ৮২৬ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন। এই আসনে ভোট পড়ে ৬৬ দশমিক ৮০ শতাংশ হয়েছে। বাগেরহাটের দু’টি জেলাতেও ভোট বেশি পড়েছে। বাগেরহাট-১ আসনে নৌকা প্রতীকের শেখ হেলাল উদ্দিন ২ লাখ ১৯ হাজার ৯৩৯ ভোট পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. কামরুজ্জামানসহ সকল প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। আসনটিতে ভোটের হার ৬৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অন্যদিকে বাগেরহাট-২ আসনে নৌকা প্রতীকের শেখ তন্ময় ১ লাখ ৮২ হাজার ৩১৮ ভোট পেয়েছেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির প্রার্থী হাজরা সহিদুল ইসলামসহ সকল প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। আসনটিতে ভোটের হার ৬৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। বাগেরহাট-৪ আসনে নৌকা প্রতীকের এইচএম বদিউজ্জামান ১ লাখ ৯৯ হাজার ৩৪ ভোট পেয়েছেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ঈগল প্রতীকের জামিল হোসাইনসহ সকল প্রার্থী জামানত হারিয়েছে। এই আসেন ভোট পড়ার হার ৬০ দশমিক ৭৯ শতাংশ।

জামালপুর-১ আসনে নৌকা প্রতীকের নূর মোহাম্মদ ২ লাখ ২৮ হাজার ২৪৭ ভোট পেয়েছেন। এই আসনেও সকল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জামানত হারিয়েছে। আসনটিতে ভোটের হার ৬০ দশমিক ০৭ শতাংশ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এবি তাজুল ইসলাম ভোট পেয়েছেন ১ লাখ ৯৩ হাজার ৮৭০ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির আমজাদ হোসেন সিদ্দীকসহ সকল প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। এই আসনে ভোটের হার ৭৬ শতাংশ।

ওদিকে কুমিল্লার কয়েকটি আসনেও অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। কুমিল্লা-৭ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী প্রাণ গোপাল দত্ত ভোট পেয়েছেন ১ লাখ ৭৩ হাজার ৬৭৬ ভোট। এই আসনে সকল প্রতিদ্বন্দ্বী জামানত হারিয়েছেন। আসনটিতে ভোটের হার ৬৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। কুমিল্লা-৮ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিন ভোট পেয়েছেন ২ লাখ ৭০৭। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির এম ইরফানসহ সকল প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। আসনটিতে ভোটের হার ৬৩ দশমিক ২৫ শতাংশ।

বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা বলে পরিচিত ফেনী-২ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী নিজাম উদ্দীন হাজারী ভোট পেয়েছেন ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৮ ভোট। ৬১ দশমিক ৮৫ শতাংশ ভোট পড়া আসনটিতে বাকি সকল প্রতিদ্বন্দ্বী জামানত হারিয়েছেন। নোয়াখালী-৬ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী ভোট পেয়েছেন ১ লাখ ৯৩ হাজার ৭১৫ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির প্রার্থী ভোট পেয়েছেন ৫ হাজার ৯৩৬ ভোট। ৬৫ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোট পড়া এই আসনেও অন্য সকল প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। চাঁদপুর-১ আসনে ৯২ শতাংশ ভোট একাই পেয়ে জয়ী হয়েছেন নৌকার প্রার্থী। প্রতিদ্বন্দ্বিতার লেশ না থাকলেও এই আসনে ৫০ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন।

চট্টগ্রামের দুইটি আসনে ভোটের হার অনেক বেশি। চট্টগ্রাম-৬ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী ভোট পেয়েছেন ২ লাখ ২১ হাজার ৫৭২ ভোট। ৭৩ দশমিক ২৪ শতাংশ ভোট পড়া আসনটিতে অন্য সকল প্রার্থী জামানত হারিয়েছন। চট্টগ্রাম-৭ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ ভোট পেয়েছেন ১ লাখ ৯৮ হাজার ৯৭৬ ভোট। ৬৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ ভোট পড়া এই আসনটিতেও সকল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন।

এদিকে পুরো জেলায় ভোটার উপস্থিতি প্রায় ৪০ শতাংশ হলেও ময়মনসিংহ-২ আসনে ৫২ দশমিক ৭৭ শতাংশ ও ময়মনসিংহ-১০ আসনে ৬১ দশমিক ৯৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। এ দু’টি আসনেই কারচুপি, প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারার অভিযোগে নৌকার প্রতিপক্ষ প্রার্থীরা ভোট শুরুর পরপরই বর্জনের ঘোষণা দেন। ময়মনসিংহ-২ আসনে ভোটার ৫ লাখ ৪০ হাজার ৩৪৫। আওয়ামী লীগের প্রার্থী গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ পেয়েছেন ২ লাখ ৬৩ হাজার ৪৩১ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি’র সাবেক এমপি শাহ শহীদ সারোয়ার ১২ হাজার ১৫ ভোট পান। ময়মনসিংহ-১০ আসনে ভোটার ৩ লাখ ৮২ হাজার ৯৪৬।  ভোট দিয়েছেন ২ লাখ ৩৭ হাজার ২৪৫ ভোটার। আওয়ামী লীগের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল একাই পেয়েছেন ২ লাখ ১৬ হাজার ৮৯৩ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী ড. আবুল হোসেন দীপু পান ৭ হাজার ৫১৩ ভোট। এই দু’টি আসনেই অন্য সকল প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন।

তিন পার্বত্য জেলার ভোটের হার অস্বাভাবিক: এদিকে তিন পার্বত্য জেলায় ভোটের হার অস্বাভাবিক দেখা গেছে। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকা এই আসনগুলোতে ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি কম দেখা গেলেও বান্দরবানে ৬৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ, রাঙ্গামাটিতে ৫৯ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং খাগড়াছড়িতে ৪৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। বান্দরবানে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং ভোট পেয়েছেন ১ লাখ ৭২ হাজার ৬৭১ ভোট। এই আসনে অন্য সকল প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। অন্যদিকে রাঙ্গামাটিতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী দীপংকর তালুকদার ভোট পেয়েছেন ২ লাখ ৭১ হাজার ৩৭৩ ভোট। ৫৯ দশমিক ৬০ শতাংশ ভোট পড়া এই আসনেও সকল প্রতিদ্বন্দ্বী জামানত হারিয়েছেন। এছাড়া খাগড়াছড়িতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ২ লাখ ২০ হাজার ৮৭৬ ভোট পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মিথিলা রোয়াজা মাত্র ১০ হাজার ৯৩৮ ভোট পেয়েছেন। এই আসনেও সবার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

৮ ঘণ্টায় ৪ কোটি ৯৯ লাখ ৬৫ হাজার, শেষ ঘণ্টায় ১ কোটি ৭৬ লাখ ৫৯ হাজার ভোট পড়েছে: এদিকে শেষ একঘণ্টার ভোটের হার নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ভোটের দিন রোববার দুপুর সাড়ে ১২টায় ইসি’র মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত প্রেসব্রিফিংয়ে সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেছিলেন, সকাল ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ১৮ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে। অর্থাৎ প্রথম চার ঘণ্টা ভোট পড়ে ২ কোটি ২০ লাখ ১৩ হাজার ৯টি ভোট। এরপর বেলা সাড়ে ৩টায় আবার প্রেসব্রিফিংয়ে আসেন ইসি সচিব। তখন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বিকাল ৩টা পর্যন্ত ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। হিসাব অনুযায়ী তখন ভোট পড়ে ৩ কোটি ২৩ লাখ ৫ হাজার ৫৭৮টি। তখন বিভাগ ওয়ারী কোন বিভাগে কত ভোট পড়েছে তার হিসাবও দেন ইসি সচিব। ভোটগ্রহণ শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে আসেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। সন্ধ্যায় সাড়ে ৫টায় প্রেস ব্রিফিংয়ের শুরুতে সিইসি ভোটের হার ২৮ শতাংশের মতো পড়েছে বলে উল্লেখ করেন। পরে সিইসি’র পাশে থাকা সচিবসহ অন্য কর্মকর্তারা সিইসিকে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানান। পরে তা সংশোধন করে সিইসি বলেন, এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। তবে আরও হয়তো বাড়তে পারে। আবার নাও পারে।

গতকাল বেলা সাড়ে ৩টায় নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। সিইসি বলেন, চূড়ান্ত রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের ২৯৮ সংসদীয় আসনে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। কারও সন্দেহ থাকলে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। ইসি স্বাগত জানাবে। যদিও ইসি’র চূড়ান্ত ফলাফল শিটে ভোট প্রদত্তের হার ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ইসি’র দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শেষ এক ঘণ্টায় ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ ভোট পড়েছে। প্রথম সাত ঘণ্টায় ভোট পড়েছে ৩ কোটি ২৩ লাখ ৫ হাজার ৫৭৮টি। হঠাৎ শেষ একঘণ্টায় কীভাবে ১ কোটি ৭৬ লাখ ৫৯ হাজার ৮৮৮টি ভোট পড়েছে তা নিয়ে স্বয়ং প্রশ্ন আছে ইসি’র সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।

মানব জমিন