স্থানীয় ও বিদেশী উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (আইওসি) কাছ থেকে গ্যাস কিনে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করে পেট্রোবাংলার ছয় বিতরণ কোম্পানি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিতরণকারী এসব প্রতিষ্ঠান মোট গ্যাস কেনা বাবদ ব্যয় করেছিল ৮ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। সে সময় কোম্পানিগুলো গ্যাস কিনেছিল ৩০ হাজার ৪২২ মিলিয়ন ঘনমিটার (এমএমসিএম)। পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কোম্পানিগুলোর গ্যাস ক্রয় কমে দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৮১৩ ঘনমিটারে। এতে ব্যয় হয়েছে ৩৩ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা।
পেট্রোবাংলার এমআইএস প্রতিবেদনের এ তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ অর্থবছরে বিতরণ কোম্পানিগুলোর গ্যাস ক্রয় কমেছে প্রায় ৯ শতাংশ। আর ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩১০ শতাংশ। এজন্য মূলত উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানিকে দায়ী করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তবে আমদানীকৃত এ ব্যয়বহুল এলএনজির প্রকৃত মূল্য এবং গ্যাস খাতে দেয়া ভর্তুকির অর্থ হিসাবে নিলে পেট্রোবাংলার গ্যাস কেনা বাবদ ব্যয় আরো অনেক বেশি হওয়ার কথা বলেও মনে করছেন তারা।
হিসাব বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত অর্থবছরে আইওসি ও স্থানীয় কোম্পানিগুলোর বিক্রীত গ্যাসের মূল্য প্রায় ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এর বাইরে বাকি অর্থ ব্যয় হচ্ছে এলএনজি আমদানিতে।
প্রসঙ্গত, দেশে ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস, বাখরাবাদ, কর্ণফুলী, জালালাবাদ, পশ্চিমাঞ্চল ও সুন্দরবন। এর মধ্যে গ্রাহক ও গ্যাস বিক্রি হিসেবে সবচেয়ে বড় কোম্পানি তিতাস।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মূলত ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে পেট্রোবাংলার অধীন বিতরণ কোম্পানিগুলোর গ্যাস ক্রয় বাবদ খরচ বেড়েছে। ওই অর্থবছরে ২৮ হাজার ৪৮৬ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস ক্রয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোর ব্যয় হয়েছিল ১৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। যেখানে আগের অর্থবছর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৪২২ এমএমসিএম গ্যাস কিনতে ব্যয় হয়েছিল ৮ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র এক অর্থবছরের ব্যবধানে পেট্রোবাংলার গ্যাস ক্রয় ১ হাজার ৯৩৫ এমএমসিএম কমলেও ব্যয় বেড়ে যায় ১১ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। মূলত ওই অর্থবছর থেকেই দেশে এলএনজি আমদানি বাড়তে থাকে।
এর পর ২০২০-২১ অর্থবছরে সংস্থাটির অধীন বিতরণ কোম্পানিগুলোর ২৯ হাজার ৯ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস ক্রয়ে ব্যয় হয় ২০ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে গ্যাস ক্রয় আরো কমে নেমে আসে ২৮ হাজার ৬৬৮ এমএমসিএমে। এতে ব্যয় হয়েছে ২১ হাজার ৯৮ কোটি টাকা।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পেট্রোবাংলা ১১ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকার গ্যাস ক্রয় করেছে। এ সময় পর্যন্ত গ্যাস ক্রয়ের পরিমাণ ৭ হাজার ২৮৮ এমএমসিএম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস ক্রয় কমলেও পেট্রোবাংলার এ বাবদ খরচ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বড় প্রভাব ফেলেছে মূলত উচ্চ মূল্যের এলএনজি আমদানি। স্থানীয় গ্রিড লাইনে আমদানীকৃত এ গ্যাসের সরবরাহ সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ হলেও ব্যয় ছিল স্থানীয়ভাবে সরবরাহকৃত গ্যাসের তুলনায় কয়েক গুণ। এ ব্যয়ের প্রভাব পড়েছে গ্যাসের গড় মূল্যে। যে কারণে স্থানীয় গ্যাসের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি মেটাতে গিয়ে পেট্রোবাংলার আমদানীকৃত এলএনজি-নির্ভরতা ও খরচ—দুটোই বেড়েছে।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিগত বছরগুলোয় স্থানীয় কূপগুলোর উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। বিপরীতে এলএনজি আমদানি করে গ্যাসের সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে হয়েছে। এলএনজির আমদানি ব্যয়ের একটি প্রভাব তো রয়েছেই। কারণ এখানেও বড় অংকের অর্থ ব্যয় হচ্ছে।’
বর্তমানে দেশে স্থানীয়ভাবে গ্যাস উত্তোলন করছে তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। পেট্রোবাংলার আওতাধীন এ কোম্পানিগুলো হলো বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল), সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (এসজিএফসিএল) ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)। এছাড়া বিদেশী কোম্পানি হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে গ্যাস উত্তোলন করছে মার্কিন কোম্পানি শেভরন ও ব্রিটিশ কোম্পানি তাল্লো।
গ্যাস উত্তোলনকারী এসব প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত গ্যাস বিক্রি করছে ছয় বিতরণ কোম্পানিগুলোকে। এর মধ্যে বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে নামমাত্র মূল্যে গ্যাস বিক্রি করছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। আর বিদেশী কোম্পানিগুলো বিক্রি করছে পেট্রোবাংলার গ্যাস উৎপাদন ও বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) আওতায়।
দেশে স্থানীয়ভাবে গ্যাস উত্তোলনে গত পাঁচ অর্থবছরে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে আইওসিগুলোর। মূলত তারাই গ্যাস সরবরাহে ৬২ শতাংশ জোগান দিয়ে আসছে। এর মধ্যে এককভাবে শেভরনের জোগান সবচেয়ে বেশি। বিপরীতে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর ছিল ৩৩ থেকে ৩৬ শতাংশ।
স্থানীয়ভাবে শেভরনের কাছ থেকেও সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে শেভরনের কাছ থেকে গ্যাস কেনা হয়েছে ৪ হাজার ৮৪৪ এমএমসিএম। এ গ্যাসের অর্থমূল্য ৪ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে কেনা হয়েছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এছাড়া তাল্লোর কাছ থেকে গত অর্থবছরে কেনা হয়েছে ৫৭২ কোটি টাকার এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে কেনা হয়েছে ৬২২ কোটি টাকার গ্যাস। গত দুই অর্থবছরের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে শেভরন ও তাল্লোর কাছ থেকে ২০২২-২৩ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে যথাক্রমে ৫ হাজার ৪১৬ ও ৫ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা।
এছাড়া স্থানীয় তিনটি উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার কিছু বেশি গ্যাস বিক্রি করেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তিন উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাস বিক্রি করেছে ১ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিজিএফসিএল ১ হাজার ৬১ কোটি, এসজিএফএল ১৫২ কোটি ও বাপেক্স ৫২১ কোটি। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকার গ্যাস বিক্রি করেছে।
গ্যাস খাতে এলএনজি আমদানি বাড়ায় দায়-দেনা বেড়েছে পেট্রোবাংলার। সংস্থাটির আর্থিক লোকসানও বাড়ছে। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সংস্থাটিকে স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাসের উত্তোলন বৃদ্ধিতে বিনিয়োগে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাস খাতে ব্যয়ে পেট্রোবাংলার খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণ আমদানিনির্ভরতা। স্থানীয় গ্যাস ও আইওসির গ্যাসের দাম বাড়েনি। বিতরণ কোম্পানিগুলোও কয়েক ধাপে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। তার পরও গ্যাসে পেট্রোবাংলার লোকসান বেড়ে যাওয়ার কারণ উচ্চ মূল্যে গ্যাস ক্রয়। এ গ্যাস আমাদের ঘাটতি মেটাতে বৃহৎ পরিসরে ভূমিকা না রাখলেও আর্থিক ঘাটতিটা বড় করছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।’
Bonik Barta