
বাংলাদেশ এখন এক গভীর রাজনৈতিক অনিশ্চিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলছে। দীর্ঘ দুই দশক রাজনৈতিকভাবে জনগণের মতামতের প্রতিফলনহীন এক একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার ক্রমেই হারিয়েছে। এই এখতিয়ার হারানোর প্রক্রিয়ায় দু’টি ঘটনা ঘটেছে, যার একটি হলো বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় এক সর্বব্যাপী ফ্যাসিবাদ আবির্ভূত হওয়া। আর দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ঢাকায় দৃশ্যত যারা ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে থাকে তাদের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা ক্রমেই সঙ্কুচিত হওয়া। এতে যেকোনো কৌশলগত সিদ্ধান্ত একটি প্রতিবেশী দেশের অনুমোদনক্রমে নেয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
এই দুই অবস্থার বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক গণ-অভ্যুত্থান হয় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে। এই পরিবর্তনকে বিপ্লব না গণ-অভ্যুত্থান বলা হবে তা নিয়ে একাডেমিক অঙ্গনে বিতর্ক রয়েছে। এই বিতর্কের মূল কারণ হলো, এ ঘটনার ক্ষমতার ধারাবাহিকতায় এক ধরনের সাংবিধানিক ক্রম বজায় রাখা হয়। ফ্যাসিবাদ সময়ের প্রেসিডেন্ট নতুন সরকারের ক্ষমতার প্রতীকী অবস্থানে থেকে যান। সামরিক বেসামরিক বিচার বা নিরাপত্তা প্রশাসনে পরিবর্তন এলেও তা নতুন বন্দোবস্ত বাস্তবায়নের মতো মৌলিক ছিল না। কিন্তু জন-আকাঙ্ক্ষার মূল জুড়ে ছিল ফ্যাসিবাদী অপশাসন যাতে আবার ফিরে আসতে না পারে, তার জন্য কাঠামোগত মৌলিক সংস্কার এবং খুন গুম ও মানবতাবিরোধী অপরাধকে বিচারের আওতায় আনা। আর সবশেষে এমন এক নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনের রূপান্তর যেখানে জনগণ অবাধে ও মুক্তভাবে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। এ ব্যবস্থা কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠা করা গেলে রাষ্ট্র নিজস্বভাবে জাতীয় ইস্যুগুলোতে সিদ্ধান্ত নেয়ার সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবে।
বাধা কোথায়?
বাংলাদেশে গত চারটি নির্বাচনের মধ্যে ২০০৮-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফলও ছিল একতরফা, কিন্তু সে নির্বাচনটিই পরের তিন মেয়াদের পূর্ণোদ্যমে প্রতিষ্ঠিত ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা ও প্রতিবেশী দেশের আধিপত্যের বীজ বপন করে। এই নির্বাচন ওয়ান ইলেভেনের দুই বছরের জরুরি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, যে সরকার ছিল বর্তমান সরকারের মতো আধা সাংবিধানিক সরকার। বর্তমান ও আগের দুই সরকারের মধ্যে পার্থক্য ছিল আগের জরুরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়ন্ত্রক ছিল মূলত সেনা প্রতিষ্ঠানের হাইকমান্ড। ’২৪ এর ৮ আগস্টের সরকার একই ধারায় প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ছিল সেনা নেতৃত্বের, কিন্তু রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের পতন এবং প্রফেসর ইউনূসের কৌশলী দৃঢ়তার কারণে অন্তর্বর্তী সরকারে সেনানিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়নি। সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক দরবারে রাখা বক্তব্যে এটি অনেকটাই প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে।
অবশ্য জুলাই আগস্টের বিপ্লব ও এর পরের সরকার গঠনের কঠিন সময়েও অন্তর্বর্তী সরকারের ম্যান্ডেট নিয়ে কোনো ধোঁয়াশা ছিল না। এই সরকারের ওপর ম্যান্ডেট ছিল তিনটি— রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার, ফ্যাসিবাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং মুক্ত অবাধ নির্বাচনে জনরায় পাওয়া দল বা জোটের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর।
ম্যান্ডেট বাস্তবায়নের উপায় কী?
সাংবিধানিক লিগ্যাসি বহনের পরিবর্তে জুলাই বিপ্লবের পর একটি বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা হলে রাষ্ট্র সংস্কার ও বিচার তুলনামূলকভাবে সহজ হতো। কিন্তু ফ্যাসিবাদী প্রশাসনের কাঠামো ঠিক রেখে বিপ্লবী এজেন্ডা পূরণ অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে ক্রমেই কঠিন হয়ে ওঠে। প্রথমত, অন্তর্বর্তী সরকার মূলত ফ্যাসিবাদের সময় নিযুক্ত ও একজন বিতর্কিত প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করছে। দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনীর হাতে দেশের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মূল দায়িত্ব অর্পিত হলেও কমান্ডারদের ইচ্ছা অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে না। এতে এক ধরনের ক্ষোভের জন্ম হয়েছে। এ দুইয়ের সাথে রাস্তার শক্তির একটি অংশের সংযোগ সাধনে বাইরের সমন্বয় অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে কঠিন করে তুলেছে।
এ অবস্থায় প্রতিবেশী লবির সাথে নিরাপত্তা নেতৃত্ব ও রাস্তার শক্তির বৃহত্তম অংশ একসাথে অন্তর্বর্তী প্রশাসনের দ্রুত অবসান কামনা করছে। এই অবসান কামনায় প্রতিবেশী পরিকল্পনায় তিনটি বিকল্পের কথা জানা যায়। প্রথমত, ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিতে বাধ্য করা, যে নির্বাচনটি হবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের মতো একটি সাজানো ফলের নির্বাচন ডিসেম্বর ’২৫ এর মধ্যে সম্পন্ন করা। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনেও মানুষ ভোট দিয়েছিল। কিন্তু প্রকাশ হওয়া ফল আর জনগণের মতপ্রকাশ এক ছিল না। ২০ শতাংশ ব্যালট পরিকল্পিতভাবে বাক্সে ঢুকিয়ে ফল নির্ধারণ করা হয়েছে। যার ফলে অনেক ভোটকেন্দ্রে শত ভাগের বেশি ভোট দেয়ার রেকর্ড হয়েছে। অন্তর্বর্তী প্রশাসনে থাকা একজন উপদেষ্টা হয়তো বিষয়টি গভীরভাবে জানেন। প্রতিবেশীদের ধারণা, তাদের প্রথম বিকল্পে যে সরকার আসবে তার সাথে ২০০৮ সালের সরকারের পরিচিতি ও মাত্রাগত পার্থক্য থাকলেও মাঠের বাস্তব ভূমিকায় মিল থাকবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণের মূল নাটাই তাদের হাতে আবার চলে যাবে।
প্রতিবেশীদের দ্বিতীয় বিকল্প হলো, রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা সৃষ্ট সর্বব্যাপী চাপে অন্তর্বর্তী প্রশাসন বিদায় নিলে সেনা কম্যান্ডের নিয়ন্ত্রিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা। এই সরকার আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের অন্তর্ভুক্ত করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে, যে দাবিটি প্রতিবেশী দেশ ছাড়াও বর্তমান সেনা নেতৃত্বের পক্ষ থেকে উঠেছে। তৃতীয় বিকল্প হলো, এর কোনোটাই যদি কাজ না করে তাহলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে অস্থির করে তোলা। উগ্রপন্থার বিস্তার থেকে শুরু করে খুন, গুপ্তহত্যা ও হানাহানির পরিস্থিতি তৈরি করা। যাতে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের পরিণতির দিকে চলে যায়।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক অংশীদার যেহেতু কেবলই একটি বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ নয় তাই এই তিন বিকল্পই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ— এমনটা নাও হতে পারে। এ অবস্থায় ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে মনে হচ্ছে এই প্রশাসন কিছু মৌলিক বিষয়ে সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু করবে, মানবতাবিরোধী বিচার প্রক্রিয়াকে একটি পর্যায়ে উপনীত করবে এবং নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সংস্কার আনার মাধ্যমে এপ্রিল নাগাদ একটি মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। যে নির্বাচনে জনমতের কার্যকর প্রতিফলন ঘটবে।
এসব কাজের ফল কী হতে পারে
বর্তমান কাঠামো ও প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে বিএনপির সরকার গঠনের প্রবল সম্ভাবনা থাকবে। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও একক সংখ্যগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর অন্তর্বর্তী সরকারের বিদায়ের পর সেনা কম্যান্ড নিয়ন্ত্রিত কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে তখনকার বাস্তবতা পাল্টে যাবে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা, বিএনপি ও তার মিত্ররা এবং জামায়াত ও এনসিপি বা অন্যান্য সমমনা জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী দলগুলো এক জোট হয়ে নির্বাচন করলে মুক্ত অবাধ নির্বাচনেও ফলাফল কী দাঁড়াবে তার কোনো নিশ্চিত গ্যারান্টি থাকবে না।
সেনা কম্যান্ডারের দরবারের বক্তব্য, ইশরাককে মেয়রের শপথ পড়াতে যমুনা ঘেরাওয়ের হুমকি এবং সামাজিক শক্তিগুলোকে উসকে দেয়ার পরিস্থিতিতে প্রফেসর ইউনূস সম্ভবত মনে করেছিলেন এই পরিবেশে তিনি যে মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটি সম্ভব হবে না। কারণ এর মধ্যে প্রশাসন ও বিচার বিভাগে কোনো কোনো রাজনৈতিক পক্ষের চাপ ও ক্ষমতা প্রয়োগের তথ্য তার কাছে এসে থাকতে পারে। এ অবস্থায় কলঙ্কের দায় নেয়ার চেয়ে সরে দাঁড়ানোকেই তিনি শ্রেয় মনে করেছেন। এ ধরনের একটি পরিবেশ তৈরির জন্য চেষ্টা যে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীরা একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় চালিয়ে যাচ্ছেন তা বিভিন্ন মিডিয়ায় তাদের দেয়া বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ফ্যাসিবাদীরা চাইলেও এখন এরশাদকে হটানোর মতো ইউনূসকে হটানোর এক দফা কর্মসূচিতে বিএনপি আওয়ামী লীগকে এক কাতারে আনা যাবে কি না সেই প্রশ্ন রয়ে গেছে। বেগম খালেদা জিয়া সক্ষম থাকতে সেটি সম্ভবত হওয়ার নয়। তিনি রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় নন। তবে সঙ্কটকালে তার হস্তক্ষেপে দেশ অনেক অযাচিত বিপর্যয় থেকে মুক্তি পেতে দেখা যাচ্ছে। প্রফেসর ইউনূস সরে যাবার যে অনমনীয় সিদ্ধান্তের দিকে যাচ্ছিলেন তা বন্ধের পেছনে এই প্রাজ্ঞ মহীয়সীর হাত রয়েছে বলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়। লন্ডন সফররত প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের একটি বৈঠকের কথা শোনা যাচ্ছে। সেটিও হয়ে থাকতে পারে এই প্রাজ্ঞ সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে। তার অভিভাবকত্ব বাইরের কোনো শক্তির শর্তের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া অথবা কোনো ফ্যাসিবাদী অলিগার্কের সহায়তা নেয়া বা একসময়ের মিত্রদের সাথে সঙ্ঘাতে না গিয়েও বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়ে যাওয়াকে সম্ভব করতে পারে। আর সেই নির্বাচিত সরকারের সামনে সংস্কার বা গণহত্যার বিচারে কোনো বাধা থাকবে বলে মনে হয় না। এই পথটি এখনো ধরাছোঁয়ার ভেতরেই রয়েছে। বেগম জিয়ার নির্দেশনা মানলে বিএনপি সে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে।
কেন এটি তাৎপর্যপূর্ণ?
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া বলতেন ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, আর দলের চেয়ে বড় রাষ্ট্র। বেগম জিয়াও এই উক্তিটি প্রায়ই পুনরুল্লেখ করতেন। জিয়ার কাছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ‘ক্ষমতা’ নয়, বরং মূল ছিল একটি জাতির স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকার বা এখতিয়ারের বিষয়টি। এই এখতিয়ারটি হারানোর পথ ধরেই হায়দরাবাদ বা সিকিমের মতো এই অঞ্চলের অনেক দেশ মানচিত্র হারিয়েছে। বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশে যারা এখন ক্ষমতায় রয়েছে তাদের রাজনৈতিক অন্তর্দর্শন হলো অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠা করা। সেটি কেবল সম্ভব হতে পারে এই অঞ্চলের অন্য স্বাধীন দেশের মানচিত্র বিলুপ্তির বিনিময়ে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের সন্ধিক্ষণকালে ক্ষমতা থাকা না থাকার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, জাতি নিজের ভবিষ্যৎ নিজে নির্ধারণ করতে পারছে কি না। যখন জাতির ওপর বাইরের কোনো চাপ, প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ থাকে, তখন সেই জাতি কার্যত স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, যদিও তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ক্ষমতা’ থাকে। আর ইতিহাসে অনেক জাতি রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পরও প্রকৃত অর্থে নীতিনির্ধারণে স্বাধীন ছিল না। প্রভাবশালী রাষ্ট্র বা সংস্থার চাপ তাদের অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। তখন দেখা যায়, ক্ষমতা তত্ত্বাবধানমূলক হলেও সিদ্ধান্তের এখতিয়ার প্রকৃত অর্থে অন্য কারো হাতে। নতুন ঔপনিবেশিকতার একটি ধারণাও এর সাথে প্রাসঙ্গিক। এটি এমন এক পরিস্থিতি যেখানে একটি রাষ্ট্র স্বাধীন হলেও বিদেশী শক্তি বা বহুজাতিক কোম্পানি প্রভাব বিস্তার করে রাখে। তখন দেশের সরকার কিছু করতে চাইলেও পারে না।
আবার যখন কোনো সরকার বা নেতৃত্ব জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করে বা বাইরের শক্তির চাপ মেনে সিদ্ধান্ত নেয়, তখন প্রশ্ন ওঠে— এটা কি সত্যিকারের ‘ক্ষমতা’, নাকি নিছক আনুষ্ঠানিকতা? কোনো দেশ যখন এমন চুক্তি করে যাতে তাদের কৌশলগত সিদ্ধান্ত অন্য দেশের সাথে ভাগ করে নিতে হয় বা অন্য দেশের অনুমোদন লাগে, তখন জাতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় বিদ্যুৎ, গ্যাস, বা পানিসম্পদ ইস্যুতে আন্তর্জাতিক চাপের ফলে সিদ্ধান্ত নেয়া নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে এমন বক্তব্য সামনে আসে, যা ক্ষমতার চেয়ে ‘স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার’কে বড় করে দেখে।
বাংলাদেশ-প্রেক্ষিত
বাংলাদেশ-প্রেক্ষিতে ‘ক্ষমতা নয়, জাতির স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার হারানোর’ বক্তব্যটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বাস্তবতায়। বাংলাদেশ বহু বছর ধরে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবির শর্তসাপেক্ষ ঋণ গ্রহণের ফলে অনেক সময় জাতীয় বাজেট ও খাতভিত্তিক বিনিয়োগ পরিকল্পনা তাদের পরামর্শ অনুযায়ী গৃহীত হয়। তাদের শর্তে জ্বালানি ভর্তুকি কমানো, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, বা ব্যাংক খাত সংস্কার জাতীয় নীতির চেয়ে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চাপে বাস্তবায়িত হয়। এখানে সরকার ‘ক্ষমতায়’ থেকেও অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীন থাকে না।
আবার বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের স্বার্থ এখানে জড়িত। ভারতের সাথে পানি, সীমান্ত বা নিরাপত্তা চুক্তি নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক হয়— জাতীয় স্বার্থ কতটা রক্ষা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আবার যখন জনগণ সুষ্ঠুভাবে সরকার নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না বা বিরোধী কণ্ঠকে দমন করা হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে— জাতির ইচ্ছা অনুযায়ী কি সিদ্ধান্ত হচ্ছে? এমন বাস্তবতায় ক্ষমতা ‘কেন্দ্রীয়ভাবে’ থাকলেও ‘জাতির’ মতামত অনুযায়ী তা পরিচালিত হয় না। এখানেই থাকে এখতিয়ারের সঙ্কট।
তবে এটি ঠিক যে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা মানেই পরাধীনতা নয়। বৈশ্বিক সংস্থার সাথে কাজ করা আধুনিক রাষ্ট্রচালনার বাস্তবতা। সেটি সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার হারানো নয়, বরং কৌশলগত প্রয়োজনে করা সহযোগিতা। এক্ষেত্রে ক্ষমতা বনাম এখতিয়ারের বিষয়টি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতা মানে হলো শাসনের অধিকার, প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ, নীতি প্রণয়ন করার সাংবিধানিক ও কার্যকরী ক্ষমতা। কিন্তু এখতিয়ার মানে হলো— কে সেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে? কিভাবে নিচ্ছে? সেটা জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী কি না। বাংলাদেশে অনেক সময় দেখা যায়, ক্ষমতা একটি নির্দিষ্ট শ্রেণী বা দলের হাতে কেন্দ্রীভূত হলেও, জাতি হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রকৃত সুযোগ বা অংশগ্রহণ সীমিত। এটাই এখতিয়ারের ক্ষয়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জাতির সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার প্রতিফলিত হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। তবে যদি নির্বাচন বিতর্কিত, অংশগ্রহণহীন বা দুর্বল হয়, তাহলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। যেখানে জনগণের মতপ্রকাশের সুযোগ নেই, সেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ফলে ক্ষমতা থেকে জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের সংবিধান জনগণকে সর্বময় ক্ষমতার উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু যদি সেই ক্ষমতার প্রয়োগ বাস্তবে জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী না হয়, তবে তা এখতিয়ারের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
‘ক্ষমতা’ থাকা মানেই জাতি স্বাধীন নয়। একটি জাতির প্রকৃত স্বাধীনতা তখনই নিশ্চিত হয়, যখন তারা বাইরের প্রভাব বা অভ্যন্তরীণ দমন ছাড়া নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে এই এখতিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায়, নতুন করে ‘সার্বভৌম সিদ্ধান্ত’ প্রতিষ্ঠার টেকসই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি সামনে আসছে। জাতির স্বার্থে প্রয়োজন একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও বহুমাত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোর, যেখানে সিদ্ধান্ত আসবে জনগণের পক্ষ থেকে, জনগণের জন্য। এটি সম্পন্ন করতে হবে এই অন্তর্বর্তী সরকারকে। সেটি করার সুযোগ রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে দেশের স্বার্থে দিতে হবে।