ডান হাত, বাঁ হাত এবং অজুহাত

 

বলা হয়ে থাকে, হাত তিন প্রকার—ডান হাত, বাঁ হাত আর অজুহাত। শেষের দিক থেকে, অর্থাৎ অজুহাত দিয়ে শুরু করি। ক্রমান্বয়ে বাঁ হাত ও ডান হাত নিয়ে কথা বলব। দেশে এখন সর্বত্র অজুহাতের ছড়াছড়ি। ক্রিকেট, অর্থনীতি, রাজনীতি—সব ক্ষেত্রেই এর বিস্তার। সরকারি দল, বিরোধী দল সবাই অজুহাতের দোহাই দিচ্ছে।

বিশ্বকাপ ক্রিকেট

এক দিনের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বাছাইপর্ব প্রায় শেষে এখন সেমিফাইনাল পর্বে কারা খেলবে, তা নির্ধারিত হচ্ছে। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা ইতিমধ্যে সেমিফাইনালে খেলা নিশ্চিত করেছে। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডেরও সম্ভাবনা ভালো। তবে বাগড়া দিতে পারে আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তান। প্রতিযোগিতা থেকে ইতিমধ্যে ছিটকে পড়েছে বাংলাদেশ, ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও প্রথমবারের মতো খেলতে আসা নেদারল্যান্ডস। অথচ খেলতে যাওয়ার আগে কত আশার বাণী—বাংলাদেশ সেমিফাইনাল তো খেলবেই, শিরোপা জেতারও সম্ভাবনা ভালো!

টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি রান করবে লিটন কিংবা তানজিদ। অথচ দেখা গেল, একমাত্র মাহমুদউল্লাহ দাঁড়িয়ে, যাকে কিনা টিম থেকে বাদ দেওয়ার কম চেষ্টা করেনি বিসিবি, নির্বাচক, কোচ ও অধিনায়ক। এখন অজুহাত শুনতে হচ্ছে, একটা টুর্নামেন্টে যেকোনো দল খারাপ খেলতেই পারে। দেখেন না গতবারের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের কী অবস্থা! বাংলাদেশের সঙ্গে তলানির সর্বশেষ স্থানের প্রতিযোগিতায় মেতেছে। ভালো কথা, আগে ইংল্যান্ডের মতো বাংলাদেশ কোনো একটা শিরোপা জিতুক, তারপর আমরা এ ধরনের অজুহাত মেনে নেব। আরও অজুহাত ছিল, তামিমকে ফিটনেসের অভাবে নেওয়া যাবে না। অথচ বিশ্বকাপজুড়ে দেখলাম ইনজুরির ছড়াছড়ি।

আসলে এগুলো কোনো অজুহাতই নয়। আসল কারণ হলো বাংলাদেশ ক্রিকেটে দীর্ঘদিন ধরে বাঁ হাতের রাজত্ব চলছে। না হলে মেয়াদোত্তীর্ণ সভাপতি, বিভিন্ন দেশে বারবার পরিত্যক্ত কোচ নিয়োগ, অথর্ব নির্বাচকমণ্ডলী আর ব্যবসায়ী ক্যাপ্টেন নিয়ে বিশ্বকাপে দল পাঠানো হলো কীভাবে? ফলাফল যা হওয়ার কথা ছিল, তা-ই হয়েছে।

বেহাল অর্থনীতি নিয়েও অজুহাতের অন্ত নেই। প্রথমে ছিল কোভিড-১৯, তারপর এল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, এখন নতুন করে শুরু হয়েছে ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের আগ্রাসন। সামনে আসছে বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধের অজুহাত, তাতে এক ঢিলে দুই পাখি মরবে। অথচ দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক সংকটের অনেকটাই অভ্যন্তরীণভাবে সৃষ্ট।

দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি

নাগরিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি। এ নিয়ে বহুবার লিখেছি যে মূল্যস্ফীতির কারণ আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে ভ্রান্ত নীতি ও দেশীয় পণ্যের ক্ষেত্রে পরিবহন খাতে ব্যাপক চাঁদাবাজি। দুই বাজারেই রয়েছে সিন্ডিকেটের কালো থাবার বিস্তার। নব্বইয়ের দশকে আমি অর্থনীতি উদারীকরণ ও আমদানি নীতি সংস্কারের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সে সময় যেকোনো কিছু আমদানি করতে লাইসেন্স লাগত। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিই, সাধারণভাবে কোনো পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে পূর্বানুমতির প্রয়োজন হবে না, অবাধে আমদানি করা যাবে। ক্ষুদ্র একটি সংরক্ষিত পণ্যতালিকা থাকবে, যা আমদানি করতে পূর্বানুমতির প্রয়োজন হবে। হাতে গোনা কয়েকটি পণ্য থাকবে, যার আমদানি হবে নিষিদ্ধ। অর্থাৎ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দৈনন্দিন বাজার ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করবে না।

এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্যতেল, চিনির বাজারমূল্য নির্ধারণ করে এবং তা কার্যকর হয় না। তারা ডিম আমদানির অনুমতি দিলে তা আসে অনেক বিলম্বে। ডিমের দাম বাড়তে থাকে। হিমাগারের মালিকেরা সিন্ডিকেট করে আলুর দাম বাড়ায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তাতে সায় দেয়, আলুর মূল্য নির্ধারণ করে এবং আলুর বাজারমূল্য হয় তাদের নির্ধারিত মূল্য থেকে অনেক বেশি। কিন্তু উৎপাদক পর্যায়ে চাষি এ উচ্চমূল্যের কোনো ভাগই পায় না।

গত শনিবারও ধামরাইয়ের শৈলান বাজার থেকে লালশাক কিনলাম তিন আঁটি ২০ টাকায়। আঁটিতে শাকের পরিমাণ ঢাকার দেড় গুণ। ঢাকায় এক আঁটি লালশাকের দাম ২৫ টাকা। ঢাকার ১০০ টাকা মূল্যের লালশাক ধামরাই থেকে কিনলাম মাত্র ২০ টাকায়, অর্থাৎ আমদানি করা ও দেশীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতির মূল কারণ বাঁ হাতের কারসাজি।

বৈদেশিক রিজার্ভ ও মুদ্রার বিনিময় হার

সম্ভবত ২০১৩ সালে পদ্মা সেতু বিষয়ে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবকাঠামো খাতে ব্যবহার করা সুবিবেচনাপ্রসূত হবে না। তখন কেউ কেউ বললেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সামান্য সুদে অলস ফেলে রেখে লাভ কী? পরিণতি যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে। হু হু করে রিজার্ভ কমছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে বারবার লিখেছি। সবাই তখন বলেছেন, টাকার ব্যাপক দরপতন হবে। এত সব করেও ডলারের মূল্য ৮০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১১৫ টাকা ছুঁই ছুঁই করছে। বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে পাচারের আগের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলা হয়েছে।

ব্যাংকঋণের সুদের হার ও বৈদেশিক ঋণ

ব্যবসায়ী ও ব্যাংকের মালিকদের পরামর্শে ব্যাংকে আমানত ও ঋণের সুদের হার বিষয়ে লিখেছিলাম, ‘সঞ্চয়কারীরা অপরাধী নন’ ও ‘অর্থনীতি নিয়ে নয়ছয় বন্ধ হোক’। কিছু পাঠক আমার তখনকার আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে তাঁদের ফেসবুক পোস্টে লেখাগুলো শেয়ার করেছেন। সেসব লেখায় যা বলেছিলাম তা-ই হয়েছে, জনগণের আর্থিক নিপীড়নের ফল ভালো হয়নি, খেলাপি ঋণ বহুগুণে বেড়েছে, ব্যাংকে আমানত ও ঋণের সুদের হারের ওপর নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হয়েছে, দুটোই এখন বাড়ছে।

বাণিজ্যিক শর্তে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ সীমিত করার কথা বারবার বলেছি। বলেছি, আজ লাইবর (বাণিজ্যিক ঋণের সুদ নির্ধারণের ভাসমান ভিত্তি) হার কম মানেই ভবিষ্যতে তা বাড়বে। বাস্তবেও তাই হয়েছে, লাইবর বেড়েছে, বেড়েছে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের দায়ভার। তখন উন্নয়নের দোহাই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেউ বলছে না, পদ্মা সেতুসহ আমাদের সব উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় নিকটবর্তী দেশের তুলনায় তিন গুণ, এবং বাস্তবায়নের সময় দ্বিগুণ কেন? কাদের পকেটে যাচ্ছে উন্নয়নের এসব সুফল! সার্বিকভাবে বলা যায়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বাঁহাতি কুশীলবদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ সুস্পষ্ট।

  • মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ
  • সূত্র : প্রথম আলো