প্রবাসী শ্রমিকরাই দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান

প্রবাসী শ্রমিকরাই দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। – ছবি : সংগৃহীত

বর্তমানে প্রবাসে বিভিন্ন পেশায় বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে। প্রবাসী শ্রমিকদের একটি বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন ও ওমান- এ কয়েকটি দেশে সর্বাধিক প্রবাসী শ্রমিক কর্মরত। এ ছাড়া জর্দান ও ইরাকে স্বল্পসংখ্যক শ্রমিক কর্মরত। আফ্রিকার কিছু দেশে বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিক ও কৃষিশ্রমিক রয়েছে। সার্কভুক্ত দেশ মালদ্বীপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশের শ্রমিকরা কর্মরত রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত শ্রমিকরা নির্মাণশিল্পে, সড়ক ও স্থাপনায় পরিচ্ছন্নতা কর্মে, গৃহকর্মে, কৃষিকর্মে, দোকান ও বিপণিতে বিক্রয়কর্মে, কলকারখানার শ্রমিক হিসেবে এবং হোটেল-রেস্তোরাঁয় বিভিন্ন কর্মে ও পেশায় নিয়োজিত।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে মধ্যপ্রাচ্যের মতো অনুরূপ পেশায় বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে স্বল্পসংখ্যক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। মালদ্বীপে কর্মরত প্রবাসী শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশী শ্রমিক। আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে অতীতে লিবিয়ায় বাংলাদেশী অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছিল। দীর্ঘ দিনের শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে যুদ্ধে পরাস্ত ও হত্যাপরবর্তী দেশটির অর্থনীতি মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হলে সেখানে উৎপাদন কার্যক্রম স্থবির হয়ে যায়। সেই স্থবিরতার রেষ এখনো কাটেনি। লিবিয়াফেরত শ্রমিকরা পুনরায় দেশটিতে ফেরত যেতে পারেনি এবং দেশটির শ্রমবাজার এখনো প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মের জন্য অনুকূল নয়। আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্র মাদাগাস্কার ও মরিশাসে পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের বেশ কিছু শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এদের অধিকাংশই দক্ষ। ইউরোপের কিছু কিছু দেশে বাংলাদেশের শ্রমিকদের কৃষিক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগের পরিধি বিস্তৃত হওয়ার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে কর্মসংস্থানের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিকদের অত্যন্ত নগণ্যসংখ্যক পরিবার-পরিজন নিয়ে সেখানে বসবাস করে। পরিবারসমেত বসবাসরত শ্রমিকদের স্বামী-স্ত্রী উভয়ই শ্রমে নিয়োজিত এমনটিই দেখা যায়। এদের বছরান্তে দেশে আসার খুব একটা আবশ্যকতা দেখা দেয় না; কিন্তু যেসব শ্রমিক একাকিত্ব নিয়ে বসবাস করে তাদের এক, দুই বা তিন বছর পর দেশে আসা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। প্রবাসে একাকী বসবাসরত শ্রমিকরা সেখানে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন এমন অর্থ অত্যন্ত সংযমের সাথে ব্যবহার করে উপার্জিত অর্থের বেশির ভাগ দেশে বসবাসরত পরিজনের কাছে প্রেরণ করে। প্রবাসে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে এ ধরনের শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। এদের প্রেরিত অর্থের কারণে ও প্রবাসী শ্রমিকদের মাধ্যমে প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার কারণে আমাদের আমদানি-রফতানি ব্যয়ের ঘাটতি ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধে খুব একটা অসুবিধার সম্মুখীন হই না। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার দীর্ঘ দিন যাবৎ যে একটি সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে এর পেছনে মূল অবদান হলো প্রবাসে কর্মরত শ্রমিকদের। প্রবাসে কর্মরত শ্রমিকরা দেশের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে দিলেও তারা বা তাদের পরিজন এ অর্থ ব্যয় করে বিদেশে বিলাস ভ্রমণ ও সম্পদ আহরণে ব্যয় করে না।

বিদেশে কর্মরত শ্রমিকরা বৈধ (ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জ) ও অবৈধ (হুন্ডি) উভয় পন্থায় দেশে অর্থ প্রেরণ করে থাকে; তবে শ্রমিকদের মধ্যে বেশির ভাগই বৈধ পন্থায় অর্থ প্রেরণ করে থাকে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের তিনটি বিনিময় হার কার্যকর রয়েছে। এর একটি হলো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত বিনিময় হার। অপর দু’টির একটি হলো আন্তঃব্যাংক নির্ধারিত বিনিময় হার এবং অন্যটি খোলা বাজারের (কার্ব মার্কেট) বিনিময় হার। এ তিনটি হারের একটির সাথে অপরটির বেশ ফারাক। আবার আন্তঃব্যাংক নির্ধারিত বিনিময় হারের ক্ষেত্রে দেখা যায় তা সমরূপ নয়। বিগত দুই বছর যাবৎ সরকারের পক্ষ হতে বৈধ পন্থায় অর্থ প্রেরণকারীদের প্রথমত শতকরা দুই এবং পরবর্তী সময়ে আড়াই ভাগ হারে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে; কিন্তু মুদ্রার বিনিময়ের তিনটি হারের একটির সাথে অপরটির ব্যাপক ফারাকের কারণে সরকার প্রদত্ত প্রণোদনা অর্থ প্রেরণকারীদের বৈধ পন্থায় অর্থ প্রেরণে আরো অধিক আগ্রহী করতে পারছে না। বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর খুব কমসংখ্যক দেশে মুদ্রার এ ধরনের তিনটি বিনিময় হার চালু রয়েছে। এ ধরনের তারতম্যপূর্ণ বিনিময় হারের অবসান ঘটানো না গেলে অবৈধ পন্থায় অর্থ প্রেরণ রোধ করা খুবই দুরূহ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৬০-৭০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যের এলসিতে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা অর্থ পাচার করে মর্মে অভিযোগ রয়েছে। এ দেশের ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও সরকারি চাকরিজীবীদের একটি অংশ তাদের নিজেদের ও তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। এদের অনেকেই তাদের দুর্নীতিলব্ধ অর্থের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে সম্পদ পাচার করে সেখানে সুখের নীড় গড়ে এ দেশ থেকে দেশান্তরী হচ্ছে। দেশ তাদের অনেক কিছু দিলেও এরা দেশের প্রতি মোটেই দায়বদ্ধ নয়। অর্থপাচারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রেটির তথ্য মতে, গত এক দশকে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ১১ লাখ কোটি টাকার কম নয়। বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ দেশে বিনিয়োগ করা গেলে দেশের অর্থনীতি বেগবান হতো এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতো।

প্রবাসে কর্মরত শ্রমিক বাংলাদেশের জন্য প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে দিচ্ছে তাদের নিজেদের জন্য অথবা তাদের পরিজনের জন্য এর ক্ষুদ্রতম অংশও ব্যয় হয় না। এসব শ্রমিক বা তাদের পরিজনের কেউ অসুস্থ হলে তারা নিজ দেশেই চিকিৎসা গ্রহণ করে এবং তাদের ছেলেমেয়েরা নিজ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই অধ্যয়ন করে। বিদেশে কর্মরত শ্রমিক বা তাদের পরিজনরা বিলাস ভ্রমণে দেশের বাইরে ঘুরতে যাওয়ার ঘটনা বিরল। এর বিপরীতে এ দেশের যারা পরিবার-পরিজন নিয়ে মাঝে মধ্যে আনন্দ ভ্রমণে বিদেশ গমন করে, একাধিকবার হজ ও ওমরা পালন করে, সন্তানদের বিদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ানোয় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তাদের অনেকেরই বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে কোনো অবদান নেই অথচ যাদের অবদানের কারণে বৈদেশিক মুদ্রা সহজলভ্য এর সুফলভোগী তারা নয়; বরং এ দেশের একশ্রেণীর ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও সরকারি চাকরিজীবী।

প্রবাসে কর্মরত শ্রমিকরা বিদেশে যাওয়ার পথে এবং বিদেশ থেকে ফেরার পথে দেশের প্রধান বিমানবন্দরে সরকারের পুলিশ বিভাগের বহির্গমনে কর্মরত ব্যক্তি, কাস্টমসে কর্মরত ব্যক্তি এবং বিমানবন্দরে কর্মরত অন্যান্য সংস্থার ব্যক্তিদের দ্বারা প্রায়ই হয়রানি ও নাজেহালের শিকার হয়। দেশের অর্থনীতিতে তাদের বিশাল যে অবদান এটার কোনো ধরনের মূল্যায়ন না করেই বিমানবন্দরে কর্মরত এ ধরনের ব্যক্তিরা তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে মিথ্যা ও অলীক কারণের সৃজনে অন্যায়ভাবে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারায় মত্ত থাকে। বিমানবন্দরে কর্মরত এ ধরনের ব্যক্তিদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এদের ওপর যথাযথ নজরদারি থাকলে প্রবাসী শ্রমিকদের হয়রানি ও নাজেহালের অনেকটাই উপশম হতো।

আমাদের দেশের তথাকথিত ভিআইপিদের জন্য বিমানবন্দরে সুযোগ-সুবিধার কোনো কমতি নেই। এদের জন্য রয়েছে একাধিক লাউঞ্জ। এদের আগমন ও প্রস্থানের সময় অভ্যর্থনা ও বিদায় জানাতে আসা ব্যক্তিদের কোনো ধরনের অর্থ প্রদান ব্যতিরেকেই লাউঞ্জ ও বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশাধিকার ঘটে। প্রস্থান ও আগমনের সময় এদের চেক ইন, ইমিগ্রেশন, মালামাল গ্রহণ প্রভৃতি কাজ নিজ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সম্পন্ন করে থাকে। এসব সুযোগ-সুবিধার কারণেই এদের আগমন ও প্রস্থানকালীন বিমানবন্দরের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। এসব তথাকথিত ভিআইপিদের একটি বড় অংশ দুর্নীতিগ্রস্ত। এদের অনেকেরই বিদেশে দ্বিতীয় আবাসস্থল রয়েছে আবার এদের অনেকের ছেলেমেয়েই বিদেশে স্থায়ীভাবে থিতু হয়েছে। এরা নিজেরাও চাকরি থেকে অবসর-পরবর্তী বিদেশে পাড়ি জমানোর ভাবনায় সদাসর্বদা মগ্ন। এদের আবশ্যিক কর্তব্য জনসেবা হলেও এরা জনসেবা প্রদানের চেয়ে নিজসেবা নিশ্চিতে অধিক উদগ্রীব।

বিমানবন্দরে তথাকথিত ভিআইপিরা যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে দেশের অর্থনীতিতে অবদানের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হলে এসব সুযোগ-সুবিধা তাদের আগে ভোগ করার কথা প্রবাসে কর্মরত শ্রমিকদের। আজ কে না জানে প্রবাসে কর্মরত শ্রমিকরা বিদেশ গমন ও বিদেশ থেকে আগমনে কিভাবে বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার ব্যক্তিদের দ্বারা আর্থিক ও মানসিক যাতনার শিকার হচ্ছে।

এ দেশের তথাকথিত ভিআইপিদের মূল কাজ হলো দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির সোপান প্রস্তুতিতে সহায়ক ভ‚মিকা রাখা। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য দেশীয় ও বৈদেশিক মুদ্রায় বিনিয়োগ প্রয়োজন। মূলত জনগণ প্রদত্ত কর হতেই প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধাদি নির্বাহসহ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অর্থের জোগান দেয়া হয়। তথাকথিত ভিআইপিদের মধ্যে সততা, দক্ষতা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেম উজ্জীবিত থাকলে তারা নিজেরা যেমন দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকবে এবং এর পাশাপাশি কর আহরণের লক্ষ্য পূরণে একাগ্র হবে। তাদের অনেকের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, তারা তাদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয় অবস্থান থেকে বিচ্যুত। দেশ এদের অনেক কিছু দিলেও এরা দেশ থেকে আরো প্রাপ্তির আশায় পরিতৃপ্ত নয়।

অপর দিকে প্রবাসে কর্মরত শ্রমিকরা নিরবচ্ছিন্নভাবে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিয়ে যেভাবে দেশের লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষায় অনন্য অবদান রেখে চলেছে তার গুরুত্ব অনুধাবনে আমরা কতটুকু সক্ষম? এ সক্ষমতার অভাবেই তাদের যথাযথ অবদান মূল্যায়িত হচ্ছে না। আর যতক্ষণ পর্যন্ত এ মূল্যায়নের ঘাটতি থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বাক্যটি তাদের জন্য কোনো সুফল বয়ে না এনে কথামালার মধ্যেই ঘুরপাক খাবে।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail : iktederahmed@yahoo.com