প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ এক-চতুর্থাংশ কমেছে

দেশের প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। গত ছয় মাসে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশ থেকে রেমিট্যান্স কমেছে ২৫ শতাংশের বেশি। যদিও গত তিন বছরেই ১৫ লাখ ২১ হাজার ১৪৭ জন বাংলাদেশী শ্রমিক কাজের উদ্দেশ্যে সৌদি অভিবাসী হয়েছেন।

সৌদি আরবের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকেও উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। গত তিন বছরে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহে যে উল্লম্ফন দেখা গিয়েছিল, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সেটি স্তিমিত হয়ে এসেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় গত ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স কমেছে ৪২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। রেমিট্যান্স প্রবাহে বিপর্যয়ের কারণে শীর্ষ থেকে চতুর্থ অবস্থানে নেমে গেছে যুক্তরাষ্ট্র।

সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বিপর্যয় হলেও এ সময়ে রেমিট্যান্স বেড়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) থেকে। গত ছয় মাসে মধ্যপ্রাচ্যের সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ ৪৮ শতাংশ বেড়েছে। এতে বাংলাদেশের শীর্ষ রেমিট্যান্স আহরণের দেশের তালিকায় শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে আরব আমিরাতের নাম।

সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশী, এক্সচেঞ্জ হাউজ, ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে কথা বলা হয়। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই বলছে, সৌদি আরবে রেকর্ডসংখ্যক বাংলাদেশী শ্রমিক অভিবাসী হলেও তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ এখন বেকার। অনেকে চাকরি পেলেও বেতন-ভাতা প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম। জীবন ধারণের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে মাস শেষে অনেক বাংলাদেশী শ্রমিকের হাতে দেশে পাঠানোর মতো উদ্বৃত্ত অর্থ থাকছে না। আবার সৌদি আরবে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের একটি বড় অংশের আয় এখন হুন্ডি কারবারিদের হাতে চলে যাচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় হুন্ডিতে ডলারের দর বেশি পাওয়ায় প্রবাসীরা হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশী কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সৌদি আরবে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের ঘিরে হুন্ডির জমজমাট ব্যবসা গড়ে তুলেছেন বলেও জানা গেছে।

সৌদি আরবের জেদ্দায় একটি ইলেকট্রিক পণ্যের দোকান চালান বাংলাদেশী আবু বকর। বাংলাদেশীদের দুর্দশার কথা জানিয়ে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘পুরো সৌদি আরবের পুরনো শহর ও মার্কেটগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ভেঙে ফেলা জায়গায় সরকার আধুনিক শহর ও মার্কেট বানাতে চায়। এসব এলাকায় কয়েক লাখ বাংলাদেশী উদ্যোক্তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দোকান ছিল। এ ব্যবসায়ীরাই সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠাতেন। শত শত পুরনো মার্কেট ভেঙে ফেলা কিংবা বন্ধ করে দেয়ার কারণে বাংলাদেশীদের আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে সৌদি সরকার আইন করে বিদেশী শ্রমিকদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাজে বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। বাংলাদেশীদের আয় কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসব আইনেরও প্রভাব রয়েছে।’

বহু বছর ধরেই বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয়ের শীর্ষ দেশ ছিল সৌদি আরব। আবার বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের প্রধান বাজারও ছিল দেশটি। বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশ থেকে কাজের উদ্দেশ্যে মোট ১ কোটি ৫৯ লাখ ৮০ হাজার ২৯০ জন বাংলাদেশী বিদেশ গেছেন। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবে অভিবাসী হয়েছেন ৫৭ লাখ ৩২ হাজার ৪৬২ জন বাংলাদেশী। অর্থাৎ দেশের মোট অভিবাসী শ্রমিকের ৩৫ দশমিক ৮৭ শতাংশই গেছেন সৌদি আরবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন সময়ে দেশে ফিরেও এসেছেন। তবে এ মুহূর্তে ঠিক কী পরিমাণ বাংলাদেশী সৌদি আরবে বসবাস করছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয়ও এ বিষয়ে সুর্নিদিষ্ট কোনো তথ্য নেই।

বিএমইটির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শুধু গত তিন বছরেই ১৫ লাখের বেশি বাংলাদেশী শ্রমিক সৌদি অভিবাসী হয়েছেন। এর মধ্যে ২০২১ সালে গেছেন ৪ লাখ ৫৭ হাজার ২২৭ জন। ২০২২ সালে ৬ লাখ ১২ হাজার ৪১৮ ও ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৪ লাখ ৫১ হাজার ৫০২ জন বাংলাদেশী সৌদি আরব গেছেন। সব মিলিয়ে গত তিন বছরে দেশটিতে অভিবাসী বাংলাদেশীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ লাখ ২১ হাজার ১৪৭। এত বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশী শ্রমিক নতুন করে যুক্ত হলেও সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ না বেড়ে উল্টো কমে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৪৫৪ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৩৭৬ কোটি ডলারে নেমে আসে। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশটি থেকে ১৪২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এর আগের অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশীরা ১৯০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছিলেন। সে হিসাবে গত ছয় মাসে প্রধান এ শ্রমবাজার থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ এক-চতুর্থাংশেরও বেশি কমে গেছে।

সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স বেশি আসে, এমন একটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত এক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার নিয়ে পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে। এ কারণে রেমিট্যান্সের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সৌদি আরবের অনেক মানি এক্সচেঞ্জ সংগৃহীত রেমিট্যান্স হুন্ডি কারবারিদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। কারণ তাদের প্রস্তাবিত দরে আমরা ডলার কিনতে পারিনি।’

গত ছয় মাসে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহের শীর্ষ দেশের তালিকায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাম উঠে এসেছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আমিরাত থেকে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৭ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে দেশটি থেকে ১৩৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরে দেশটি থেকে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। গত তিন বছরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজারে ২ লাখ ২১ হাজার ৫৫ জন বাংলাদেশী শ্রমিক যুক্ত হয়েছেন, সৌদি আরবে গমনের তুলনায় এ সংখ্যা খুবই কম।

প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালে প্রবাসী বাংলাদেশীরা মোট ২ হাজার ১৯১ কোটি বা ২১ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। ২০২২ সালে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে বিদায়ী বছরে প্রবাসীরা ৬৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স বেশি পাঠিয়েছেন। এক্ষেত্রে গত বছর রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথম ১১ মাসে (জানুয়ারি-নভেম্বর) রেকর্ড ১২ লাখ ১০ হাজার ২৫৬ জন বাংলাদেশী জীবিকার সন্ধানে অভিবাসী হয়েছেন। এর আগে ২০২২ সালে অভিবাসী বাংলাদেশীর সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩। অর্থাৎ গত দুই বছরে প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশী কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ গেলেও রেমিট্যান্স সে অনুপাতে বাড়েনি।

বনিক বার্তা