প্রধান বিচারপতির উৎকণ্ঠা ইতিবাচক

আসিফ নজরুল : বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান একজন সম্মানিত মানুষ। সম্প্রতি ঢাকায় মানবাধিকার সুরক্ষাবিষয়ক একটি কর্মশালায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছেন। দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করেই সম্ভবত তিনি বলেছেন, আন্দোলনকারীদের মানবাধিকার আছে, পুলিশেরও মানবাধিকার আছে এবং সবার মানবাধিকার রক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।

প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্য সঠিক। আমাদের সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার রয়েছে। এমনকি অপরাধী, চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী বা আন্দোলনকালে আগুন, গানপাউডার বা লগি-বইঠা দিয়ে হত্যাকারী হিসেবে অভিযুক্ত মানুষ—তাদেরও মানবাধিকার রয়েছে। যেমন তারা প্রত্যেকে সমানভাবে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারী। সংবিধান অনুসারে, তাদের বিনা বিচারে মেরে ফেলা বা শারীরিকভাবে জখম করা বা এর হুমকি পর্যন্ত দেওয়া যাবে না।

জীবনের অধিকার, নির্যাতনমুক্ত থাকার ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার—এ ধরনের অধিকারগুলো নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার। এগুলোকে আমাদের সংবিধানে উচ্চতর মর্যাদা দিয়ে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ফলে এগুলো লঙ্ঘিত হলে সরাসরি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে প্রতিকারের জন্য যাওয়া যায়। বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামোয় উচ্চ আদালতের প্রধান দায়িত্বই হচ্ছে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা এবং এ ধরনের অধিকারগুলো প্রধানত সরকার লঙ্ঘন করে বলে সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনা।

কাজেই এটি আশাপ্রদ যে প্রধান বিচারপতি সব নাগরিকের এসব মৌলিক অধিকার রক্ষার গুরুত্বের কথা বলেছেন। তিনি অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে এ–ও বলেছেন, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ঘটেছে। আমরা ২৮ অক্টোবর এবং পরের বিভিন্ন ঘটনায় তাঁর বক্তব্যের প্রতিফলন খুঁজে পাই। এসব ঘটনায় একজন পুলিশ সদস্য, কয়েকজন আন্দোলনকারী বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী নিহত হয়েছেন। বিরোধী দলের বহু কর্মী ও পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। মানবাধিকার ধারণার ভার্টিক্যাল (সরকার কর্তৃক নাগরিকের) এবং হরাইজন্টাল (নাগরিক বনাম নাগরিক) প্রয়োগের বিতর্ক বাদ দিলে আমরা বলতে পারি, এসব ঘটনার প্রতিটিতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে (এবং একই সঙ্গে ফৌজদারি আইনে অপরাধ হয়েছে)।

তবে আমরা এসব ক্ষেত্রে পুলিশকে তাদের ওপর আক্রমণের ঘটনার জন্য যেভাবে মামলা ও গ্রেপ্তারে উদ্যোগী হতে দেখেছি, বিরোধী দলের কর্মীদের হত্যার ঘটনায় সে রকম কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। গত বছর মাঝামাঝি সময় থেকে বিরোধী দলের আন্দোলন শুরু হওয়ার পর তাদের ২৭ জন কর্মীকে হত্যার এবং আরও অনেককে আহত করার অভিযোগ রয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে কি মামলা বা গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে?

আমাদের সংবিধান অনুসারে সবাই আইনের চোখে সমান এবং সবাই সমানভাবে আইনের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী। ওপরের ঘটনাবলিতে আইনের চোখে সবাইকে সমানভাবে দেখা হয়েছে কি না, সেটি তদারক করার এখতিয়ার সর্বোচ্চ আদালতের রয়েছে। প্রধান বিচারপতি সবার মানবাধিকারের যে বিষয় আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তাতে এমন উদ্যোগ সর্বোচ্চ আদালত গ্রহণ করবেন বলে আশা রাখি।

২.

প্রধান বিচারপতি মানবাধিকারের ধারণা হৃদয়ঙ্গম করতে আমাদের অনেকের সীমাবদ্ধতার দিকেও ইঙ্গিত করেছেন। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এমনকি মানবাধিকার কমিশন, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মীদের মধ্যেও এ বিষয়ে উপলব্ধির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মানবাধিকার কমিশন বহুলাংশে সরকারনিয়ন্ত্রিত একটি প্রতিষ্ঠান, এখানে নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমানে সরকারের পছন্দমতো অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। নিয়োগ, জনবলকাঠামো ও আর্থিক ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণের কারণে এ প্রতিষ্ঠানকে আমরা গুম, খুন, গায়েবি মামলা, নির্বিচার গ্রেপ্তারের মতো সাম্প্রতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে দেখি না।

বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলোয় এসব সীমাবদ্ধতা নেই। শুধু বৈদেশিক অনুদানের ক্ষেত্রে তাদের সরকারি ছাড়পত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও সমস্যা হলে আমরা তাদের অতীতে একসঙ্গে সোচ্চার হতে দেখতাম। এখন তারা কেন গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় আগের মতো ভূমিকা পালন করতে পারছে না—এটি তারা স্পষ্ট করে বলছে না।

বেসরকারি সংগঠনের ব্যানার ছাড়াও আমাদের মানবাধিকারকর্মীরা ব্যক্তিগতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনে তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকেন বা বিভিন্নভাবে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন। কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই বিষয়টি দেখেন খণ্ডিতভাবে। যেমন কারও কাছে শুধু সংখ্যালঘুদের, কারও কাছে শুধু বিরোধী দলের সদস্যদের, কারও কাছে শুধু আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর মানবাধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। এটি অন্য সবার জন্য স্বাভাবিক হলেও মানবাধিকারকর্মী হিসেবে পরিচিত বা মানবাধিকার সংগঠনে নেতৃত্বদানে অভিজ্ঞ কারও কাছে মোটেও প্রত্যাশিত নয়।

একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বুঝিয়ে বলি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে শিবির সন্দেহে কাউকে গ্রেপ্তার বা পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করার সংবাদ পত্রিকায় দেখে আসছি। এটি বাংলাদেশের সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কারণ, শিবির সন্দেহে কাউকে পেটানো বা গ্রেপ্তার করা যাবে—এ ধরনের কোনো আইন দেশে নেই এবং আইন ব্যতিরেকে এসব সম্পাদন সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। এরপরও রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান বা মানবাধিকার সংগঠন বা মানবাধিকার ব্যক্তিত্বকে এ বিষয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না। এটি এমনই স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে যে কোনো গণমাধ্যমকেও এ প্রশ্ন তুলতে দেখা যায় না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, মানবাধিকার শুধু আমার পছন্দনীয় ব্যক্তির অধিকার নয়, এটি সবার অধিকার; আমি পছন্দ করি না—এমন রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মানুষেরও সমানাধিকার। এই নিরেট সত্য মানবাধিকার বাস্তবায়নে বিভিন্নভাবে দায়িত্ব পালনরত ব্যক্তিরা মনে রাখতে না পারলে মানবাধিকার বিপর্যস্ত হতে বাধ্য।

৩.

প্রধান বিচারপতি তাঁর বক্তৃতায় রাজনৈতিক শিষ্টাচারের প্রয়োজনের কথাও বলেছেন, রাজনৈতিক মতভেদ থাকলেও একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন।

আমরা বহুদিন যাবৎ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর অভাব দেখতে পেয়েছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সেক্টর কমান্ডার ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কেও অরুচিকর ও আপত্তিকর মন্তব্য করতে দেখেছি। সম্প্রতি আমরা সংসদে পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সম্পর্কে অত্যন্ত অরুচিশীল শব্দাবলি ব্যবহৃত হতে দেখেছি। স্পিকার বা অন্য কোনো সংসদ সদস্যকে এসব শব্দ যে অসংসদীয় হতে পারে, সে আলোচনা তোলার কোনো উদাহরণও আমরা দেখি না এখন। সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিদ্বেষমূলক ও শিষ্টাচারহীন বক্তব্য অনুগত রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে আক্রমণাত্মক আচরণে উৎসাহিত করে, সার্বিকভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সমাজে এবং মানবাধিকার সংস্কৃতিতে। এসব নিয়ে সমাজে এখন আর তেমন কোনো উৎকণ্ঠা প্রকাশিত হতে দেখি না।

বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি মানবাধিকারের সর্বজনীনতা ও রাজনৈতিক শিষ্টাচারের প্রয়োজনকে তুলে ধরেছেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে দিয়ে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করেননি। কিন্তু এ নিয়ে সমাজে মুক্ত ও বিস্তারিত আলোচনা থাকলে তা মানবাধিকার প্রসারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক

প্রথম আলো