পেঁয়াজ ভার্সিটির ভিসি ড. পেঁয়াজুর আত্মকথা
- গোলাম মাওলা রনি ২১ নভেম্বর ২০১৯
দেশ বিদেশের লোকজন আমাকে ড. পেঁয়াজু নামে চিনলেও আদতে কিন্তু এটি আমার নাম ছিল না। আমার মূল নাম বুঙ্গা ডি গুংগা। কঙ্গোর রাজধানী জায়ারের আলোচিত শহরতলি জারুয়া অঞ্চলের একটি নামকরা পরিবারে আমার জন্ম হয়েছিল। আপনারা শুনলে হয়তো অবাক হবেন যে, আমার বংশের নামও জারুয়া। আমার বংশের নানাবিধ কীর্তিকলাপ, কাণ্ডকারখানা এবং বংশের লোকদের সংখ্যাধিক্যের কারণে এলাকার নামটিও জারুয়া হয়ে যায়। জারুয়া শব্দটি কনুই উপভাষার অন্তর্গত, যার অর্থ হলো অর্ধ উন্মাদ মস্তিষ্কের বেপরোয়া চালচলন। আমার বংশের বেশির ভাগ লোকই রাগচণ্ডাল স্বভাবের এবং অদ্ভুত সব আচরণের অধিকারী। আমার নিজের আচরণও ভালো নয়। অনেক বিষয় নিয়ে আমার আধিখ্যেতা বা ন্যাকামি দেখে মাঝে মধ্যে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই এবং আমার নির্বুদ্ধিতা তথা মোটা মাথার সাথে পাল্লা দিয়ে আমি কী করে দুনিয়াজোড়া সুখ্যাতি পেলাম এবং সফলতার স্বর্ণশিখরে পৌঁছালাম তা ভাবলে আমার মাথার তারমার সব আউলা-ঝাউলা হয়ে যায়।
আমার জীবনের কুখ্যাতি শুরু হয়েছিল পেঁয়াজ নিয়ে এবং পরবর্তী জীবনের সফলতাও পেঁয়াজকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। একজন জারুয়া বংশজাত বুঙ্গা ডি গুংগা কেবলমাত্র পেঁয়াজ নিয়ে পাগলামো করতে গিয়ে কিভাবে দুনিয়ার সর্বকালের সেরা পেঁয়াজ বিশেষজ্ঞরূপে প্রতিষ্ঠা পেল সেই কাহিনীই আজ আমি আপনাদের শোনাব। আপনারা যারা আমাকে চেনেন তারা হয়তো আমার আজকের কথাবার্তা শুনে অবাক হয়ে ভাবতে পারেনÑ আমি হয়তো আমার বংশজাত উপাধির অর্ধ উন্মাদ থেকে পুরো উন্মাদে পরিণত হয়েছি। কারণ যে লোকটি সারা জীবন একজন কুখ্যাত স্বৈরশাসকের দোসর হিসেবে সব সুবিধা ভোগ করার পর বুঙ্গা থেকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছেন এবং সারাটি জীবন অসংখ্য মিথ্যার বেসাতি করে আজ সত্য শোনাতে এসেছে! আপনারা যারা আমার বিরুদ্ধে এসব কথা বলবেন আমি তাদের মোকাবেলায় কোনো রকম আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করব না। শুধু এটুকুই বলব যে, জীবন সায়াহ্নে এসে আমার বারবার মৃত্যুর কথা মনে পড়ছে এবং সত্য কথা বলার জন্য আমি সত্যিই উন্মাদ হয়ে পড়েছি।
আজকের এই আত্মকথা লিখতে গিয়ে আমার প্রথমেই মনে পড়ছে, মরহুম আব্বা হুজুরের কথা, যিনি ছিলেন পুরো আফ্রিকা মহাদেশের পেঁয়াজ চোরাচালান সিন্ডিকেটের মুকুটবিহীন সম্রাট। আব্বার কারণেই আমি প্রথমে পেঁয়াজের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করি এবং আমার সেই আকর্ষণ যখন পাগলামোর পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন লোকজন আমাকে পেঁয়াজু বলে ডাকতে আরম্ভ করে। লোকজনের ঠাট্টা-মশকরার কারণে আমার মধ্যকার উদ্ভাবনী ক্ষমতা জেগে ওঠে এবং আমি পেঁয়াজের ব্যাপারে উচ্চতর লেখাপড়া ও গবেষণা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠি। আমার পিতা আমাকে ভুবনবিখ্যাত প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি করিয়ে দেন, যেখান থেকে আমি পেঁয়াজের জন্মরহস্য বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি লাভ করি। পরবর্তীকালে আব্বার কল্যাণে আমি আমাদের দেশের কুখ্যাত স্বৈরাচার সেনাশাসকের সঙ্গে পরিচিত হই এবং তাকে পেঁয়াজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করানোর ব্যাপারে রাজি করিয়ে ফেলি। এর পর থেকে আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
আলোচনার এই পর্যায়ে আপনারা হয়তো অনেকেই ভেবে অবাক হতে পারেন যে, একজন পেঁয়াজ চোরাকারবারির সাথে দেশের রাজা বাদশাহের সখ্যতা কিরূপে সম্ভব অথবা পেঁয়াজ চোরাকারবারি কেন নিজের ছেলেকে পেঁয়াজ বিষয়ে বিদেশে উচ্চতর শিক্ষার জন্য পাঠালেন অথবা বাদশাহ কেন পেঁয়াজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় রাজি হয়ে গেলেন! আপনারা যদি এসব প্রশ্নের সুন্দর সমীকরণ করতে চান তবে প্রথমেই জানতে হবেÑ লোকজন কেন আমাকে পেঁয়াজু বলে খেপাত! আগেই বলেছি যে, আমার বাবা শুধু কঙ্গো নয়- পুরো আফ্রিকার মধ্যে একজন নামকরা পেঁয়াজ চোরাকারবারি ছিলেন। আমাদের দেশে পেঁয়াজ চোরাকারবারির ব্যবসা সোনা-রুপা, মণি-মুক্তা, হিরা-জহরত কিংবা কোকেন-মরফিন-হেরোইনের চোরাচালানের চেয়ে বেশি লাভজনক এবং নিরাপদ। দেশের বিপুল ভোক্তাশ্রেণীকে জিম্মি করে এবং কৃষকদের বঞ্চিত করার মাধ্যমে চোরকারবারি চক্র রাষ্ট্রের দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারী এমনকি খোদ বাদশাহকে ম্যানেজ করে যেভাবে অর্থ লোপাট করতে পারে তা অন্য কোনো দুষ্কর্ম দিয়ে সম্ভব নয়।
কঙ্গোর পার্শ্ববর্তী দেশ গ্যাবন, ক্যামেরুন, জাম্বিয়া, উগান্ডা প্রভৃতি সব দেশেই পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়। আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ পেঁয়াজ উৎপাদনও যথেষ্ট ভালো। কিন্তু পেঁয়াজখেকো কঙ্গোবাসীর ক্রয়ক্ষমতা, পেঁয়াজ বাজারের পাইকারি মহাজন, আড়তদার-ফড়িয়া-দালাল ও খুচরা বিক্রেতাদের কারসাজি, রাষ্ট্রের ঘুষখোর কর্মকর্তাদের লোভের লম্বা জিহ্বা, সৎ কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা এবং চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্যের কারণে প্রায় প্রতি বছরই বৃহত্তর কঙ্গো অঞ্চলে পেঁয়াজ সঙ্কট দেখা দেয়। প্রায় দুই তিন দফার নিয়মিত সঙ্কটে প্রতি বছর চোরাকারবারিরা কম করে হলেও তিন হাজার কোটি ডলার লোপাট করে। আমাদের দেশে যখন পেঁয়াজের উৎপাদনের মৌসুম চলে তখন পেঁয়াজ সিন্ডিকেট তাদের কুকর্মের দোসর সরকারি আমলাদের ম্যানেজ করে একদিকে যেমন বৈধ আমদানি চালু রাখেÑ অন্য দিকে সীমান্তে চোরাচালান নির্বিঘœ করার জন্য সীমান্ত খুলে দেয়া হয়। ফলে দেশীয় কৃষক মার খায়। অনেকে তাদের উৎপাদিত পেঁয়াজ বিক্রি করতে না পেরে রাস্তায় ফেলে দেয়। আর এই সুযোগে চোরাকারবারিরা পানির দামে সেগুলো হাতিয়ে নেয়।
দেশীয় উৎপাদনের মৌসুমে চোরাকারবারিরা যেভাবে তৎপর থাকে ঠিক একইভাবে সঙ্কটের সময় আরো বেশি তৎপর হয়ে ওঠে। বৈধ আমদানির ক্ষেত্রে নানা রকম কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা হয় এবং সীমান্তে চোরাচালানের ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। ফলে পেঁয়াজের দাম বিশ-ত্রিশ বা চল্লিশ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায় এবং সেই সুযোগে সিন্ডিকেটটি গড়ে দুই হাজার কোটি ডলার লোপাট করে। আমাদের দেশের পেঁয়াজ চোরাকারবারিরা পাশের দেশ গ্যাবন বা উগান্ডার চোরদের মতো বেকুব নয়। আমাদের চোরেরা তাদের চৌর্যবৃত্তি নির্বিঘœ করার জন্য সাধুবেশী ভণ্ড, ব্যবসায়ী নামধারী টাউট বাটপার এবং বাদশাহের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে এমন ধড়িবাজ আমলা-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক প্রভৃতি চক্রকে হাত করে নেয়। ফলে পেঁয়াজ চোরাচালানের ব্যবসা সব কুকর্মের মধ্যে সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ ব্যবসা হিসেবে পরিগণিত হয়।
আমার আব্বা হুজুর দেশের বহু পুরনো ব্যবসায়ী। তিনি মূলত পেট্রোলিয়ামের ব্যবসা এবং অস্ত্রের দালালি করে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়ে যান। তার সুনাম-সুখ্যাতি বাদশাহের দরবার পর্যন্ত পৌঁছায়। ফলে শাহী প্রাসাদ থেকে প্রায়ই আব্বার ডাক আসতে থাকে। আব্বা সুযোগটিকে দারুণভাবে কাজে লাগান। তিনি বাদশাহের চোখে নিজেকে সৎ, দায়িত্ববান, বিশ্বস্ত এবং ধনী প্রমাণের জন্য দুই হাতে অর্থ ব্যয় করতে থাকেন। আব্বার এই তৎপরতার কারণে কঙ্গোর শাহী প্রাসাদে তার নামে সাত খুন মাফের মতো অবস্থা হয়ে যায়। আমাদের বাড়িতে বাদশাহ স্বয়ং বেড়াতে আসেন এবং সেই সুবাদে বড় বড় রাজ অমাত্য- আব্বা হুজুরের পদধূলির আশায় জারুয়া বংশের তাঁবেদারে পরিণত হয়ে যায়। আব্বার ব্যবসা অতি অল্প সময়ের মধ্যে ফুলে ফেঁপে এমন অবস্থায় পৌঁছে যায় যে- স্বয়ং বাদশাহও আব্বাকে পাত্তা দিতে বাধ্য হন।
শাহী প্রাসাদে আব্বার যখন রমরমা ব্যবস্থা, তখন কঙ্গোর আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ডনেরা আব্বাকে তাদের গ্রান্ড ডন বানিয়ে নেয়। আব্বা তখন বুঝতে পারলেন যে, সারা জীবন তিনি ব্যবসা বাণিজ্য করে যত অর্থ উপার্জন করেছেন তার চেয়েও বেশি অর্থ পেঁয়াজের চোরাকারবার থেকে এক মওসুমেই উপার্জন করতে পারবেন। ফলে পেঁয়াজের ঝাঁজ, পেয়াজের রস এবং পেঁয়াজ চোরাচালানের অর্থ একাকার হয়ে আব্বার মাথা খারাপ করে দিলো। তিনি তার সমুদয় পুঁজি, মেধা ও শ্রম পেঁয়াজ চোরাচালানের পেছনে বিনিয়োগ করলেন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের কৌশলগত স্থানগুলোকে তার সাথে এমনভাবে সংযুক্ত করে ফেললেন যা হয়তো কেউ কেউ বুঝলÑ আবার অনেকে বুঝলও না।
আব্বা হুজুরের অবস্থা যখন উল্লেখিত রমরমা পরিস্থিতিতে ছিল এখন আমি জায়ারে বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে ভর্তি হয়েছি। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি আমার পিতার কারণে আলাদাভাবে পাত্তা পেতে থাকলাম। ছেলেরা-মেয়েরা দলবেঁধে আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে আসত। আমি দুই হাতে আব্বার অবৈধ অর্থ অকাতরে খরচ করে সবার মধ্যমণি হওয়ার চেষ্টা করতাম। ফ্যাশনদুরস্ত পোশাক-আশাক, দেশী-বিদেশী দামি সুগন্ধি, গাড়ি, বডিগার্ড ইত্যাদির সমন্বয়ে আমার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছিল আরব্য রজনীর রাজকুমারদের মতো। এরই মধ্যে হঠাৎ এক উটকো সমস্যা আমার জীবনের সব কিছু তছনছ করে দেয়।
ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছু দিন হাসপাতালে থাকতে বাধ্য হলাম। ডাক্তারদের ঐকান্তিক চেষ্টায় আমি সুস্থ হলাম বটে কিন্তু আমার মাথার চুলগুলো সব পড়ে গেল। আমি রাতারাতি বীভৎস এক টেকো যুবকে পরিণত হলাম। মাথায় চুল গজানোর জন্য লোকজন আমাকে পেঁয়াজের রস মাথায় মাখার পরামর্শ দিলো। আমি নিয়ম করে পেঁয়াজের রস মাথায় মাখতে আরম্ভ করলাম এবং মাঝে মধ্যে কৌতূহলবশত পেঁয়াজের রসে হালকা চিনি-বিট লবণ এবং লেবু মিশিয়ে খাওয়া শুরু করলাম।
আমি যখন উল্লেখিত কর্মগুলো করছিলাম, তখন অনেকেই আমাকে বারণ করেছিলেন যে, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওসব করা ঠিক না। আমি কারো কথায় পাত্তা না দিয়ে আমার জারুয়া বংশের রীতি অনুযায়ী ঘাড় বাঁকা করে বেশি বেশি পেঁয়াজের রস মাথায় ঢালতে লাগলাম এবং পেঁয়াজের শরবত আরো নানা উপায়ে সুস্বাদুরূপে বানিয়ে গ্রোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই আমার শরীরে নানান প্রতিক্রিয়া ঘটতে থাকল। আমার মাথায় একটি চুলও গজালো না বটে- তবে সারা শরীর ভাল্লুকের মতো লোম গজিয়ে গেল। আমার পেট ও নিতম্বে এত বেশি লোম গজালো যা দেখে আমার আব্বা রীতিমতো কান্না শুরু করলেন। তার ধারণা হলো যে, পেঁয়াজ চোরাচালানের মতো দুষ্কর্মের কারণেই আমার এ অবস্থা হয়েছে। এরই মধ্যে আমার একমাত্র বোনটি বাড়ির ছাদ থেকে অকারণে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করল। এ অবস্থায় আমাদের জারুয়া বংশের হাজার হাজার লোক-মাতম শুরু করে দিলো এবং সবাই একবাক্যে আমার আব্বা-হুজুরের কুকর্মকে দায়ী করতে শুরু করল।
সার্বিক পরিস্থিতির কারণে আমার নিকট বেচে থাকাটা নিরর্থক মনে হতে লাগল। আমি প্রায় মানসিক ভারসাম্য হারানোর মতো পর্যায়ে চলে গেলাম। আব্বাও কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। আব্বার কুকর্ম, বোনের আত্মহত্যা এবং আমার শরীরে লোম গজানোর কাহিনী মানুষ দশমুখে প্রচার করতে থাকল। এলাকার চ্যাংড়া পোলাপান মনে করল আমি পাগল হয়ে গেছি। এজন্য তারা সুযোগ পেলেই আমাকে পেঁয়াজু বলে ডাকতো এবং দূর থেকে আমাকে লক্ষ করে ঢিল ছুড়ে বেশ মজা পেত। ফলে কঙ্গো নামক দেশটি আমার কাছে দারুল হাবিয়া নামের জাহান্নামের মতো কষ্টদায়ক হয়ে পড়ল। আব্বা দেশ-বিদেশের ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনা করে আমার উন্নততর চিকিৎসার জন্য আমাকে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে পাঠালেন।
প্যারিস নগরীর একটি বিশেষায়িত হাসপাতালে আমি দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিতে থাকলাম এবং ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলাম। আমার জটিল রোগের চিকিৎসা চলাকালীন আমি ডাক্তারদের আলাপ-আলোচনায় পেঁয়াজের রসায়ন এবং পেঁয়াজের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ভালোমন্দ বিষয়ে মোটামুটি ধারণা পেয়ে গেলাম এবং পেঁয়াজ বিষয়ে অধিকতর আগ্রহী হয়ে পড়লাম। আমি প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়াম, ন্যাশনাল লাইব্রেরি এবং প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করলাম এবং আব্বাকে রাজি করিয়ে ফ্রান্সে থেকে গেলাম পেঁয়াজ বিষয়ে লেখাপড়া করার জন্য।
আমি যখন পেঁয়াজের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে কঙ্গো পৌছালাম তখন কঙ্গোর আর্থ সামাজিক অবস্থায় পেঁয়াজ বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে। চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্যের কারণে সাধারণ জনগণ পেঁয়াজ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। দেশীয় কৃষকরা পেয়াজ উৎপাদন বন্ধ করে দেয়ায় পেঁয়াজ মৌসুমে চাষযোগ্য জমি অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। ফলে সরকার বিপুল রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছিল। অন্য দিকে, পেঁয়াজ চোরাকারবারিরা তাদের দীর্ঘ দিনের পেশা থেকে ছিটকে পড়ে অন্যসব মারাত্মক কুকর্মে জড়িয়ে পড়ল এবং সমাজকে অস্থির করে তুলল। বড় বড় ব্যাংক-বীমা-আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ধস নামল এবং রাজকোষে আর্থিক অনটন দেখা দিলো। বাদশাহর মাথায় বাজ পড়ল, তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন এবং যে কোন মূল্যে পেঁয়াজের চাষাবাদ বিপণন এবং বিতরণে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন।
আব্বার সাথে আমি যে দিন বাদশাহের কাছে গেলাম সে দিন আমি ভাবতেই পারিনি যে, বাদশাহের এত পরিবর্তন হয়েছে। তিনি অকপটে নিজের সব দোষ স্বীকার করে নিলেন এবং আমার কাছ থেকে পেঁয়াজের বিষয়ে নানা কথা জানতে চাইলেন। আমি যখন বললাম যে, রাষ্ট্রীয় মদদ পেলে পেঁয়াজের জেনোম আবিষ্কার করা সম্ভব এবং পরে পেঁয়াজ থেকে সুস্বাদু মিষ্টি রস থেকে শুরু করে বন্দুকের গুলি পর্যন্ত বানানো সম্ভব। পেঁয়াজ দিয়ে যেমন তরকারি রান্না হচ্ছে তেমনি পেয়াজ থেকে আগামী দিনে সুতা-বিস্কুট, ঢেউটিন এবং কেক, পেস্ট্রির মতো উপাদেয় খাদ্য তৈরি সম্ভব। আমি পেঁয়াজ নিয়ে আমার চিন্তার কথা বাদশাহকে অকপটে বলে ফেললাম যা অন্য কোনো সাধারণ মানুষের কাছে বললে তিনি আমাকে বদ্ধ উন্মাদ মনে করতেন। কিন্তু বাদশাহ তা করলেন না। তিনি আমার প্রস্তাবমতো একটি পেঁয়াজ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে একমত হলেন এবং স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সেটি নির্মাণ করে আমাকে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ করলেন। আমাদের বাদশাহের চরিত্রে বহুবিধ ত্রুটি আছে- আছে বিভিন্ন অপকর্মের বিস্ময়কর রেকর্ড। কিন্তু তারপরও আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ- পেঁয়াজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য, যার কারণে কঙ্গো আজ সারা দুনিয়ায় পেঁয়াজজাত শিক্ষা-দীক্ষা এবং পেঁয়াজজাত খাদ্যের জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য