পেঁয়াজ নিয়ে কার কারসাজি!
এম হাফিজউদ্দিন খান
গত বছর ‘বাজার নিয়ন্ত্রণের নাটাই কার হাতে’ শিরোনামে এই কলামেই লিখেছিলাম। সেই শিরোনামটি মনে পড়ল পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও বাজার নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতার কারণে। অতীতে বৃহৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রে হঠাৎ করে চালের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস তুলেছিল। আমাদের বাজারে হঠাৎ করে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায় এবং একবার বাড়লে এর নিয়ন্ত্রণ কতটা দুরূহ হয়ে পড়ে এই দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে। ‘বেড়ে যায়’ শব্দযুগলের পরিবর্তে পণ্যের দাম যখন-তখন অসাধু ব্যবসায়ীরা ‘বাড়িয়ে দেয়’ বলাটাই শ্রেয়। শুক্রবারের সমকালে ‘পেঁয়াজের ডাবল সেঞ্চুরি’ শিরোনামে যে তথ্য মিলেছে তাতে স্পষ্ট, পেঁয়াজ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা কী ভয়াবহ কারসাজি চালাচ্ছে। দেশের ইতিহাসে পেঁয়াজের বর্তমান বাজারমূল্য সর্বোচ্চ এবং এর পেছনে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিই মূলত দায়ী। শনিবারের সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, বিশ্বে পেঁয়াজের সর্বোচ্চ মূল্য বাংলাদেশে।
বাজারে পেঁয়াজের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদেও কয়েকজন সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন। তারা অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পাশাপাশি দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকারের কথাও বলেছেন। জাতীয় সংসদে সমাপনী বক্তব্যে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে জেলায় জেলায় টিসিবি পেঁয়াজ বিক্রি করবে। এ জন্য ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে।’ ভালো কথা। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য আপাতত স্বস্তি জোগালেও প্রশ্ন হচ্ছে- অসাধু ব্যবসায়ীরা কি এরই মধ্যে আরও কারসাজি করে ভোক্তার পকেট কেটে নিজেদের পকেট স্ম্ফীত করে নেবে না? তা ছাড়া এককালের শক্তিশালী সংস্থা টিসিবির বর্তমান বিবর্ণতা আমাদের অজানা নয়। এই সংস্থাটিকে শক্তিশালী করা গেল না আজও। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেও ক’দিন আগে পেঁয়াজ নিয়ে অসাধুদের চক্রান্তের কথা স্বীকার করেছেন। কয়েক মাস ধরে পেঁয়াজের বাজার অস্থির। প্রশ্ন হচ্ছে, তখন থেকেই কেন বাজার নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?
যখন ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি হয় তখনই বিকল্প উৎসের মাধ্যমে দ্রুত পেঁয়াজ আমদানি করে বাজার ব্যবস্থাপনায় অধিকতর মনোযোগী হলে আজকের এই পরিস্থিতি এড়ানো দুরূহ হতো বলে মনে করি না। যখন ‘বেণী পুড়ে’ হাতে লেগে গেল তখনই আমদানির তোড়জোড় শুরু হলো। কয়েকদিন আগে সমকালেরই একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার থেকে ৪২ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ আমদানি করে আমদানিকারকরা সেই পেঁয়াজ বাজারে ১০০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি করেছেন! স্বেচ্ছাচারিতার এটি হলো একটি মাত্র খণ্ডিত দৃষ্টান্ত। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন চট্টগ্রামের পেঁয়াজ আমদানিকারকদের নিয়ে দু’দফা বৈঠক করেছে। প্রথম দফায় বৈঠকে কোনো আমদানিকারক উপস্থিত হননি এবং বিষয়টি জেলা প্রশাসন সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল। দ্বিতীয় দফার বৈঠকে আমদানিকারকরা ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রির কথা বললেও এর ব্যত্যয় কীভাবে তারা ঘটিয়েছেন বিদ্যমান বাস্তবতা তো এরই সাক্ষ্যবহ। প্রথম দফার বৈঠকে আমদানিকারকরা উপস্থিত না হওয়ার বিষয়টি জেলা প্রশাসন জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকদিন পর খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে অভিযান চালানোর বিষয়টি যেন ‘বহ্বারম্ভে লঘু ক্রিয়ার’ মতো। জনস্বার্থ-সংশ্নিষ্ট এত বড় একটি বিষয়ে এই যে উদাসীনতা তা কীভাবে পর্যালোচিত হতে পারে?
পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এক পর্যায়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আপাতত ১০০ টাকার নিচে পেঁয়াজ পাওয়া যাবে না।’ মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের জের ধরেই কি আজকের এ পরিস্থিতি? আরেক মন্ত্রী বললেন, ‘পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে আছে।’ ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে, এরপরও কি আমাদের শুনতে হবে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে আছে? আমাদের সংবাদমাধ্যমে এই ইঙ্গিত আমরা স্পষ্ট করেই পেয়েছি গুদাম বা বাজারে যে পেঁয়াজ আছে তা পেঁয়াজের ঘাটতি ও চাহিদার বিপরীতে সামান্য। এই ঘাটতি মোকাবেলায় বিকল্প উৎস থেকে দ্রুত পেঁয়াজ আমদানি করা কি খুব কঠিন ছিল? এখন যা হচ্ছে এক কথায় বলা যায়- তা হলো অতি মুনাফার নগ্ন ষড়যন্ত্র। অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের কারসাজি।
সরকার দুর্নীতি নির্মূলে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’র কথা বারবার বলছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- এই যে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য নিয়ে এত বড় কারসাজি চলছে এবং অসাধু ব্যবসায়ীরা অন্যায়ভাবে কোটি কোটি টাকা ভোক্তার পকেট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে, এর প্রতিকারটা কী হলো? সংবাদমাধ্যমে এও জানা গেছে, গুদামে মজুদদাররা পেঁয়াজ ভর্তি করে রেখেছে এবং পচনশীল এই পণ্যটিতে পচনও ধরেছে। বিস্ময়ের বিষয় হলো, পচা পেঁয়াজও তারা যে দামে বিক্রি করছে তাতেও মুনাফার হারটা কম নয়। প্রকৃতপক্ষে দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ও উৎপাদন, পেঁয়াজ আমদানি ইত্যাদি সূত্রের হিসাবনিকাশ করে দেখলে যে সত্য উঠে আসে তা হলো- অসাধু ব্যবসায়ীদের অস্বাভাবিক মুনাফাবাজির লোভে বাজারে দৃশ্যত যে সংকট, অস্থিরতা সবই কৃত্রিম এবং পরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট। এই স্বেচ্ছাচারিতার শেষ কোথায়- এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় যাদের তারা নিরুত্তর!
প্রশ্ন উঠতেই পারে, আজ পর্যন্ত ক’জন অসাধু ব্যবসায়ীকে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দায়ে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে? অতীতেও তো পেঁয়াজসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্য নিয়ে এমন তুঘলকি কাণ্ড কম ঘটেনি। যেখানে দুস্কর্মকারীরা অন্যায় করে এভাবে অস্পর্শিত থেকে যায় সেখানে তো এমন স্বেচ্ছাচারিতাই চলবে। ওদিকে চালের দাম ফের বাড়তে শুরু করেছে। কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই ইতোমধ্যে কেজিপ্রতি চালের দাম বেড়ে গেছে ৫ থেকে ৭ টাকা। হঠাৎ কেন এভাবে চালের দাম বাড়ছে এর কোনো সদুত্তর নেই। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চালের এই দাম বৃদ্ধির পেছনে মিল মালিকদের কারসাজি থাকতে পারে। আসলে কারসাজির জাঁতাকলে পড়েছেন ভোক্তারা। পেঁয়াজ সংকটে ভোক্তা নাকাল অথচ এখনও ধৈর্য ধরতে বলছেন দায়িত্বশীলরা! ঘুরেফিরে সেই একই প্রশ্ন দাঁড়ায়- বাজার নিয়ন্ত্রণের নাটাই কার হাতে?
সবরকম আশ্বাস-প্রতিশ্রুতি উড়িয়ে পেঁয়াজের কেজি ২৫০ টাকায় গিয়ে ঠেকার পরও ধৈর্য ধরতে হবে ভোক্তাদের! আর অনৈতিক-অন্যায় কর্মকাণ্ডের হোতারা বাধাহীনভাবে চালিয়ে যাবে স্বেচ্ছাচারিতা? বিস্ময় লাগে, জনস্বার্থ-সংশ্নিষ্ট এসব বিষয় নিয়ে আমাদের রাজনীতিকরা শব্দ করেন না। তাদের কাছে ইস্যু শুধু কীভাবে ক্ষমতায় যাওয়া যায়, টিকে থাকা যায়। জনস্বার্থ এভাবে স্বেচ্ছাচারীদের পদদলিত হলেও রাজনীতিকরা যে কোনো দায় বোধ করছেন না, এর চেয়ে বিস্ময়ের বিষয় আর কী হতে পারে! পেঁয়াজের আকাশচুম্বী দামের কারণে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ ব্যাপক চাপে পড়েছে। আমাদের বাজারে যে কোনো পণ্যের মূল্য যখন একবার নিয়ন্ত্রণের গণ্ডি ভেদ করে তখন তা অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব ফেলে। এরই মধ্যে এই আলামতও দেখা যাচ্ছে। স্বেচ্ছাচারিতার এত নগ্ন প্রকাশ মনে হয় আমাদের সমাজেই এভাবে সম্ভব।
অসাধুদের আস্ম্ফালনে ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠলেও এর বিপরীতে নেই তেমন কোনো প্রতিকারের দৃষ্টান্ত! ব্যবসার নিয়মনীতি এভাবে অন্য দেশে লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত প্রায় বিরল। বাজারে যারা কারসাজি চালিয়ে নিজেদের পকেট স্ম্ফীত করে চলেছে তাদের হাত কি আইনের হাতের চেয়েও লম্বা? কারসাজির হোতাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকারের চিত্র দাঁড় করিয়ে সরকারকে এটা প্রমাণ করতে হবে- কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতা সরকার সহ্য করে না। সরকারের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির প্রমাণ চাই আমরা কাজের মধ্য দিয়ে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সভাপতি, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন