- জসিম উদ্দিন
- ১০ মে ২০২৩, ২১:১২
পুলিশ আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য ১২২৬ কোটি টাকার বাজেট চেয়েছে। কয়েকটি সংবাদপত্রে খবরটি প্রকাশ পাওয়ার পর আন্দোলনে থাকা বিরোধী দল বিএনপি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই বাজেটের মধ্যে ১৫৮ কোটি টাকার অস্ত্র ও গোলা বারুদ, ৫৪০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি কেনার জন্য চাওয়া হয়েছে। বিরোধীরা রাস্তায় আন্দোলন করলেও কঠোরভাবে দমন করা হয়। সশস্ত্র সাঁড়াশি অভিযান চালানোর জন্য পুলিশের সরঞ্জামের ঘাটতি বর্তমান সরকারের আমলে দেখা যায়নি। অন্য দিকে উচ্চ নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিরোধীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে হানা দেয়ার অন্যায় কর্মটি সমর্থন করা যায় না। এই অবস্থায় পুলিশ যখন মানুষের ওপর চড়াও হওয়ার আরো অস্ত্রশস্ত্র চায়, সেজন্য শুধু বিরোধী দল নয়, নাগরিক সমাজেরও শঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে।
নির্বাচন কোনো সহিংস পরিস্থিতি নয় বা অপরাধ কর্ম নয়। জনসাধারণ ভোট কেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। পুলিশের কাজ হচ্ছে নির্বিঘ্নে ভোট প্রয়োগে সহযোগিতা করা। এখানে গোলাবারুদ ও নজরদারি সরঞ্জাম গণহারে ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। বর্তমান সরকারের অধীনে দুটো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেও আরো ৯টি সাধারণ নির্বাচন দেশে হয়েছে। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে সেইভাবে বিতর্ক নেই। অন্ততপক্ষে দুবার বিএনপি ও একবার আওয়ামী লীগ কোনো প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক আয়োজিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে এসেছে। ওইসব নির্বাচনে পুলিশের জন্য আলাদা করে বিপুল অস্ত্র গোলাবারুদ ও নজরদারি সামগ্রী ক্রয়ের প্রয়োজন উত্থাপিত হয়নি। জাতীয় সমঝোতার ভিত্তিতে সব রাজনৈতিক পক্ষ এতে অংশ নেবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পেশিশক্তির ব্যবহার ব্যতিক্রমী ঘটনা। সেগুলো উপস্থিত মোকাবেলা করার মতো প্রশিক্ষণ দক্ষতা অভিজ্ঞতা ও সরঞ্জামাদি পুলিশের রয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের কারণে বাংলাদেশের পুলিশসহ সহযোগী বাহিনী বিতর্কিত হয়েছে। র্যাবের বিরুদ্ধে নেমে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞা।
জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এজন্য কমিশনকে শুধু পুলিশ নয়, বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনেরও সাহায্য নিতে হয়। সেজন্য একটি বরাদ্দও সবাই প্রয়োজন মতো পায়। এর ব্যতিক্রম দেখা গেছে বিগত দুটি বিতর্কিত নির্বাচনে: ২০১৪ সালে ‘বিনা ভোটে’ ও ২০১৮ সালে ‘নিশি রাতের’ নির্বাচনে। এ দুটো নির্বাচনে প্রথম দেখা গেল নির্বাচন কমিশন লোপ্রোফাইলে চলে গেছে। অর্থাৎ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি তার ক্ষমতা এখতিয়ার প্রয়োগে পঙ্গু হয়ে গেল। তার বদলে পুলিশ ও সামরিক বেসামরিক প্রশাসন প্রভূত শক্তি নিয়ে মাঠে উপস্থিত হলো। তার সাথে দেখা গেল খোদ সরকারের দানবীয় বল প্রয়োগ। সরকারি দলের প্রার্থী ও নেতাকর্মীরা আচরণবিধি লঙ্ঘনের মহোৎসব করেছে। এই অরাজকতা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের কোনো অংশকে কার্যকর দেখা গেল না। সরকারের প্রশ্রয়ে থেকে আওয়ামী লীগের লোকেরা সন্ত্রাসের তুফান বইয়ে দিয়েছে। জানা গেছে, ওই সময়ে, নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দের বাইরেও পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর নির্বাচনী কাজে নিযুক্ত ইউনিটকে অর্থ দেয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনকে নিশি রাতের নির্বাচন বলে অভিযুক্ত করা হলেও তৎকালীন সেনাপ্রধান ওই নির্বাচনকে তার দেখা ‘সেরা নির্বাচন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। অপর দিকে বিশেষ বরাদ্দ নেওয়ার পরও পুলিশ নির্বাচনে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা রাখেনি। বরং নিশি রাতে ভোট বাক্স ভরাটে সহযোগী হয়েছে, এমন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশ আওয়ামী লীগকে জেতানোর জন্য বিচ্ছিন্নভাবে কৃতিত্ব জাহির করে, খোঁটা দেয়। উচ্ছিষ্ট সুবিধা ভাগাভাগি করার জন্য আওয়ামী লীগের সাথে তা দিয়ে দর কষাকষি করে। এমনকি নির্বাচনে অবৈধভাবে সহযোগিতা করার কথা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কেউ কেউ অপ্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন।
বর্তমান সময়ে দেশের প্রকৃত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি গুরুতর অবস্থায় রয়েছে। চুরি ডাকাতি ছিনতাই ধর্ষণ নানা ধরনের জালিয়াতি বেড়েই চলেছে। আরেকটি ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে, সেটা হচ্ছে বিচার না পাওয়ার সংস্কৃতি। ক্ষমতাবানরা নিজেদের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। কোনো ধরনের বিরোধ ঘটলে অনেকে প্রতিপক্ষকে খুন করে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে জটিলতা নিরসন চাইছে। আপস নিষ্পত্তির কথা এ মানুষরা ভাবে না। এই ধরনের চরম পরিস্থিতি বিরোধী দলের রাজনৈতিক সদস্যদের কারণে হচ্ছে না। সহজ কথায় বললে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ অবনতি বিরোধী দলের কারণে ঘটেনি। বরং এর উৎপত্তির মূল কারণ রাজনীতি সঠিক জায়গায় না থাকা, রাষ্ট্রে যে কারণে ভারসাম্য নেই। তার পরও পুলিশের অস্ত্র গোলাবারুদ ক্রয়, ব্যক্তিগত জীবনে নজরদারি করার সরঞ্জামাদি নির্বাচন উপলক্ষে সংগ্রহ করার ফর্দ অস্বাভাবিক।
চলতি অর্থবছরে পুলিশের জন্য ২৮ হাজার ৭৮১ কোটি টাকার বিশাল বাজেট রয়েছে। তার বাইরে পুলিশের জন্য আরো প্রায় ১২২৭ কোটি টাকা বরাদ্দের আব্দার যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। আরো জানা যাচ্ছে, তড়িঘড়ি আরো কিছু পুলিশ সদস্য ও অফিসার নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে যেখানে পুলিশের সদস্য সংখ্যা দুই লাখ ১২ হাজার। তার বেশির ভাগ বর্তমান সরকারের সময়ে নিয়োগ পেয়েছে। এই নিয়োগও কি নির্বাচনকে সামনে রেখে করতে চাওয়া হচ্ছে? নির্বাচন উপলক্ষে পুলিশ যদি জাতিকে কোনো সাহায্য করতে পারে সেটা হতে পারে কোনো একটি বিশেষ দলের পক্ষে না হয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে নিরপেক্ষ থেকে জনগণকে ভোট দিতে সহায়তা করার মাধ্যমে।
jjshim146@yahoo.com