পাকিস্তানে ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে সবাই ধারণা করেছিল, এই ভোটের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা একটা সমাধানের দিকে যেতে পারে।
কিন্তু নির্বাচনের পর কয়েক দিন পার হওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে, অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। ভোট জালিয়াতি এবং অনিয়মের অভিযোগের মধ্যে দুটি নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক দল নিজেদের জয়ী বলে দাবি করছে।
ভোটের ফলাফল যা দাঁড়িয়েছে, তাতে কোনো দলই নিজের মতো করে সরকার গঠন করার মতো অবস্থায় নেই। তাই ফেডারেল পর্যায়ে একটি জোট সরকার গঠন অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
কারাগারে আটক অবস্থায় থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পিটিআই জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। তাঁর দলের প্রায় ৯৩ জন প্রার্থী ‘স্বতন্ত্র’ হিসেবে জয়ী হয়েছেন।
২৬৫ আসনের পার্লামেন্টে কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। পিটিআই সরকার গঠনের জন্য এখনো পর্যাপ্তসংখ্যক আসন পায়নি।
নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজ বা পিএলএমএন ৭৮টি আসন পেয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আরও কিছু স্বতন্ত্র এমপিকে নিয়ে তারা শক্তির বৃদ্ধি করতে পারে।
নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে পিএমএলএনের প্রতি শক্তিধর সেনাবাহিনীর সমর্থন রয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে দলটি সেনাবাহিনীর প্রত্যাশামতো নির্বাচনে ফল পায়নি।
পাকিস্তান পিপলস পার্টি বা পিপিপি ৫৪টি আসন পেয়ে তৃতীয় হয়েছে। এ দলটি এমন অবস্থানে রয়েছে, যে কিনা আরেকটি দলের সরকার গঠনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারবে।
পিটিআই ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করেছে, তারা নিজেরাই সরকার গঠন করতে চায় এবং তারা বিশ্বাস করে, তাদের ভোট চুরি করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার আগেই পিটিআই দাবি করেছিল, তারা ১৭০ বা তারও বেশি আসনে জিতেছে এবং সরকার গঠনের জন্য তারা যথেষ্ট সক্ষম। তবে তাদের সেই দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ ছিল না বলেই মনে হচ্ছে।
এতে বোঝা যায়, পিটিআই এখনো এসব কথা মেনে নিতে প্রস্তুত নয় যে তারা সরাসরি সরকার গঠনের জন্য পর্যাপ্ত ভোট পায়নি।
দলটি ইতিমধ্যেই নির্বাচনের ফলকে চ্যালেঞ্জ করেছে। তারা দাবি করেছে, কমপক্ষে ১৮টি আসনে কারচুপি হয়েছে এবং তাদের ফল পাল্টে দেওয়া হয়েছে। তারা এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগও করেছে।
আমার ধারণা, পিএমএলএমের নেতৃত্বে অন্য দলগুলোর মধ্যে একটা জোট হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটা কি এমন একজন ভোটারকে সন্তুষ্ট করবে, যিনি পিটিআইকে সংসদের সবচেয়ে বড় দল হিসেবে ভোট দিয়েছিলেন?
এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পাকিস্তান এখন একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির ভেতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে যা কার্যত নির্বাচন–পরবর্তী রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত থাকবে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে জোট সরকার গঠনের ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। তবে সেই সরকার বেশি দিন টেনে নেওয়া খুব সহজ হয় না। এ ধরনের সরকার খুবই দুর্বল হয়ে থাকে।
এ ধরনের ভঙ্গুর সরকারের পক্ষে যেকোনো ধরনের সাহসী অর্থনৈতিক প্যাকেজ ব্যবস্থাপনা করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায় এবং গঠনমূলক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ ধরনের সরকার খুব কম সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারে।
কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের জোট সরকারের মধ্যে ফাটল ধরে এবং তা একপর্যায়ে ভেঙে যায়।
এ কারণে অধিকতর শক্তিশালী এবং কর্মক্ষম সরকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পাকিস্তানে আবারও একটি নির্বাচনের প্রয়োজন হতে পারে।
পশ্চিমা বিশ্বে এই নির্বাচনকে অত্যন্ত ত্রুটিযুক্ত বলে বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, তাদের এই দাবি কতটা ন্যায্য।
পাকিস্তানের মান অনুযায়ী প্রকৃত ভোট তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। নির্বাচনের আগে বেলুচিস্তানের একটি অশান্ত এলাকায় ভয়ানক হামলা হয়েছে, যাতে ২৮ জন নিহত হয়েছে। তবে মোটের ওপর নির্বাচনের দিন ব্যাপক সহিংসতার যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তা শেষ পর্যন্ত হয়নি।
নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক তৎপরতার ক্ষেত্রে কিছু অযৌক্তিক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের নির্বাচন মান অনুযায়ী, এই ভোট অনেকাংশই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে।
পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে ইমরান খানের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব থাকার পরও পিটিআই যে ফলাফল পেয়েছে, তাতে বোঝা যায়, দেশজুড়ে সোজাসাপটা কারচুপি হয়নি। অবশ্য কিছু জায়গায় পিটিআই ভোটারদের হয়রানি করা হয়েছিল।
কিন্তু মোটা দাগে তাদের ওপর পাইকারি হারে কোনো অন্যায্য তৎপরতা চালানো হয়নি।
পাকিস্তানের নির্বাচনব্যবস্থাকে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না। পাকিস্তানের রাজনীতির বাইরে থাকা অনেক পর্যবেক্ষকের সমস্যা হলো, তাঁরা পাকিস্তানের নির্বাচনকে সাধারণত পশ্চিমা বা বাইরের চোখ দিয়ে দেখে থাকেন।
কিন্তু তাঁরা মনে রাখেন না, পাকিস্তানের রাজনীতি একেবারে অনন্য। পাকিস্তান এমন একটি সামরিক–শাসিত রাষ্ট্র যেখানে জেনারেলরা দীর্ঘদিন ধরে দেশের রাজনীতি এবং দেশের নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
এ দেশে নির্বাচনের বিকল্প হিসেবে একটাই পথ খোলা আছে। সেটি হচ্ছে সামরিক আইন। ‘নাই মামার চেয়ে মামা ভালো’ মতো এখানকার মানুষের কাছে খর্ব হওয়া গণতন্ত্র সামরিক শাসনের চেয়ে ভালো।
মজার ব্যাপার হলো, পিটিআইয়ের এই জয়সূচক ফল যে পাকিস্তানের এস্টাবলিশমেন্টবিরোধী ভোটের প্রতিনিধিত্ব করে; আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, এই ভোট যে সেনাবিরোধী ভোট ছিল, তা জেনেও সেনাবাহিনী কমান্ডের এই ভোট নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে
সেনাবাহিনীর সন্তুষ্ট থাকার প্রধান কারণ হলো, সরকার দুর্বল থাকলে তাদের ওপর সেনাবাহিনীর আধিপত্য বিস্তার করা অত্যন্ত সহজ হয়।
নওয়াজের পিএমএলএন যদি সরকার গঠন করেও, সে ক্ষেত্রে সব সময়ই তাকে সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে। বিশেষ করে পিটিআই যখন ব্যাপকভাবে বিক্ষোভ করবে, তখন পিএমএলএনের সেনানির্ভরতা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
এখন প্রশ্ন হলো, এই নির্বাচনী ফল নিয়ে আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত হবে কি না। জবাবে বলা যায়, অবশ্যই আমাদের সন্তুষ্ট হওয়া উচিত। কারণ, ২০১৮ সালের মতো সেনানিয়ন্ত্রিত এবং কারচুপির ভোট এবার হয়নি। এবারের ভোটে জনরায়ের যথেষ্ট প্রতিফলন দেখা গেছে। এটি পাকিস্তানের অগ্রগতির জন্য একটি বড় মাইলফলক।
- ডন থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত
আয়েশা জালাল টাফটস ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক - prothom alo