প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন চীনের অর্থায়ন ও সহায়তায় নির্মিত পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন তখন তিনি দেশের দুইজন বিখ্যাত ব্যক্তিকে পদ্মার ঘোলা জলে চুবানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন। প্রথম ব্যক্তি হলেন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বেগম খালেদা জিয়া। দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন দেশের একমাত্র নোবেল জয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পেছনে শেখ হাসিনা ড. ইউনূসকেই দায়ী করে থাকেন।
খালেদা জিয়া বিগত ৬ বছরেরও বেশি দিন ধরে কারাগারে কিংবা গৃহবন্দী হিসেবে রয়েছেন। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট মনে করে তাকে মূলত নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতেই সরকার এমন পন্থা অবলম্বন করেছে। এবার পালা ড. ইউনূসের। কেননা সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সরকার সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করছে। বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠানোর আগে তার বিচার প্রক্রিয়ায়ও একই ধরণের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিলো।
সাম্প্রতিক এক সাক্ষাতকারে ড. ইউনূস বলেছেন, ‘আমি বাংলাদেশ ত্যাগ করতে চাই না। সম্ভবত তারা আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করতে চায়’। ড. ইউনূসের এমন মন্তব্যই বলে দেয় আসলে তিনি কতোটা সঙ্কটকাল অতিক্রম করছেন।
জার্মান সাইট অনলাইনকে দেওয়া ওই সাক্ষাতকারে ৮৩ বছরের বয়োবৃদ্ধ এ অর্থনীতিবিদ যিনি তার ক্ষুদ্র ঋণ তথা সামাজিক ব্যবসার মডেল দিয়ে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত তিনি দাবি করেছেন কিছু লোক যারা তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত থাকার দাবি করে তার এই ব্যবসাকে লুণ্ঠন করতে চায়। তার ওপর চালানো হয়রাণী যে দিনকে দিন অত্যন্ত নিষ্ঠুর পর্যায়ে যাচ্ছে এ বিষয়টিতে জোর দেন তিনি।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে ড. ইউনূস অভিযোগ করে বলেন, শেখ হাসিনা সরকার ঢাকায় গ্রামীণ টেলিকম ভবনে অবস্থিত ৮টি প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়েছে। তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ অফিসগুলো তালাবদ্ধ করে রেখেছে। বিষয়টিতে পুলিশের সহায়তা চাওয়া হলেও তা পাওয়া যায়নি।
ড.ইউনূসের অপরাধ কী?
বাংলাদেশের একটি আদালত শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ড. মুহম্মদ ইউনূসকে সম্প্রতি ৬ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে। আদালতের পর্যবেক্ষণ হলো তার একটি প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিকদের জন্য ওয়েলফেয়ার ফাণ্ড গঠনে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে আদালতের এ রায়টি ন্যায়সঙ্গত ছিল কিনা এমন প্রসঙ্গ টেনে ভারতীয় নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রফেসর ড. রেহমান সোবহান বলেছেন, বছরের পর বছর ধরে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর এক প্রকার অস্ত্র চালানো হয়েছে। বলা যায় আইনী ব্যবস্থাও এক প্রকার আক্রমণের শিকার।
বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিখের কাছে ড. মুহম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। এসময় তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা অনেক সচেতন। বিষয়টি আমি আবারো উল্লেখ করতে চাই যে ড. ইউনূস বহু বছর ধরে জাতিসংঘের মূল্যবান অংশীদার। তিনি আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের পক্ষে একজন পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করছেন। তার বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যে সব প্রতিবেদন আসছে তা নিয়ে জাতিসংঘ খুবই উদ্বিগ্ন।
একই ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টও। স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রধান মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেছেন, অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার মতো আমরাও ড. ইউনূসের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন।
তিনি বলেন, শ্রম আইন ও দুর্নীতিবিরোধী আইনের অপব্যবহার নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে ড. ইউনূসের বিষয়ে একটি ন্যায্য ও স্বচ্ছ আইনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে উৎসাহিত করতে চাই।
এর আগে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, নেতৃত্ব ধারাবাহিকভাবে এ বিষয়টি নিয়ে সরকারকে খোলা চিঠি দিয়েছে। গত জানুয়ারি পর্যন্ত ১২৫ নোবেল বিজয়ীসহ ২৪২ বিশ্ব নেতৃত্ব ড. ইউনূসের বিচার প্রক্রিয়া, তাকে হয়রাণী ও সম্ভাব্য কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের গভীর উদ্বেগের বিষয়টি জানিয়েছেন।
এছাড়া ১২ জন মার্কিন সিনেটর ড. ইউনূসকে হয়রাণীয় বন্ধ করেত শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখেছেন। সিনেটররা গত এক দশকে ইউনূসের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ১৫০ টিরও বেশি প্রমাণহীন মামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। মামলাগুরো যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত সেটিও বেশ জোরালো ভাবে তুলে ধরেছেন সিনেটররা।
ড. ইউনূসই বা কেন?
বিগত কয়েক বছর ধরে শেখ হাসিনা ড. ইউনূসকে নিয়েই পড়ে আছেন। তিনি তাকে ‘রক্তচোষা’, ‘সূদখোর’সহ নানা অপমানজনক তকমা দিয়ে থাকেন।
কোনো কোনো সমালোচক বলে থাকেন, ড. মুহম্মদ ইউনূসের ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষোভের কারণ হলো তিনি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক স্বীকৃতি পেয়েছেন। যা শেখ হাসিনা এমনকী তার পিতা শেখ মুজিবকেও ছাড়িয়ে গেছে।
এছাড়া নোবেল পুরষ্কারটি ইউনূসের প্রতি তার নিপীড়নের মূল কারণ কি না-এমনটাও মনে করেন কেউ কেউ। যদিও আওয়ামী লীগের অনেকেই শেখ হাসিনাকে নোবেল পুরষ্কারের জন্য ড. ইউনূসের চেয়েও যোগ্য বলে দাবি করে থাকেন।
যদি ড. ইউনূসের বৈশ্বিক স্বীকৃতি শেখ হাসিনার জন্য উদ্বেগের কারণ হয় তবে এখানে তার খুশি হবারও কারণ রয়েছে। কেননা রিপোর্টার্স ইউথাউট বর্ডার তাকে ‘প্রিডেটর অব প্রেস ফ্রিডম’ বা উপাধীতে ভূষিত করেছে।
কলঙ্কিত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পরদিন ভারতীয় এক সাংবাদিক আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে জানতে চান এখন কি তিনি ড. ইউনূসকে ক্ষমা করে দেবেন?
শেখ হাসিনা তার জবাবে বলেন, এটি শ্রম আদালতের বিষয়। তার নিজের প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা বঞ্চিত। এখানে আমার কিছুই করার নেই। আমার কাছে তাকে ক্ষমা করার কোনো বিষয় নেই। উপরন্তু তিনি তার শ্রমিকদের কাছে ক্ষমা চাইতে পারেন’।
অনেক সমালোচকরাই বলে থাকেন যে, সেই অর্থে ড. ইউনূস শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের কড়া কোনো সমালোচক নন। তিনি কখনো সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিং মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়েও উচ্চ কণ্ঠ ছিলেন না।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি নিয়ে তিনি কেনো মুখ খুলছেন না সে বিষয়ে ডয়েচেভেলের প্রশ্নের মুখে পড়েন। এসময় ড. ইউনূস জানান তিনি সরকারের পক্ষ থেকে অনাকাঙ্খিত পরিণতি এড়াতে চান। যদিও সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে বিতর্কিত কারাদণ্ডের রায়ের পর তিনি এখন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে চাইছেন।
সম্প্রতি ড. ইউনূসের কন্যা মনিকা ক্রিশ্চিয়ান আমানপুরকে তার বাবা এক সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজ করতেন।
ডয়েচেভেলের সাংবাদিক ড. ইউনূসকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে ভবিষ্যতে তার শেখ হাসিনার সঙ্গে একত্রে কাজ করার সম্ভবনা রয়েছে কি না। এসময় ড. ইউনূস বিষয়টিকে সরাসরি অস্বীকার করেননি।
তিনি বলেন, ‘আমি কি বাধা (এমন সম্ভাবনার)? যখন শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে আমাকে ‘রক্ত চোষা’, ‘ডাকাত’ বলে তখন তো কেউ আমাকে এ বিষয়ে বিজ্ঞাসা করে না।
যদি তাদের মধ্যে এই অবস্থার সৃষ্টি হয় তাহলে কি ড. ইউনূসকে কি ‘মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ানোর’ আহ্বানের বিপরীতে আপস করতে হবে? জেল-জরিমানা এড়াতে চাইলে শেখ হাসিনার সঙ্গে হাত মেলানো ছাড়া তার আর কী উপায় আছে?
কারাজীবন এড়াতে সম্ভবত ইউনূসের সামনে ‘লুসিফার চুক্তি’ ছাড়া খুব অল্প সুযোগই রয়েছে।
বাংলা আউটলুক