নু-হুদা কমিশনের পঞ্চসালের পাঁচালি!


সদ্য সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নু-হুদা ওরফে নুরুল হুদাকে আমি চিনতাম না – এমনকি ইহজন্মে তার নামটিও শুনিনি। কিন্তু ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি তার সাথে নাটকীয়ভাবে আমার পরিচয় ঘটে যায়। ঘটনার দিন বিকেলে নু-হুদা বাক্স-পেটরাসহ আমার গ্রামের বাড়িতে উপস্থিত হন। পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার উলানিয়া বন্দরে আমার গ্রাম্য নিবাস। নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তখন নিদারুণ ব্যস্ত সময় পার করছিলাম। নির্বাচনসংক্রান্ত শত জটিলতা, স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিরোধ এবং প্রতিপক্ষের তাপচাপে আমি যখন প্রায় আলুভর্তা হতে চলছিলাম তখন নু-হুদা তার নিষ্পাপ মুখের সরল হাসি দিয়ে আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে, তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে আমার নির্বাচনী কর্মে সহায়তার জন্য এসেছেন। তিনি আমার বাড়িতে থাকবেন এবং আমার নির্বাচনী কর্মে যথাসম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা করবেন।

নু-হুদার কথাবার্তা এবং তার মুখে বিভিন্ন বৃত্তান্ত শুনে আমার মনে হলো, তিনি যথেষ্ট ভালো মানুষ। কাজেই আমার বাড়ির দোতলায় একটি কক্ষ তার জন্য বরাদ্দ করলাম। তিনি আমার পরিবারের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করতেন এবং নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকতেন। তার সরলতা-আন্তরিকতা এবং সহযোগিতামূলক মনোভাবের কারণে আমার পুরো পরিবারের সাথে তার সখ্য হয়ে গেল। পরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর বহুদিন পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ ছিল। একবার তিনি তার উত্তরার বাসায় আমাকে সপরিবারে নিমন্ত্রণ করে বিস্তর খানাপিনায় আপ্যায়িত করেছিলেন। এর বাইরে, তিনি মাঝে মধ্যে আমার অফিসে আসতেন এবং নানা বিষয়ে গল্পগুজব করতেন। একদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, আবর্জনা এবং বর্জ্য বিষয়ে তার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি যখন ঢাকা সিটি করপোরেশনে চাকরি করতেন তখন আবর্জনাসহ নানা ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু ব্যবসা করার চেষ্টা করছেন।

নু-হুদা আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসতেন এবং সেই ভালোবাসার সাথে স্নেহ ও শ্রদ্ধার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ছিল। নির্বাচনকালীন জটিল সময়ে তিনি আমাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এবং পরে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনী এলাকায় আমার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। এ কারণে তিনি যখন আমার সাথে কথা বলতেন তখন আমি তার চোখে মুখে একধরনের ইতিবাচক আভা দেখতে পেতাম। এর বাইরে আওয়ামী লীগের মধ্যে আমাকে নিয়ে একধরনের মিথ ছিল যার কিছুটা হয়তো এখনো অব্যাহত রয়েছে। বড় বড় নেতা মনে করতেন, আমার সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানার ব্যক্তিগত যোগাযোগ রয়েছে। কেউ বলতেন – জয়ের সাথে আমার বন্ধুত্ব রয়েছে। আমি এসব বিষয় যতই অস্বীকার করতাম ততই আমার ক্ষমতা সম্পর্কে লোকজনের কল্পনাশক্তি আরো বেড়ে যেত। মতিয়া আপার মতো সিনিয়র নেত্রী যখন আমাকে একান্তে ডেকে বললেন – তুমি তো নেত্রীর লোক… রাগ করো না, তখন আমি ভেবে পেতাম না কেন আমাকে নিয়ে এসব মিথ তৈরি হচ্ছে।

মতিয়া আপার মতো তোফায়েল ভাই, আমু ভাই কিংবা কাদের ভাইও মনে করতেন আমার ওপর নেত্রীর ‘বিশেষ’ স্নেহ রয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগে আমার কোনো পদ-পদবি না থাকা সত্ত্বেও কী যে এক অদ্ভুত গুরুত্বের ভারে আমি ন্যুব্জ হয়ে থাকতাম তা আপনাদের ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমাদের দেশের প্রধানতম তিনটি রাজনৈতিক দল যথা আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টির সর্বস্তরের নেতাকর্মীর সাধারণ মনমানসিকতা হলো, তারা দলীয় পদ-পদবি কিংবা মন্ত্রী-এমপি পদে অধিষ্ঠিত লোকজনের চেয়ে সেসব লোকদের বেশি তোয়াজ তদবির করেন যাদের তারা দলীয় প্রধানের আশীর্বাদপুষ্ট বলে মনে করে থাকেন। এসব কারণে নু-হুদাদের মতো আরো অনেক মানুষের অযাচিত গুরুত্ব পাওয়ার পরও আমি কোনো দিন রাজনৈতিক ফন্দিফিকির করিনি। ২০১৩ সালের দিকে আমি রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি এবং সিদ্ধান্ত নেই যে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব না। এ জন্য সেই নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ফরম পর্যন্ত কিনিনি। নিজের ব্যবসাবাণিজ্য, লেখালেখি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে জনকল্যাণ করে বাকি জীবন কাটানোর প্রত্যয় বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে সব রাজনৈতিক যোগাযোগ বন্ধ করে দিই এবং এভাবেই নু-হুদার সাথে আমার যোগাযোগের ইতি ঘটে।

আমি যখন জানতে পারলাম, নু-হুদা প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়েছেন তখন যারপরনাই খুশি হয়েছিলাম। আমি তাকে ফোন করে বা তার সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে স্বাগত জানাইনি। কারণ ক্ষমতার চেয়ারকে আমার বড় ভয় হয় এবং ক্ষমতা একজন মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে কতটা নির্মম-নৃশংস-অমানবিক-অকৃতজ্ঞ ও অভদ্র বানিয়ে ফেলতে পারে তার বহু নজির নিজের চোখে দেখার পর আমি ভুলেও ক্ষমতাধরদের কাছে অপ্রয়োজনে যাই না। নু-হুদার কার্যকালে তার সাথে কোনো যোগাযোগ না থাকলেও আমার নির্বাচনী এলাকার বহু মানুষ তার কাছে যেতেন। তিনি অনেকের কাছে আমার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতেন এবং সে কথা শুনে আমি বড়ই পুলকিত অনুভব করতাম। নু-হুদা সম্পর্কে আমার বিশ্বাস ছিল নিখাদ। কারণ আমি জানতাম যে, তিনি নেহাত তকদিরের জোরে অলৌকিকভাবে সিইসি নির্বাচিত হয়েছেন। পদটি পাবার জন্য তিনি কোনো তদবির করেননি বা তদবির করার মতো লাইনঘাটও তার জানা ছিল না। তা ছাড়া এতবড় একটি পদে তিনি নিয়োগ লাভ করবেন এমন কথা স্বপ্নেও ভাবতেন না। অপর দিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব কৌশল করে তাকে নিয়োগ দেবে এমন যোগাযোগ বা এমন গুরুত্ব তার কোনোকালেই ছিল না। তাহলে নু-হুদা কিভাবে সিইসি হলেন?

উল্লিখিত বিষয় নিয়ে আমার একদিন দীর্ঘ আলাপ হয়েছিল পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. সাদিকের সাথে, যিনি হুদা কমিশন গঠনের জন্য যে সার্চ কমিটি হয়েছিল, সেই কমিটির অন্যতম কর্তা ছিলেন। অধিকন্তু তিনি একসময় নির্বাচন কমিশনের সচিবও ছিলেন। ড. সাদিকের সাথে আমার সখ্য ছিল – কিন্তু তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। কিন্তু এক দীর্ঘ বিমানযাত্রায় আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম। তিনি অকপটে বলেছিলেন, তিনি আমার লেখার পাগলা ভক্ত। এ কথা শোনার পর আমি তার সাথে নানা বিষয়ে খোলামেলা আলোচনায় অংশ নিই। তিনি নু-হুদার সিইসি হিসেবে নিয়োগের ব্যাপারে আমাকে যা বলেছিলেন তা শুনে আমি রীতিমতো তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম। মানুষের তকদির যে, মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা নু-হুদার কাহিনী না শুনলে বুঝতে পারবেন না। নু-হুদা যেভাবে তকদিরের জোরে সিইসি হয়েছিলেন, একইভাবে তকদিরের কারণেই নির্বাচন কমিশনাররূপে নিয়োগ পেয়েছিলেন বলে আলোচিত এবং বহুল প্রশংসিত, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার আমার সাথে তার এক দীর্ঘ ব্যক্তিগত আড্ডায় সবিস্তার বলেছিলেন।

আমি ব্যক্তিগতভাবে নিয়তি বিশ্বাসী মানুষ। সুতরাং নু-হুদা যেহেতু ভাগ্যগুণে সিইসি হয়েছেন যেহেতু আমি ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বাস করেছি যে, তিনি জীবন সায়াহ্নে এসে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবেন এবং কাজকর্মে সাহসী হবেন। তার সম্পর্কে আমার এ রকম ধারণার পেছনে কতগুলো যুক্তিযুক্ত কারণ রয়েছে। প্রথমত, তিনি একাত্তরের রণাঙ্গনের একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা যিনি যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছেন।

দ্বিতীয়ত, আমি তার মধ্যে কোনো উচ্চাশা-লোভ বা লালসা দেখিনি। দুটো উদাহরণ নিলেই বিষয়াদি আপনাদের কাছে সহজ হবে। ২০০৯ সালের কোনো একসময় নু-হুদা আমার নির্বাচনী এলাকার একটি জনসভায় বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর বিভিন্ন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কমিটি আমাকে সিরিজ সংবর্ধনা দিচ্ছিল এবং এ রকম একটি অনুষ্ঠানে তিনি হঠাৎ এসে হাজির হয়েছিলেন তার বন্ধু এবং পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি কাজী আলমগীরকে নিয়ে।

অনুষ্ঠানে আমি যখন তাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের কথা উল্লেখ করে বলছিলাম – তারা যদি বীরত্ব নিয়ে লড়াই না করতেন তাহলে আমি এমপি হতে পারতাম না, আমার কথা শুনে সে দিন আবেগে তিনি যেভাবে কেঁদেছিলেন তাতে মনে হয়েছিল তার মনটি বেশ নরম। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল আমার অফিসে। একদিন তিনি হাসিমুখে এসে জানালেন, বাংলাদেশ স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। তার কথা শুনে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ এমন অগুরুত্বপূর্ণ পদে জেলাপর্যায়ের ছাত্রলীগ বা যুবলীগের নেতাদের মনোনয়ন দেয়া হয়। আমি তার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে চাইলাম। তিনি হাসিমুখে আমাকে অনুরোধ করলেন কোনো তদবির না করার জন্য এবং তদবির ছাড়া তিনি যা পেয়েছেন, তার জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ দিতে থাকলেন।

উল্লিখিত কারণে নু-হুদা কমিশনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি আশাবাদী হয়ে উঠলাম। তিনি যে দিন বিএনপি নেতাদের সাথে বৈঠক করলেন এবং সেখানে মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার অবদান নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করার পাশাপাশি জিয়াকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বললেন। তখন আমি তার সাহস দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। তিনি যে দিন আরো উল্লেখ করলেন যে, বিএনপি জমানায় তিনি জেলা প্রশাসকরূপে দায়িত্ব পালন করেছেন, তার সাথে বৈঠক শেষে বিএনপি নেতারা বেশ খুশি মনে বের হলেন এবং নজিরবিহীনভাবে তার প্রশংসা করলেন। সাংবাদিকরা নু-হুদাকে জিজ্ঞাসা করলেন – তিনি কি বিএনপিকে বাগে আনার কৌশল হিসেবে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলেছেন, নাকি আপনি এটা সত্যিই বিশ্বাস করেন?

উত্তরে তিনি চোখে মুখে সর্বোচ্চ ব্যক্তিত্বময়তা এবং গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে ইংরেজিতে বলেছিলেন – I mean it. তার সে দিনের বক্তব্যে আওয়ামী লীগের মধ্যেও বেশ কানাঘুষা শুরু হয়েছিল। আর অন্য দিকে আমার মনে হয়েছিল, বাংলাদেশ সম্ভবত নির্বাচনের ইতিহাসের কিংবদন্তি টিএন সেশনের মতো কাউকে পেতে যাচ্ছে।

প্রথম দিকে নু-হুদার সময়কাল এভাবেই কাটছিল। এই সময়ের মধ্যে আমরা তার ব্যাপারে প্রথম হোঁচট খেলাম যখন জানলাম ধর্ম মন্ত্রণালয় কিছু লোককে মাগনা হজে পাঠাবে এবং সেই দলে নু-হুদাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং তিনি সেভাবে হজ করে এসেছেন। এরপর জানলাম যে, সরকার তাকে ব্যবহারের জন্য বিএমডব্লিউ সেভেন সিরিজের একটি বহু মূল্যের লিমুজিন গাড়ি দিয়েছে। তারপর শুনলাম – নির্বাচন কমিশন সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে বিতর্কিত ইভিএম মেশিন কিনছে। লোকজন তাকে নিয়ে সন্দেহ শুরু করে দিলো। এ দিকে আমার নির্বাচনী এলাকায় ২০১৭ সালের দিকে জনৈক যুবক নিজেকে সিইসির ভাগিনা পরিচয় দিয়ে প্রচার করতে আরম্ভ করল যে, তার নৌকার মনোনয়ন শতভাগ নিশ্চিত। যুবকটি একটি টাইলস কোম্পানির জেলা শহরের দোকানে চাকরি করত। ফলে তার শিক্ষা-দীক্ষা-কথাবার্তা শুনে লোকজন প্রথমে মনে করলেন যে, যুবক হয়তো সিইসির নাম ভাঙিয়ে বাটপাড়ি করছে। কিন্তু পরে দেখা গেল, সে সত্যিই সিইসির ভাগিনা এবং তার বাবা একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মেম্বর পদে নির্বাচন করে হেরেছে।

আমি যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, নির্বাচন করব না; তাই সিইসির ভাগিনা সংক্রান্ত তৎপরতা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা অনুভব করিনি। অধিকন্তু তাকে কোনো দিন দেখিনি – তার নামও শুনিনি। একাদশ সংসদ নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চাপে আমি দলীয় মনোনয়নপত্র ক্রয় করলাম। কিন্তু যখন দেখলাম, সিইসির ভাগ্নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছে তখন আমি বুঝতে পারলাম যে, দেশে ২০১৪ সালের চেয়েও অভিনব একটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে। আমি প্রথমে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, চুপচাপ থাকব। কিন্তু ড. কামাল গং-এর তৎপরতা এবং নু-হুদা সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত দুর্বলতার জন্য তখনো মনে করতে থাকলাম, নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হবে। এ অবস্থায় এলাকাবাসীর চাপে বিএনপি থেকে মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনী মাঠে গিয়ে টের গেলাম যে, নু-হুদার কমিশন সারা দেশের নির্বাচনী মাঠে কত মারাত্মক মরণফাঁদ তৈরি করে রেখেছে।

নির্বাচনের পুরোটা সময় আমাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। নু-হুদার অধীনস্থ কর্তারা আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থেকে স্থানীয় বখাটে যুবকদেরকে লেলিয়ে দিত আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করার জন্য। আমার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হবে – মহিলাদের লাঞ্ছিত করা হবে ইত্যাদি আদিম ও পাশবিক শব্দমালা দুর্বৃত্তরা আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যখন বলত, তখন সেখানে যে কী ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হতো তা প্রকাশ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি ডিসিকে ফোন করলে জবাব মিলত – আমি নাকি উল্টো গালিগালাজ করছি। এসপি-ডিআইজি ফোন ধরতেন না। ওসি-ইউএনও মাঝে মধ্যে ধরতেন এবং বলতেন আমরা দেখছি। আমার সেই দুর্বিষহ দিনে আমি স্ত্রীর পরামর্শে নু-হুদাকে একদিন ফোন দিলাম। কিন্তু তিনি ফোন ধরলেন না। আমি জায়নামাজ বিছিয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলাম – ইয়া আল্লাহ! আমি কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এই নির্বাচনী মাঠে এসেছি, তুমি জানো। এমপি হিসেবে কী করেছি, তা-ও জানো। তুমি আমাকে এই জাহেলদের হাত থেকে উদ্ধার করো এবং আমাকে যারা বেইজ্জতির চেষ্টা করছে তুমি তাদের এমনভাবে বেইজ্জতি করো যেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তারা তাদের কুকর্মের ফল ভোগ করে।

উল্লিখিত অবস্থায় আমার ঘটনাটি সর্বোচ্চ মহলের দৃষ্টিতে নিয়ে আসেন আমার জনৈক বন্ধু। জেনারেল তারেক সিদ্দিকীর নির্দেশে আমার নিরাপত্তার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হয়। ডিবি পুলিশের দশ-বারোজনের একটি দল বড়সড় একটি মাইক্রো বাসে করে আমার বাসার সামনে ২৪ ঘণ্টা পাহারায় থাকত এবং মহান আল্লাহর দয়ায় আমি নিরাপদে ঢাকা পৌঁছাই রাতের ভোটের পরের দিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারি ২০২০ সালে। ঢাকা ফেরার পর নু-হুদা সম্পর্কে আমার মোহ ভঙ্গ হয় এবং কেন যেন নামটি শোনার পর অন্তরের গভীরতম স্থান থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের কলঙ্কজনক অধ্যায় এবং তৎপরবর্তী সব নির্বাচনে নু-হুদা গং যে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন তা পৃথিবীর কোনো প্রান্তে আগামীতে কেউ তৈরি করতে পারবে না। যে বিরল উপায়ে তাদের বিদায় হতে হয়েছে এবং বিদায় বেলায় তিনি যেভাবে নির্বিকারভাবে বলেছেন যে, তিনি যা করেছেন তা সঠিক করেছেন, আইন মেনে করেছেন, তিনি সফল তার কোনো অনুশোচনা নেই এবং কোনো রকম বাহ্যিক চাপ ছাড়া তিনি স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে স্বাধীনভাবে সব কিছু করেছেন, তা দেখে শুনে দর্শক-শ্রোতারা লজ্জায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

একসময়ের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব নুরুল হুদা তার কর্মকাণ্ডের জন্য এখন সামাজিক মাধ্যমে নু-হুদা অথবা নুহু নামে রীতিমতো মহা ভাইরালে পরিণত হয়েছেন। যাকে আমি ভালোবেসে হুদা ভাই বলে সম্বোধন করতাম সেই মানুষটি কিভাবে নুরুল হুদা থেকে নু-হুদা হয়ে গেলেন তা চিন্তা করলে একরাশ বেদনা আমাকে পেয়ে বসে। সিইসি হিসেবে শেষ কর্মদিবসে তিনি যে ভাষায় তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন তা দেখে শুধুই মহান আল্লাহর কথা মনে হয়েছে। আল্লাহ কেন এবং কিভাবে কিছু মানুষের মনে মোহর মেরে দেন – কিভাবে কিছু মানুষের জন্য হেদায়েতের পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং দুনিয়া-আখেরাতে এসব মোহরযুক্ত অন্তরধারীরা কী পরিণতি ভোগ করে সেই চিন্তার সাথে যখন মহাকালের ইতিহাসের বিভিন্ন উপাখ্যান স্মরণ করি, তখন সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য