আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির (জাপা) ভূমিকা কী হবে তা নির্ধারণে মঙ্গলবার দলের কেন্দ্রীয় কমিটি এবং জেলা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের যৌথসভা হয়েছে। এতে বক্তৃতা করা ৫৯ নেতার দুইজন বাদে বাকিরা আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে বর্জনের পক্ষে বলেন। আওয়ামী লীগের কড়া সমালোচনা করে তারা বলেন, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ না হলে, সেই ভোটে অংশ নিলে জাতীয় পার্টি দালাল হিসেবে চিহ্নিত হবে।’
রাজধানীর কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে মঙ্গলবার সকাল ১১টায় শুরু হয়ে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলে জাপার যৌথসভা। বুধবার আগামী নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হতে পারে।
জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে জাপা চেয়ারম্যান এবং দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বক্তৃতা করেন যৌথসভায়। সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা উপস্থিত থাকলেও বক্তৃতা করেননি। জি এম কাদের তৃণমূলের নেতাদের বক্তব্যের নোট এবং তাঁদের কাছ থেকে লিখিত প্রশ্ন নেন। পরে বক্তব্যে এর উত্তর দেন বলে জাপা সূত্র সমকালকে জানিয়েছে। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সমকালকে বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচন নিয়ে দলের নেতাদের মতামত শোনা হয়েছে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জি এম কাদেরকে।’
জাপা সূত্রটি জানিয়েছে, রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বা বিএনপিবিহীন নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপক্ষে মতামত দেন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করা যায় না। আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে অপমান অপদস্থ করছে।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জাপার সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলামও সরকারি দলের উপর ক্ষোভ ঝাড়েন। তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি সম্মান পায় না। দলের এমপিরা পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের জন্য কাজ করতে পারে না।
একই অভিমত জানিয়ে আওয়ামী লীগের জোটে না যেতে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে তা বর্জনের দাবি জানান সিরাজগঞ্জ জেলার সভাপতি আমিনুল ইসলাম ঝন্টু।’
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জাপার সভাপতি নুরুছ ছফা সরকার বলেন, ‘নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ না হলে, সেই ভোটে অংশ নিলে জাতীয় পার্টি দালাল হিসেবে চিহ্নিত হবে।’
জাপার এমপি আহসান আদেলুর রহমান বলেন, ‘বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জনমত সরকারের বিরুদ্ধে।’
যে দুই নেতা আওয়ামী লীগের পক্ষে বলেন, তাদের একজন ঢাকা মহানগর উত্তর জাপার সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম পাঠান। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে না থাকলে বিপাকে পড়তে হবে।’ তখন বাকি নেতারা দালাল! দালাল! দুয়োধ্বনি দেন।
তখন জাপা মহাসচিব প্রশ্ন করেন, ‘তাহলে আমরা কার সঙ্গে যাব?’ সভা সূত্র জানিয়েছে, সেই সময়ে সভা থেকে কয়েকজন নেতা বলেন, ‘বিএনপি! বিএনপি!’ কয়েকজন নেতা বিএনপি, বিএনপি ধ্বনি দেন। এ সময় জি এম কাদের বলেন, ‘বিএনপি যে মূল্যায়ন করবে, তারই বা কী নিশ্চয়তা আছে।’
তৃণমূলের নেতাদের উদ্দেশ্যে মুজিবুল হক চন্নু বলেন, ‘শুধু আবেগ দিয়ে রাজনীতি হয় না। দলের সিদ্ধান্ত মানতে হবে।’ এ সময় তৃণমূলের নেতারা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে গেলে ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে হবে। ২০-২৫টা আসন দিয়ে হবে না। ১০০ আসন এবং ১০টি মন্ত্রিত্ব দিতে হবে।’
জাপার একজন জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে নিশ্চিত করেছেন, জেলা পর্যায়ের নেতারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তবে নির্বাচনে অংশ না নেওয়া ছাড়া পথ খোলা নেই। তিনি বলেন, ‘মার্কিন চাওয়া পূরণে আওয়ামী লীগ সংলাপ ডাকতে পারে। তাতে বিএনপি অংশ নিতে পারে। দলটি নির্বাচনেও অংশ নিতে পারে। সেক্ষেত্রেও জাপাকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে হবে।’
সমাপনী বক্তব্যে নেতাদের উদ্দেশ্যে জি এম কাদের বলেন, ‘আপনাদের বেশিরভাগই বলেছেন জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগ অন্যায় করেছে। সম্মান, মর্যাদা দেয়নি। তার মানে বলতে চাইছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যাওয়া ঠিক হবে না।’ তখন উপস্থিত নেতারা জী! জী! বলে ধ্বনি দেন।
নেতাদের উদ্দেশ্যে জি এম কাদের আরও বলেন, ‘আপনারা সকলে আওয়ামী লীগ ও সরকারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপোস রফায় যাওয়ার ব্যাপারে একমত নন। কারণ, আওয়ামী লীগ অপমান করছে। এটা বাস্তবতা। জাতীয় পার্টির কারণেই আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসতে পেরেছে। তা আওয়ামী লীগ প্রধান কখনো স্বীকার করেননি। উনাকে ক্ষমতায় আনতে পরবর্তীতেও সাহায্য-সহযোগিতা করেছি।’
এর আগে তৃণমূলের নেতারা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই। এ প্রসঙ্গ টেনে জি এম কাদের বলেছেন, ‘এভাবে নির্বাচন করা অর্থহীন। তা বাস্তবসম্মত কথা। ধরে নিলাম, নির্বাচন বর্জন করলাম। তাহলে কী হবে? দল ভাঙতে চাপ সৃষ্টি করা হতে পারে। আর এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন করলে, জাতীয় বেইমান বা দালাল হিসেবে আমাদের পরিচিতি হবে।’
নেতাদের কাছে প্রশ্ন রেখে জি এম কাদের বলেন, ‘ কীভাবে নির্বাচন হলে অংশ নেব? একটা বন্দোবস্ত থাকতে হবে। যাতে আমরা ন্যায্য হিস্যা পাই। ১০-১৫ টা আসন দিয়ে…।’ তখন চুন্নু বলেন, ‘না গেলে কী ২০টা পাব?’ জি এম কাদের বলেন, ‘যদি নির্বাচনে যাই, আর পরবর্তীতে যদি সরকার সমস্যায় পড়ে, তাহলে আমাদের কী হবে? এই কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
জি এম কাদের সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘একচেটিয়া ক্ষমতা জোর করে দখল করে রাখবেন, মানুষের কথা শুনবেন না, মানুষ ভোট দিতে পারছে না, এটা দেশের মানুষ মানতে পারছে না। এখন মার্কিন সরকারও বলছে, নিঃশর্ত সংলাপ করতে। তা না হলে ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ, শাস্তিমূলক যে ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশের করার কথা, তা বাস্তবায়ন করবে। সুষ্ঠু নির্বাচন যদি না হয়, সরকার যদি সংলাপ না করে, তাহলে নির্বাচনে গেলে, স্যাংশন আসছে। যদি আলাপ-আলোচনা করে তাহলে সরকারের উপর ডেফেনেটলি বড় ধরনের স্যাংশন আসতে পারে।’
সূত্র : সমকাল