নির্বাচন করতে দেবে না– এত সাহস বিএনপি পায় কোথায়

নির্বাচন করতে দেবে না– এত সাহস বিএনপি পায় কোথায়ছবি: সমকাল

বিএনপি নির্বাচন বানচাল করতে চায় অভিযোগ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মানুষের জীবন কেড়ে নেবে, মানুষকে ভোট দিতে দেবে না, নির্বাচন বন্ধ করবে– এত সাহস কোথা থেকে পায়? তিনি বলেন, আগুন নিয়ে খেলতে গেলে আগুনে হাত পোড়ে– এটা তাদের মনে রাখা উচিত। তারা মনে করেছে, দুটো আগুন দিয়েই সরকার পড়ে যাবে। অত সহজ নয়। অত ভাত দুধ দিয়ে খায় না। তাদের বিরুদ্ধে সবাইকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

গতকাল বুধবার সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে বিশাল নির্বাচনী জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। সিলেটে হজরত শাহজালাল (র.)-এর মাজার জিয়ারতের মধ্য দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। জনসভায় যোগ দিতে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে ওসমানী বিমানবন্দরে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর অন্যান্য বারের চেয়ে এবারের সিলেট সফর অনেকটাই ব্যতিক্রম। নগরের কোনো সড়কে তোরণ নেই, নেই ব্যানার-ফেস্টুনও। দলীয় কিংবা সরকারপ্রধানের আগমনে এমন দৃশ্য সচরাচর চোখে পড়ে না। দলীয় নেতাকর্মীরা দলীয় প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণে অতীতে তোরণ, ব্যানার, পোস্টার সাঁটালেও এবার নির্বাচনী আচরণবিধি অনুসরণ করে তা করায় বারণ ছিল।

তবে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছার পোস্টার ছাড়াও যে ভালোবাসা প্রকাশ করা যায়, তার প্রমাণ দিয়েছেন সিলেটের লাখো নেতাকর্মী। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সমাবেশস্থল চিরচেনা সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের মঞ্চে বিকেল ৩টা ১০ মিনিটে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা উপস্থিত হন, তখন নেতাকর্মীর উচ্ছ্বাসের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মুহুর্মুহু স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে জনসভা ময়দান। এ সময় তারা জাতীয় পতাকা নেড়ে অভিবাদনের জবাব দেন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের ঠাঁই সংকুলান না হওয়ায় তা মাঠ ছাড়িয়ে আশপাশের এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ে। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও আশপাশের জেলা থেকে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের হাজারো নেতাকর্মী রিজার্ভ বাস, পিকআপ ও মোটরসাইকেল নিয়ে সমাবেশে যোগ দেন। তবে নিরাপত্তার কারণে চারপাশের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ায় ভোগান্তির শিকার হন অনেকে।

নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী জনগণের প্রতিশ্রুতি আদায় করে বলেন, এ নৌকায় ভোট দিয়ে মানুষ স্বাধীনতা পেয়েছে। কেউ ভয় পাবেন না। নির্বাচনে ভোট দিতে যাবেন। তিনি আরও বলেন, সিলেটের যে কূপ খনন করে খালেদা জিয়ার আমলে গ্যাস পাওয়া যায়নি, সেই কূপে এখন গ্যাস ও তেল পেয়েছি। আল্লাহ জন বুঝে ধন দেন। ২০০১ সালে আমাদের ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়নি। কারণ, আমেরিকা চেয়েছিল তাদের কাছে গ্যাস বিক্রি করতে। আমি তা করিনি। তখন ভোট কারচুরির মাধ্যমে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ‘কুলাঙ্গার’ আখ্যায়িত করে শেখ হাসিনা বলেন, লন্ডনে বসে এক কুলাঙ্গার হুকুম দেয়, আর কতগুলো লোক এখানে আগুন নিয়ে খেলে। যারা খুনি, তারাই নির্বাচন বানচাল করতে চায়। তাদের প্রতিহত করতে হবে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গতকাল সিলেটে প্রথম নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গত ১৫ বছরে তাঁর সরকারের বাস্তবায়িত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও সিলেটের উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুরমা নদীসহ সব নদী খনন কাজ শুরু করা হয়েছে। নতুন রেলস্টেশন করে দিয়েছি। সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-বাদাঘাট এবং সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক ছয় ও চার লেন হচ্ছে। ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। আধুনিক সিলেট গড়ার কাজ চলছে। সিলেটে মেট্রোরেল চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। ১০০ শয্যার বার্ন ইউনিট ও প্লাস্টিক সার্জারি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সিলেটের মানুষ সব সময় আমাদের পাশে রয়েছে। আমিও পাশে আছি। আবারও সিলেটে ফিরে আসব।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের কাজই জনগণের সেবা করা। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করব কথা দিয়েছিলাম; বাস্তবায়ন করেছি, করে দিয়েছি। এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলব। স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা তুলে ধরে তিনি বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ হচ্ছে পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়ন; মেধাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা, মেধা দক্ষতা ও প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি, উন্নত, উদার ও অগ্রসরমান সমাজ।

৩৫ মিনিটের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা আরও বলেন, আমরা দেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দিয়েছি। তারা কী দিয়েছে। বারবার সংবিধান লঙ্ঘন ও জাতির পিতাকে হত্যা করে ক্ষমতায় এসেছে। কোনো কাজ করেনি। শুধু ভোগের জন্য তারা ক্ষমতায় এসেছে।

সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আমরা বিএনপিকে চাই না, খালেদা জিয়াকে চাই না, তারেক রহমানকে চাই না। এরা মানুষ মারে, এরা দানব– এদের প্রতিহত করতে হবে। তিনি বলেন, বিএনপির ধর্মঘট ভুয়া, রাজনীতি ভুয়া।

সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইনাম আহমদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম নাহিদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা জেবুন্নেছা হক, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন; প্রবাসীকল্যাণ, বৈদেশিক ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ; পরিবেশ, বন ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন, সিলেট সিটি মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, সিলেট জেলা সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ। সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সালমান এফ রহমান, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ, শেখ হেলাল উদ্দিন এমপি প্রমুখ।

নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এবং জেলা সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান ও মহানগর সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন জনসভা পরিচালনা করেন।

মানুষকে ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখার অধিকার কারও নেই

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভোট জনগণের সাংবিধানিক অধিকার এবং তাদের ভোটে বাধা দেওয়ার অধিকার কারও নেই। গতকাল হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন তিনি।

আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে বিএনপি-জামায়াত জোট সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে কোনো ধরনের জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কেউ মেনে নেবে না। কেউ এটা করলে একদিন দেশের জনগণই তাদের ছুড়ে ফেলবে– এটাই বাস্তবতা।

রেলে সাম্প্রতিক অগ্নিসংযোগের পেছনে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করে তিনি বলেন, আমাদের অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিএনপি-জামায়াত চক্র নির্বাচন বানচাল এবং নির্বাচনে জনগণকে ভোট দিতে নিরুৎসাহিত করতে চাওয়ার বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, মানুষ নির্বাচন ও ভোটের পক্ষে। বিএনপির হরতালে জনগণ সাড়া দিচ্ছে না। এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা কী লাভ করবে, বরং শেষ পর্যন্ত জনগণ তাদের ঘৃণা করবে।

বিএনপির নির্বাচন বয়কট প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, কারও নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়াটা তাদের ব্যাপার; কিন্তু অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে মানুষ হত্যা করা হবে কেন? রেললাইনের ফিশপ্লেট উপড়ে ফেলা এবং রেলের বগিতে আগুন দেওয়া সম্পূর্ণ সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কর্মকাণ্ড। মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারাই বিএনপির চরিত্র।

ট্রেনের আগুনের হাত থেকে শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে এক শিশু ও তার মায়ের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় বিএনপি-জামায়াত জোটের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, এই দৃশ্যের মতো বেদনাদায়ক আর কিছুই হতে পারে না। একজন মানুষ কীভাবে এটা করতে পারে?

হজরত শাহজালাল ও হজরত শাহপরাণের মাজার জিয়ারত 

এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হজরত শাহজালাল (রহ.) ও হজরত শাহপরাণ (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করেছেন। তিনি সেখানে কিছু সময় কাটান, পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত, ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাত করেন। উভয় স্থানেই প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা তাঁর সঙ্গে ছিলেন।

এ সময় রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষ স্লোগান এবং হাততালি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে মাজারে যাওয়ার পথে স্বাগত জানান।

সমকাল