মীযানুল করীম: ‘আচরণবিধি মেনে চলুন; সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে সহযোগিতা করুন’-এ হচ্ছে টেলিভিশনে প্রচারিত নির্বাচন কমিশনের একটি বিজ্ঞাপনের ভাষা। অবাধ নির্বাচন হয়তো হবে, কিন্তু তা প্রতিনিধিত্বমূলক নয়। মনে পড়ে গেল, গত নির্বাচনের কথা। ওই নির্বাচন অবাধ হলেও সুষ্ঠু ছিল না, ‘বাইরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট’। বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই, কিন্তু ভেতরে অবাধে সিল মারা হচ্ছিল একটি বিশেষ প্রতীকে। এমনকি সেনাবাহিনীকেও ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি।
সেনাবাহিনী বাইরে টহল দিয়েছে মাত্র, কিন্তু ভেতরে যা হওয়ার তাই হয়েছে। সেনাসদস্যরা বলেছেন, আমরা শুধু সহযোগিতা করতে পারি, ভেতরের ব্যাপারে আমাদের কোনো হাত নেই। ওরা বলেছেন, ভোটকেন্দ্রের বাইরে কিছু হলে আমরা দায়ী নই। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা পাচ্ছে কিনা, এটি তাদের নিজস্ব ব্যাপার। অতএব, সেনাবাহিনী অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কী করবে; ওদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব সীমিত। এভাবে অবাধ নির্বাচন হলেও তা সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু, গণতান্ত্রিক, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ, অংশীদারত্বমূলক ও প্রতিনিধিত্বশীল হওয়ার জন্য আন্দোলন চলছে সারা দেশে। নির্বাচন যদিও গণতন্ত্রের সবটুকু নয়, কিন্তু নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ।
‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো’-এটিই হচ্ছে মূল নির্বাচনের নীতি। কিন্তু আমাদের দেশে গত কয়েক বছরে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি চরম অনিয়ম- ‘আমার ভোটও আমি দেবো, তোমার ভোটও আমি দেবো।’ এই সুযোগ কেবল ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের। এই অতি দরদিরা আসলে সুষ্ঠু ভোট চায় না। এরা অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে চায়। সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা ও প্রভাবশালী মন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে কিনা বলতে পারছি না। এটি বাংলাদেশের বাস্তবতার উপর নির্ভরশীল। তার কথা শুনে আঁতকে উঠতে হয়। এ দেশের মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, এটি অনস্বীকার্য। তাই বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক বা প্রতিনিধিত্বশীল হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বিএনপি ও তার সহযোগী জামায়াত না থাকলে নির্বাচনে অংশীদারত্বই থাকে না। লোকে বলে, নির্বাচন থেকে গণতন্ত্র নির্বাসনে গেছে। আমরা বলি, গণতন্ত্রই নেই যে দেশে, সে দেশে নির্বাচনের প্রশ্নই ওঠে না। নির্বাচনের অর্থ স্বচ্ছ ব্যালটবাক্স বা ক্ষমতাসীন দলের উপস্থিতি নয়। এখন নির্বাচনের সবই আছে, শুধু ভোটার নেই। সরকার অনেক চেষ্টা করেও লোকজন জড়ো করতে পারবে কিনা সন্দেহ, তাই একজন অনেকগুলো সিল মারার ফন্দি। নির্বাচনে তোড়জোড়ের অভাব নেই। সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন স্থানে ব্যালটবাক্স প্রেরণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা, মন্ত্রীদের হাঁকডাক ইত্যাদির অভাব নেই। কিন্তু নির্বাচনের প্রাণতুল্য যে ভোটার, সেই ভোটাররাই অনেকে অনুপস্থিত থাকবে। এ নিয়ে সরকারের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। ৫১ শতাংশ ভোটার হাজির হয়েছে দেখানোর জন্য নানা কলাকৌশল করা হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত কী হয়, আল্লাহ জানেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ভাঙার জন্য তৃণমূল বিএনপি গজানো হয়েছে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করা হয়েছে, সুপ্রিম পার্টি নামে সুপ্রিম দল গড়ে তোলা হয়েছে, কিন্তু বিএনপি ভাঙা সম্ভব হয়নি। বিএনপির মাত্র ১৩ জন সাবেক মন্ত্রী ও এমপিকে নির্বাচনে আনা গেছে। মেজর জেনারেল (অব:) শাজাহান ওমর বিএনপি থেকে গিয়েও আওয়ামী লীগে সুবিধা করতে পারছেন না। পত্রিকার খবর, স্বতন্ত্র প্রার্থীর ওপর হামলা বেশি। তার পাশেই প্রধানমন্ত্রীর সিঙ্গেল কলাম নিউজ- ‘অগ্নিসন্ত্রাসীদের রেহাই নেই’। অথচ সবাই স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে ব্যস্ত। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের। অর্থাৎ নৌকা মার্কার লোকেরা নিজেদের লোকের ওপর হামলা করছে। কথায় বলে, ওরা প্রতিপক্ষ না পেলে সপক্ষের লোকের ওপর হামলা চালায়। এখন নির্বাচনী প্রচারণার কারণে তাই দেখা দিচ্ছে। এখন হরতাল-অবরোধের চেয়েও বড় খবর হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও তাদের লোকজনের ওপর হামলা। আর এই হামলার জন্য দায়ী শাসকদল, এটি নিঃসন্দেহে। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহ দিয়েছেন। কিন্তু চান না স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বেশি বেড়ে উঠুক, অর্থাৎ শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হোক। অনেকেই এই নির্বাচনকে অভিহিত করছেন ‘আসন ভাগাভাগির নির্বাচন’ হিসেবে। আসলেও তাই। এই নির্বাচনে কে কতটা জনসমর্থনের অধিকারী, তা প্রমাণিত হবে না; বরং সরকার যা চাইছে, তা হচ্ছে কিনা, এটিই বড় কথা।
নির্বাচনী মহড়া হবে, কিন্তু নির্বাচন হবে না। নির্বাচন থেকে গণতন্ত্র অনেক আগে নির্বাসিত। দেশের শুরু থেকে যে নির্বাচন, তাতেই গলদ রয়ে গিয়েছিল। দিন দিন তা বড় হয়েছে। এভাবে এরশাদ আমলে তা চরম আকার ধারণ করে। এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়। ফলে ক্ষমতাসীন দল ওই সময় হেরে যায়। এরপর, ২০০৮ সাল থেকে পাতানো নির্বাচন শুরু। ২০১৪ সালে বিনাভোটে নির্বাচন এবং ২০১৮ সালে মাঝরাতের নির্বাচন আমরা দেখেছি। এসবের পুনরাবৃত্তি আর চাই না। এখন সামনের নির্বাচনটি যাতে সুষ্ঠু হয়, সেই কামনাই প্রত্যেকে করা উচিত। তবে সরকার ক্ষমতায় থেকে যে নির্বাচন করে, সে হারার জন্য করে না। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার। যার কাজ হবে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা। এখন সব কিছু উল্টা হচ্ছে। তাই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা- এ নিয়ে সন্দেহ সবার।
নয়াদিগন্ত