বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্প্রতি ভারত সফরের সময় ভারতের সঙ্গে যে কটি বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের ট্রেন চলাচলবিষয়ক সমঝোতা। এই সমঝোতা স্মারক সম্পর্কে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা বলেছেন, রেলওয়ের জন্য সমঝোতা স্মারকটি ছিল দুই দেশের রেলওয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন-সংক্রান্ত।
ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে ছয়টি আন্তসীমান্ত রেলসংযোগ রয়েছে; কিন্তু এই রেলসংযোগ চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ভারতের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ট্রানজিট পাওয়া যাবে। এই রেল ট্রানজিটের অংশ হিসেবেই আগামী মাসের কোনো এক সময় বাংলাদেশ রেলওয়ের পথ ব্যবহার করে গেদে-দর্শনা থেকে হলদিবাড়ি-চিলাহাটি ক্রসবর্ডার ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্ট পর্যন্ত একটি পণ্যবাহী ট্রেন পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হবে। (ট্রান্সক্রিপ্ট অব স্পেশাল ব্রিফিং বাই ফরেন সেক্রেটারি অন স্টেট ভিজিট অব প্রাইম মিনিস্টার অব বাংলাদেশ টু ইন্ডিয়া, ২২ জুন ২০২৪, মিনিস্ট্রি অব এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স, ইন্ডিয়া)
যদিও বিনয় মোহন কোয়াত্রা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের এই রেল ট্রানজিটকে ‘উভয় দেশ, উভয় সমাজ, উভয় অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে উপকৃত করবে’ বলে দাবি করেছেন; কিন্তু নানা সংকটে জর্জরিত বাংলাদেশ রেলওয়ে ভারতীয় রেলের ভার কতটা বহন করতে পারবে, এ বিষয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। উদাহরণস্বরূপ দর্শনা-চিলাহাটি রেলপথের কথাই ধরা যাক। এই রেলপথটি ব্যবহার করেই ভারত পশ্চিমবঙ্গের গেদে থেকে বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, পাবনার ঈশ্বরদী, নাটোরের আবদুলপুর, দিনাজপুরের পার্বতীপুর ও নীলফামারীর চিলাহাটি হয়ে ভুটান সীমান্তবর্তী দলগাঁও পর্যন্ত নিজেদের ট্রেন পরিচালনা করতে চায়।
বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ সূত্রে জানতে পারছি, দর্শনা-চিলাহাটি রেলপথটি বেশ পুরোনো এবং এই পথে এখনই সক্ষমতার চেয়ে বেশি ট্রেন চলছে। রেলপথটির ৬টি সেকশনের মধ্যে ৩টিই ওভারলোডেড। এর মধ্যে আবদুলপুর-সান্তাহার ও সান্তাহার-পার্বতীপুর সেকশনে বর্তমান সক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত ১৪টি এবং পার্বতীপুর-চিলাহাটি সেকশনে সক্ষমতার চেয়ে ১টি ট্রেন বেশি চলছে।
তা ছাড়া এই রেলপথের বেশির ভাগ অংশই পুরোনো। এমনিতেই বাংলাদেশের ব্রডগেজ রেলপথের ভারবহনের ক্ষমতা (২২ দশমিক ৫ টন) ভারতের রেলপথের ভার বহনের ক্ষমতার (২২ দশমিক ৮২ টন) চেয়ে কিছুটা কম। দর্শনা-চিলাহাটি রেলপথের বেশির ভাগ অংশ পুরোনো হয়ে যাওয়ার কারণে এই ভার বহনের ক্ষমতা আরও কমেছে। এ রকম অবস্থায় ভারতীয় মালবাহী ট্রেন নিয়মিত চলতে শুরু করলে বাংলাদেশের অংশের রেলপথ তার ভার কতটা বহন করতে পারবে, সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। (পুরোনো রেলপথ, চলছে সক্ষমতার চেয়ে বেশি ট্রেন, বণিক বার্তা, ২৪ জুন, ২০২৪)
সিঙ্গেল লাইনে একটি স্টেশন থেকে যখন কোনো ট্রেন ছেড়ে যায়, তখন অন্য প্রান্তের স্টেশন থেকে আর কোনো ট্রেন ছাড়তে দেওয়া হয় না। আগের স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি অন্য প্রান্তের স্টেশনে আসার আগপর্যন্ত থেমে থাকা ট্রেনটিকে অপেক্ষা করতে হয়। ফলে সিঙ্গেল লাইনের রেলপথে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রসিংয়ের সংখ্যা ও অপেক্ষার সময় বাড়তে থাকে। এখনই সক্ষমতার সংকটে ভুগতে থাকা দর্শনা-চিলাহাটি রেলপথে ভারতীয় মালবাহী ট্রেন চলতে দেওয়া হলে বিদ্যমান ট্রেনগুলোর শিডিউল বিপর্যয় ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়বে।
এই রেল ট্রানজিট যে শুধু বাংলাদেশের একটি রেলপথ ব্যবহার করে হবে তা নয়; ১৬ জুন টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক খবর থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৪টি নতুন রুটের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করা হবে, যার দৈর্ঘ্য হবে ৮৬১ কিলোমিটার। টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, ভারতের সামরিক ও বেসামরিক পণ্য পরিবহনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘চিকেন নেক’ রেলপথ নিয়ে ২০১৭ সালে দোকলাম অঞ্চল ঘিরে ভারত ও চীনের মধ্যকার বিরোধে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল ভারত। কারণ, চিকেন নেক করিডর এই বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের কাছেই অবস্থিত। এই কারণেই উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে চিকেন নেক করিডরের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করার জন্য বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বিকল্প রেল নেটওয়ার্ক তৈরি করবে ভারত। (নিউ রেললাইনস ফর নর্থ ইস্ট ভায়া বাংলাদেশ টু বাইপাস ‘চিকেনস নেক’, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ১৬ জুন, ২০২৪)
বাংলাদেশ ঘিরে ভারতের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ যে চীন-ভারতের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জটিলতার মধ্যে আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়বে না, তার কি নিশ্চয়তা? উত্তর-পূর্ব ভারত সীমান্তে চীনের সঙ্গে সামরিক সংঘাতে বাংলাদেশের রেল ট্রানজিট ব্যবহার করে যদি ভারতীয় সামরিক সরঞ্জাম পরিবহন করা হয়, তখন বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতির অবস্থা কী দাঁড়াবে?
তা ছাড়া ১৪টি নতুন রুটে বাংলাদেশের রেলপথ দিয়ে ভারতীয় ট্রেন চলাচল শুরু হলে ইতিমধ্যেই অবকাঠামোসংকটে জর্জরিত বাংলাদেশ রেলওয়ের কি অবস্থা হবে, তা সহজেই অনুমেয়। এমনকি ভারতের রেল চলাচলের সুবিধার জন্য যদি বাংলাদেশের রেলের অবকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়, যদি সে জন্য ভারত ঋণও দেয়, সে ক্ষেত্রেও তা বাংলাদেশের জনগণের জন্য বোঝা হিসেবেই আবির্ভূত হবে।
কারণ, দিন শেষে ঋণের অর্থ সুদে-আসলে জনগণের করের টাকা থেকেই পরিশোধ করতে হবে। তার ওপর দেখা যাবে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের জন্য যেসব স্থানের রেলপথের অবকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজন, সেসব স্থানের বদলে অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ভারতের ট্রানজিট সুবিধা মাথায় রেখে।
এভাবে বাংলাদেশের জনগণের করের টাকায় ভারতকে রেল ট্রানজিট দিয়ে বাংলাদেশের কী লাভ হবে? এর আগে ভারতকে বাংলাদেশের নৌপথ, স্থলপথ ও বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে কী লাভ হয়েছে? এসব ক্ষেত্রে হাজার হাজার কোটি টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখানো হলেও বাস্তবে কী অর্জন হয়েছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব পাওয়া যায় না। কানেকটিভিটির প্রসঙ্গে অনেকেই ইউরোপের উদাহরণ দিয়ে থাকেন। কিন্তু অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামরিক ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর পারস্পরিক শক্তিসামর্থ্যের মধ্যে যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা রয়েছে, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কি তা রয়েছে?
সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বেশ কিছু অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে, যার মধ্যে সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিক হত্যা, তিস্তাসহ বাংলাদেশের নদী থেকে ভারত কর্তৃক একতরফা পানি প্রত্যাহার অন্যতম। এসব সমস্যার সমাধান না করে কোন যুক্তিতে এবং কার স্বার্থে বাংলাদেশ একের পর ভারতকে স্থল-নৌ-রেলবন্দর ব্যবহারের সুবিধা দিতে থাকবে!
- কল্লোল মোস্তফা লেখক ও গবেষক
- prothom alo