- সালাহউদ্দিন বাবর
- ০৮ জুলাই ২০২৩
লেখক সালাহউদ্দিন বাবর। – ছবি : নয়া দিগন্ত
সমাজ-রাষ্ট্রের কোনো কর্তৃপক্ষ বা রাজনৈতিক দলের প্রতি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অ্যাক্সসেপটেন্স বা গ্রহণযোগ্যতা বা আস্থা-বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হলে তখন সেই কর্তৃপক্ষ বা রাজনৈতিক দলের কাছে স্বাভাবিকভাবে মানুষের (এক্সপেকটেশন) প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা অনেক বেড়ে যায়। আর এটিই স্বাভাবিক নিয়ম। বর্তমান প্রশাসনের প্রতি মানুষের আস্থা বিশ্বাস প্রায় তলানিতে পৌঁছে গেছে। কেননা বিগত দিনগুলোতে প্রশাসনের পারফরম্যান্স সাধারণ ও রাজনৈতিক নির্বাহীদের যোগ্যতা ও দক্ষতা অভাবজনিত কারণে সব ক্ষেত্রেই মানুষের দুর্ভোগ, ভোগান্তি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে সেই প্রশাসনের কাছে কিছু প্রাপ্তি আশা করা নিছক বাতুলতা বলেই মনে করা হয়। এসব কারণেই জনগণের তাদের প্রতি সহানুভ‚তি সমর্থন এখন শূন্যের কোঠায়। প্রশাসন থেকে যা বলা হচ্ছে, বাস্তবে ঠিক তার উল্টোটাই ঘটছে। সে কারণে উপরে বর্ণিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে রাষ্ট্রের নাগরিকরা দুর্বিষহ জীবনযাপনে এখন বাধ্য, এক অবর্ণনীয় হতাশায় তারা নিমজ্জিত। কখনো কখনো সরকার এমনটাই চেয়ে থাকে। হতাশায় আছন্ন থাকা মানুষ সে সময় এতটাই নির্লিপ্ত নিরাসক্ত হয়ে উঠে সমাজ রাষ্ট্র জনগণের প্রতি তার দায়িত্ব পালন করুক বা নাই করুক। সে নিয়ে জনগণের মধ্যে কোনো উৎসাহবোধ কাজ করে না। সেই নৈরাজ্যের ভেতরে বিদ্যমান প্রশাসন সুযোগে যত অপকর্ম করে নেয়। কেননা তখন জনগণের পক্ষে বাদ-প্রতিবাদ বা মন-মানসিকতা আর অবশিষ্ট থাকে না। অবশ্য এখন উল্লিখিত সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েই আছে। এটাকে চলমান রেখে যদি একটা নির্বাচন প্রশাসন করিয়ে নিতে পারেন, কেল্লা ফতেহ হওয়ার কিছু বাকি থাকবে না। সাধারণের জন্য এমন কিছু দুঃস্বপ্ন হলেও বলাবাহুল্য সরকারি দল এখন তেমন স্বপ্ন দেখার প্রহর গুনছে।
বর্তমান প্রশাসনের ভ‚মিকার জন্যই জনগণের এমন মনোভাব উপলব্ধির পরও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ জোরালো কণ্ঠে বলে বেড়াচ্ছেন, তারা ক্ষমতায় থাকলেই নাকি দেশের মানুষ অনেক বেশি কিছু পেয়ে থাকে। সে বেশিটা কী সেটি কিন্তু তারা বলেননি। তবে সেটি কি ক্ষুদ্র দারিদ্র্য বৈষম্য বঞ্চনা আর ভোটের অধিকার হারানো? বিষয়টি খোলাসা করা হয়নি। উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশবাসী বর্তমান প্রশাসনের কাছ থেকে এখন আর কিছু পাওয়ার আশা করে না। কেবল অপ্রাপ্তির বেদনা ছাড়া।
মানুষ এখন গভীর আগ্রহ নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে, একটা পালাবদলের আশায়। একটা সক্ষম দক্ষ ও যারা জনগণের মর্মের কথা উপলব্ধি করতে পারে হাসবে কাঁদবে এমন একটা নতুন প্রশাসনের উন্মেষের প্রতীক্ষায় রয়েছে সবাই। জনগণ বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ-পদ্ধতি হিসেবে অবশ্যই শান্তিপূর্ণ ভোট বিপ্লব হতে হবে বলে বিশ্বাস করে। সেই পালাবদলকে ত্বরান্বিত করতে উন্মুখ জনগণ। তাদের এমন আর্তি-প্রকাশ পাচ্ছে সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষের জনসমাবেশগুলোতে মানুষের বিপুল হাজিরার মধ্য দিয়ে আগামীতে শান্তিপূর্ণ ভোট বিপ্লব ঘটানোর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের সব ব্যর্থতা সপ্রমাণ করাই গণমানুষের এখনকার লালিত আকাক্সক্ষা। এই আকাক্ষার অনুকূলে কোনো বক্তব্য বা পদক্ষেপ শুনতে ও দেখতে পেলে মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠছে ও তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। এখানে একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, ভোট বিপ্লব মানুষ করতে চায়। তেমন ভোট অনুষ্ঠানের প্রথম শর্ত হচ্ছে, এমন একটা সরকারের অধীনে হতে হবে যার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকবে না। অর্থাৎ বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তেমন নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো সুযোগ নেই।
পূর্বের কথায় ফিরে যাই, অর্থাৎ যে সংগঠনের প্রতি মানুষের আস্থা বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয়, তাদের কাছ থেকে অতীতের সব বঞ্চনা বেদনা লাঘব ও অপ্রাপ্তির কষ্ট উপশমের জন্য মানুষ এখন ততটাই কাতর, যেমন পিপাসায় কাতর চাতকের মতো ছটফট করছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যাও আছে, কোনো পালাবদল ঘটলে যে নতুন কর্তৃপক্ষের হাতে দায়িত্ব আসবে। সেই মুহূর্ত থেকে তাদের কাছে অতীতের সব দেনা অপূর্ণতা পাওয়ার প্রবল ইচ্ছা জনগণের ভেতর তৈরি হবে। সব ক্লেদ অনিয়ম অব্যবস্থা অবসানের দাবি উঠবেই। বর্তমান কর্তৃপক্ষ বিদায় নেয়ার পর দেখা যাবে কেবল এ দেশের একটা কঙ্কাল মাত্র অবশিষ্ট রয়েছে। যেমন বিধ্বস্ত অর্থ, ঋণভারে জর্জরিত দেশ, মারাত্মক জ্বালানি সঙ্কট, বিদ্যুতের ঘাটতি, অবিশ্বস্ত অতীতচারী প্রশাসন, ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রযন্ত্র, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী, বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের সব কৌশল অচল, চার দিকে সিন্ডিকেটের লোলুপ দৃষ্টি, নীতিভ্রষ্ট তোষামোদকারী ও ব্যক্তিনির্ভর মিডিয়া, দিশাহারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সব মিলিয়ে ভয়ঙ্কর এক পরিস্থিতি। সর্বোপরি যে ত্রিশক্তি যারা এখন ক্ষমতাসীনদের অন্যতম মদদদাতা, তাদের মতিগতি কী হবে বলা মুশকিল।
নতুন কোনো কর্তৃপক্ষকে উপরের এসব বিপর্যয় মোকাবেলা করতে হবে যা এক কঠিন ব্যাপার। তবে আশা হচ্ছে, দেশের মানুষের চাহিদা বাড়বে ঠিকই; কিন্তু তাদের বোধ বিবেচনা হারিয়ে ফেলবে এমনটা না হওয়ার কথা। কিন্তু বৈরী মিডিয়া কি বসে থাকবে? অবশ্যই তারা নতুন কর্তৃপক্ষকে জনসম্মুখে হেয়প্রতিপন্ন করার কোনো প্রয়াসই হাতছাড়া করার কথা নয়। কিছু মিডিয়া এখন মুখোশ পরে আছে। তাদের ভ‚মিকা সব সময় অত্যন্ত কৌশলী। তারা সুচ হয়ে ঢুকবে আর ফাল বেরুবার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করবে না। এ জন্য নতুন কর্তৃপক্ষকেও সজাগ এবং কৌশলী হতে হবে। বিশেষ করে মিডিয়া নিয়ে এখনই ভাবার সময়। অর্থাৎ সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। আর নতুন কর্তৃপক্ষ তাদের আন্তর্জাতিক মিত্র খুঁজতে কোনো মতে দ্বিধা করার মতো বা সময়ক্ষেপণে কোনো সুযোগ নেয়া ঠিক হবে না। হঠাৎ করেই সংলাপ প্রসঙ্গটি ইদানীং ক্ষমতাসীন পক্ষ থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে ঠেলে দেয়া হয়েছে। সম্ভব এর পেছনে নানা কৌশল থাকতে পারে। তাছাড়া একটা কথা সবার জানা। এ দেশে সংলাপ নিয়ে বহু সংলাপ হয়েছে। কিন্তু তার প্রতিটি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। আর সেসব সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায়। ইতিহাস সচেতন মানুষের নিশ্চয় স্মরণ আছে, সেসব সংলাপের পরিণতি ছিল শূন্য। তা না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। একটি রাজনৈতিক দলের একগুঁয়েমিতে সেই সব আলোচনাকে ভণ্ডুল করার সব পরিকল্পনা ছিল। অথচ তারা আবার আলাপের প্রস্তাব করে। আসলে এই সংলাপ সংলাপ খেলার অর্থ হচ্ছে নিছক সময়ক্ষেপণ করা, জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি এবং আন্তর্জাতিক বলয়ে এই বার্তা দেয়া যে, তারা সব সমস্যার সমাধান আলাপ-আলোচনার মধ্যে সমাধান করতে চায়। মাত্র কিছু দিন পূর্বে পরিষ্কারভাবে ক্ষমতাসীন মহল থেকে বলা হয়েছে এবং এখন বলা হচ্ছে, তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির সাথে কোনো সংলাপই হবে না। সেই বক্তব্যের সাথে অনেক গালমন্দ ছিল এবং বিএনপির নামের সাথে নানা বিশেষণ জুড়ে ছিল; হাজারো অপবাদ আর নিন্দা যুক্ত করা হয়। এমন প্রয়াসের উদ্দেশ্য কেবল বিএনপিকে বিতর্কিত করা।
সম্প্রতি সচেতন কিছু সাবেক পেশা ও বুদ্ধিজীবী একটা সমঝোতার কথা বলছেন। সবাই এটা মনে করছেন ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এখন এই শেষ বেলায় অতীতের মতো গোঁ ধরে থাকার সময় এটা নয়। মাঠে-ময়দানে তাদের যে মারমুখী তৎপরতা সেটা বর্তমান সঙ্কটকে আরো ঘনীভূত করবে। একটা বড় ধরনের সঙ্ঘাত সংঘর্ষ ঘটে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। বহু দিন বিএনপি নেতাকর্মীরা নীরবে ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে জেলজুলুম ও বহু যন্ত্রণা নীরবে সয়ে আসছে। একটা সাধারণ উদাহরণ এখানে পেশ করা যেতে পারে। নিরীহ বিড়ালকে যদি কোনো এক কক্ষে আটকে রেখে তার কাছে লাঠিসোঁটা নিয়ে যাওয়া হয় সে তখন কিন্তু ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। এ উদাহরণ কারো হেসে উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না। বিএনপির নির্যাতিত নেতাকর্মীদের প্রতি যদি তেমনটাই করা হয় তবে তাদেরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা বিচিত্র কিছু নয়। তাই ক্ষমতাসীনদের প্রতি সবিনয় নিবেদন, ভাবিয়া করিও কাজ; করিয়া ভাবিও না। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নিজেদের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার সময় এটা নয়। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটানোই হয়, সেটা কিন্তু গড়িয়ে তাদের কোর্টে যাবে। কেননা তারা এখন ক্ষমতায়, সব প্রশাসন তাদের মুঠোর মধ্যে রয়েছে।