নানা সমীকরণ, চলছে আসন ভাগের হিসাব

সর্বাত্মক নির্বাচনী প্রস্তুতিতে নেমে পড়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকরা। জোটগত নির্বাচনের পাশাপাশি দলীয়ভাবে বেশ কিছু আসনেও নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে প্রার্থী বাছাই ও তালিকা চূড়ান্ত করছে তারা। প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর আসন সমঝোতার লক্ষ্যে প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘দর কষাকষি’ শুরু করবে এসব দল। অবশ্য বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে এলে ১৪ দলের জয়লাভের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে জোটগত আসন সমঝোতার প্রশ্নে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন শরিক নেতারা।

বিএনপিবিহীন নির্বাচনের সম্ভাবনা থেকে ১৪ দলের শরিক দলগুলোকে ছাড় দেওয়া আসনগুলোতে জোটগত এবং অন্য অনেক আসনে আলাদাভাবে ভোটের মাঠে নামানোর পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগেরও। এ ক্ষেত্রে ১৪ দল শরিকদের পাশাপাশি জাতীয় পার্টি এবং সমমনা ইসলামী দলগুলোসহ অন্য একাধিক দল ও জোটের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমেও ভোটের লড়াইয়ে নামতে চায় ক্ষমতাসীন দলটি। আগামী নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক করতে সর্বোচ্চ সংখ্যক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করছেন সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা।
১৪ দলের শরিকরা এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচনের কথা জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত শরিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), জাতীয় পার্টি-জেপি, সাম্যবাদী দল এবং গণতন্ত্রী পার্টির (আরশ আলী) নির্বাচন কমিশনে পাঠানো আবেদনে এটা জানিয়েছে। আওয়ামী লীগও শরিকদের নিয়ে নির্বাচন করার কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। এ ছাড়া ১৪ দলের বাইরের বিকল্পধারা বাংলাদেশও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন করবে বলে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে।

অবশ্য গত তিনটি নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় এবারও ১৪ দলীয় জোটগতভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া আছে। গত ১৯ জুলাই শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে ১৪ দলের প্রধান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এমনটাই জানিয়ে দিয়েছেন। গত নির্বাচনের পর থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে শরিকদের সঙ্গে সৃষ্ট দূরত্ব ঘোচানোর পাশাপাশি তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ নিরসনে ওই বৈঠক ডেকেছিলেন তিনি।

শরিকদের প্রস্তুতি যেভাবে
প্রাথমিকভাবে নিজ নিজ দলীয় প্রার্থী তালিকার পাশাপাশি জোটগত সমঝোতার জন্য ‘দর কষাকষি’র জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাও করে রাখছে ১৪ দল শরিকরা। পরে এই তালিকা প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের কাছে দেওয়া হবে। অবশ্য গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের মতো এবারও আসন সমঝোতার বিষয়টি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ওপর নির্ভর করছে– এমনটাও মনে করছেন শরিক দলগুলোর নেতারা।
১৪ দলীয় জোটের বর্তমান শরিক ১৩টি দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য আরও ছয়টি দলের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন রয়েছে। এগুলো হচ্ছে– বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), জাতীয় পার্টি-জেপি, তরীকত ফেডারেশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে গণতন্ত্রী পার্টি সম্প্রতি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গণতন্ত্রী পার্টি (আরশ আলী) ও গণতন্ত্রী পার্টি (শাহাদাৎ) ১৪ দলের শরিক হিসেবে সক্রিয় থাকলেও দলটির নিবন্ধন ও প্রতীকের বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের শুনানির পর্যায়ে রয়েছে। নিবন্ধনবিহীন অন্য চারটি দল হচ্ছে– গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র এবং বাসদ (রেজাউর)।

এর মধ্যে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি প্রাথমিকভাবে ৩০টি আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। গত শুক্রবার থেকে তাদের দলীয় মনোনয়নপত্র দেওয়া শুরু হয়েছে। এদের মধ্যে দলের বর্তমান তিন সংসদ সদস্যসহ কমপক্ষে পাঁচটি আসনের জন্য আওয়ামী লীগের কাছে ছাড় চাইবে তারা। বাকি আসনগুলোতে দলীয় প্রতীক হাতুড়ি নিয়ে আলাদা নির্বাচনের প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। দলটি বর্তমান তিন সংসদ সদস্য ঢাকা-৮ আসনে দলের সভাপতি রাশেদ খান মেনন, রাজশাহী-২ আসনে সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এবং সাতক্ষীরা-১ আসনে অ্যাডভোকেট মুস্তফা লুৎফুল্লাহ ছাড়াও মেহেরপুর-২ আসনে পলিটব্যুরোর সদস্য নুর আহমেদ বকুল এবং নাটোর-১  আসনে ইব্রাহিম খলিলের জন্য ছাড় চাইবে।

জাসদ গতকাল শনিবার থেকে শুরু করেছে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি, যা চলবে চার দিন। ৭০-৮০টি আসনে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। তালিকা চূড়ান্ত করে জোটগত আসন বণ্টনের আলোচনায় যাবে দলটি। এ ক্ষেত্রে গত তিনটি নির্বাচনে দলের যেসব প্রার্থী জোটের মনোনয়নে জিতেছিলেন, মনোনয়ন পেয়েও জিততে পারেননি কিংবা এবার মনোনয়ন পেলে জেতার সম্ভাবনা রয়েছে– এমন প্রার্থীদের জন্য জোটের মনোনয়ন চাওয়া হবে। এই সংখ্যা ১২-১৪ জনের মতো হবে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সংসদ সদস্য দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর কুষ্টিয়া-২, সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারের ফেনী-১, স্থায়ী কমিটির সদস্য রেজাউল করিম তানসেনের বগুড়া-৪ এবং সহসভাপতি ও সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্য আফরোজা হক রীনার জন্য একটি আসনসহ আরও কয়েকটি আসনের জন্য দরকষাকষিতে যাবে জাসদ। বাকি আসনগুলোতে দলীয় প্রতীক মশাল নিয়ে আলাদা নির্বাচনের প্রস্তুতিও রয়েছে দলটির।

জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পিরোজপুর-২ এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলামের জন্য একটি আসনে জোটের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে চাইছে দলটি। আরও কয়েকটি আসনে দলীয় প্রতীক বাইসাইকেল নিয়ে লড়ার প্রস্তুতিও আছে। তরিকত ফেডারেশন ২০০ আসনে এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করেছে। ১৪ দলীয় জোটের কাছে দলের চেয়ারম্যান ও বর্তমান সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর চট্টগ্রাম-২ আসন ছাড়াও মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীর জন্য কুমিল্লা-৮ অথবা কুমিল্লা-৯ আসনসহ ২০টি আসনের মনোনয়ন চাইবে তরিকত ফেডারেশন।

দলীয় সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়ার চট্টগ্রাম-১ আসনসহ কমপক্ষে ছয়টি আসন চায় সাম্যবাদী দল। এগুলোসহ মোট ১০টি আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। গণতন্ত্রী পার্টি (আরশ আলী) চায় দলের সভাপতি ব্যারিস্টার আরশ আলী, নির্বাহী সভাপতি অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ সিকদার এবং সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলনের জন্য তিনটি আসনসহ ১০-এর অধিক আসনে জোটের মনোনয়নের নিশ্চয়তা। আর গণতন্ত্রী পার্টি (শাহাদাৎ) চায় সভাপতি ডা. শাহাদাৎ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক কামরুল আহসান খান পারভেজের দুটিসহ আরও কয়েকটি আসন।
একইভাবে কমিউনিস্ট কেন্দ্র চাইছে দলের আহ্বায়ক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান ও যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. অসীত বরণ রায়ের জন্য দুটি আসন। এ ছাড়া ন্যাপ, গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি এবং বাসদসহ (রেজাউর) শরিক অন্য দলগুলো মনোনয়ন দেওয়ার বেলায় ‘যথাযথ মূল্যায়ন’ আশা করছে আওয়ামী লীগের কাছে।

নেতারা যা বললেন
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সমকালকে বলেন, এখন পর্যন্ত জোটের মধ্যে আসন সমঝোতা বা আসন বণ্টনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়নি। শুরু হলে তারা এ নিয়ে কথা বলবেন, নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরবেন বলে জানান তিনি।
একই কথা বলেছেন জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তাঁর ভাষায়, বিএনপি-জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে রাজনীতি ও নির্বাচনের মাঠ থেকে নির্মূল করতে ১৪ দল সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে নির্বাচনী যুদ্ধে নামবে।
তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী বলেন, তরিকত ফেডারেশন নিজেদের মতো করে নির্বাচনী প্রস্তুতি ও প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করেছে। জোটগত আসন সমঝোতার আলোচনা শুরু হলে তাদের দাবি তুলে ধরা হবে।

১৪ দলের সমন্বয়ক-মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, আগামী নির্বাচনে ১৪ দল ঐক্যবদ্ধভাবে লড়বে। আসন বণ্টনের বিষয়টি সময়মতো শরিকদের সঙ্গে বসে ফয়সালা করা হবে। ১৪ দলের ঐক্য অটুট ছিল, আছে এবং থাকবে।

সমকাল