থানার কার্যক্রম পুনরুদ্ধার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রতিটি এলাকায় নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদরদপ্তর। গতকাল শনিবার সব জেলার পুলিশ সুপার এবং ওসিদের এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।
গতকাল পুলিশ সদরদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, শনিবার দুপুর ৩টা পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৫৩৮টির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মধ্যে মহানগরের ১১০ থানার মধ্যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে ৮৪টিতে। জেলার ৫২৯ থানার মধ্যে ৪৫৪টির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। রাজধানীর ৫০টি থানার মধ্যে অন্তত ৪৫টির কার্যক্রম শুরু হলেও কাজকর্ম পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।
পুলিশের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নাগরিক নিরাপত্তা কমিটির প্রধান লক্ষ্য হবে আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো। এ লক্ষ্যে কমিটির একটি অ্যাকশন প্ল্যান প্রস্তুত করে তদারকি ও মূল্যায়নের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এলাকার আইনশৃঙ্খলা পুনর্স্থাপনের লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও কমিটির সদস্যদের সমন্বয়ে যৌথ টহলের মাধ্যমে হানাহানি, চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এলাকায় বিদ্যমান সামাজিক সংঘাত, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ প্রতিরোধে নিবিড় ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেবে বিরোধ নিষ্পত্তির।
স্থানীয় জনসাধারণের জীবন, সম্পদ, স্থাপনা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপাসনালয়সহ এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা নিয়মিত তদারক করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এলাকার মাদক, ইভ টিজিং সমস্যা নিরসনে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন ধর্মীয়, রাজনৈতিক দল-উপদলের মধ্যে বিরাজমান উত্তেজনা নিরসন ও সম্প্রীতি স্থাপনের লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করবে নিরাপত্তা কমিটি।
স্থানীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা কমিটির আকার নির্ধারণ করবেন। গ্রহণযোগ্য আইনজীবী, বিচারক, সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, জ্যেষ্ঠ নাগরিক, সর্বজন সমাদৃত স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, মানবাধিকার কর্মী এবং এনজিও প্রতিনিধি কমিটির সদস্য হবেন। কমিটি পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তা বিঘ্নকারীদের বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ গড়ে তোলা, কেউ যেন কোনো উস্কানি দিয়ে পরিবেশ ঘোলাটে করতে না পারে সেজন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং পুলিশ সদস্যদের আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানসহ অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ করবে।
এদিকে রাজধানীর ৫০টি থানার মধ্যে অন্তত ৩৫ থানার কার্যক্রম শুরু হলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। কর্মরত সবাই উপস্থিত হননি সংশ্লিষ্ট থানায়। থানা এলাকায় নিরাপত্তার জন্য পুলিশের যে টহল থাকে, সে কার্যক্রমও বন্ধ আছে। থানাগুলোতে এখনও নিরাপত্তা দিচ্ছে সেনাবাহিনী ও আনসার সদস্যরা। সেবাপ্রার্থী মানুষের সংখ্যাও কম। মামলা কিংবা জিডি তদন্ত কার্যক্রমও শুরু হয়নি। তবে মামলা ও জিডি নথিভুক্ত করা হচ্ছে। ডিউটি অফিসাররা দায়িত্ব পালন করছেন আগের মতোই।
জানা গেছে, ডেমরা থানায় মামলা ও জিডি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অবশ্য ৫ আগস্টের পরও এখানকার কর্মকর্তারা থানাতেই অবস্থান করছিলেন। সেখানে হামলা বা কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। থানার ওসি জহিরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, গতকাল একটি হত্যা মামলা হয়েছে। তবে আসামি ধরতে অভিযান চালানো হয়নি। পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগছে। দুপুরে হাতিরঝিল থানায় গিয়ে সেনাসদস্যদের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদেরও উপস্থিতি দেখা যায়। থানার কার্যক্রম চলছে।
মিন্টো রোডে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়েও সেনাসদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন। ডিবি ও সিটিসির কর্মকর্তা এবং সদস্যরা অফিস করেছেন। অবশ্য কর্মকর্তারা গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করতে পারছেন না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে যাদের গ্রেপ্তার করে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছিল, তাদের অনেকেই জামিনে বের হয়ে কার্যালয়ের সামনে আসছেন তাদের মোবাইল ফোন সংগ্রহ করতে। গ্রেপ্তারের পর তাদের মোবাইল ফোন জব্দ করে রেখেছিল ডিবি। মিন্টো রোডে গতকাল শনির আখড়ার নুরপুরের মো. সাব্বির (২৩) নামে এক তরুণের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, জীবনে প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার এবং জেল খাটতে হয়েছে। অথচ আমি কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। বিনা দোষে ডিবি আমাকে ধরে এনে খুব মারধর করে মিথ্যা মামলা দিয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে পুলিশ হত্যার বিচারসহ ১১ দফা দাবিতে কর্মবিরতিতে রয়েছেন নন-ক্যাডার পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা (পরিদর্শক থেকে কনস্টেবল)। তাদের দাবির বিষয়ে আজ রোববার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে। আন্দোলনরতদের আশা, বৈঠকে দাবি পূরণের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে তারাও অনতিবিলম্বে কর্মস্থলে ফিরবেন। পুলিশ সদস্যদের কর্মক্ষেত্রে ফেরাতে গত শুক্রবার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আলোচনায় বসেছিলেন নতুন আইজিপি ময়নুল ইসলাম। তবে প্রচণ্ড হট্টগোলের মধ্যে সমাধান ছাড়াই শেষ হয় সেই আলোচনা। এর পর আজ তাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।
আন্দোলনরত এক পুলিশ সদস্য জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করার কথা তাদের বলা হয়েছে। তবে তারা চাইছেন, রাজারবাগে এ বৈঠক হোক। তাতে সবাই সহজে নিজের দাবি তুলে ধরতে পারবেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ে খুব বেশি পুলিশ সদস্যের উপস্থিত থাকার সুযোগ হবে না।
রাজধানীর একটি থানায় কর্মরত এক এসআই বলেন, আমাদের মূল কথা, রাজনীতিমুক্ত থেকে নিরপেক্ষভাবে জনগণের জন্য কাজ করতে চাই। কোনো মহলের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অনৈতিক আদেশ করা হলে তা আমরা মানব না। সাম্প্রতিক ঘটনায় পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের রক্তে ভেজা এই ইউনিফর্ম পরিবর্তন করার দাবিও জানিয়েছি আমরা।
পুলিশ সূত্র জানায়, শুক্রবারের বৈঠকে আইজিপি সব দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তিনি বলেছেন, তাঁর পক্ষে যেসব দাবি পূরণ সম্ভব, সেটা করবেন। এ জন্য একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোনো সমস্যা হলে তিনি দেখবেন। তবে তাঁর এমন বক্তব্যে সন্তুষ্ট হতে পারেননি কর্মবিরতিতে থাকা পুলিশ সদস্যরা। তারা চাইছেন, প্রতিটি দাবি স্পষ্টভাবে মানতে হবে। কোনো অস্পষ্টতা থাকা চলবে না।
এদিকে আজকের বৈঠকের প্রস্তুতি হিসেবে গতকাল বিকেলে রাজারবাগে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসেন পুলিশ সদস্যরা। কোন দাবি কেন করা হচ্ছে, সেটির যৌক্তিকতা কী– এসব নিয়ে তারা কথা বলেন। আজকের বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন উপস্থাপনের কথা রয়েছে।
চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে মানববন্ধন
বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন কারণে যেসব পুলিশ সদস্য চাকরিচ্যুত হয়েছেন, তারা চাকরি পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন। ইউনিফর্ম ফেরত না পেলে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। গতকাল রাজধানীর ফুলবাড়িয়ায় পুলিশ সদরদপ্তরের সামনে এক মানববন্ধনে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যরা এ দাবি জানান। চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ক মো. তৌহিদ বলেন, আমাদের সঙ্গে বৈষম্য করা হয়েছে। আমরা চাই, জনগণের পুলিশ হয়ে কাজ করতে। স্যাররা যদি আমাদের আশ্বাস দেন এবং যৌক্তিক দাবি মেনে নেন, তাহলে আমরা আর কোনো আন্দোলনে যাব না।
সীমান্তে নিরাপত্তা বৃদ্ধি
বিজিবির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সীমান্তবর্তী অঞ্চলসহ সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ জনসাধারণের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে বিজিবি। রাজধানী ও আশপাশের জেলায় বিভিন্ন পোশাক কারখানার নিরাপত্তায়ও সেনাবাহিনীর পাশাপাশি বিজিবি রয়েছে।
জেলাগুলোতে কিছু থানায় ফিরেছে পুলিশ, অসন্তোষ
ব্যুরো, নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য বলছে, বিভিন্ন জেলার কিছু থানায় পুলিশ ফিরলেও এখন পর্যন্ত অসংখ্য থানা খালি। সরকার পতনের পর সিলেটের আট থানা, তিন পুলিশ ফাঁড়ি, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। গত ৫ আগস্ট থেকেই মূলত বিভাগের থানাগুলো পুলিশশূন্য। গত পাঁচ দিনেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করেও পুলিশ সদস্যদের মনোবল চাঙ্গা করতে পারেননি। পুলিশ সদস্যরা বলছেন, ১১ দফা দাবি না মানলে তারা কাজে ফিরবেন না। তবে জালালাবাদসহ কিছু কিছু থানায় রুটিন ওয়ার্ক শুরু হয়েছে।
বগুড়ার ১২টি থানায় সেনাবাহিনীর সহায়তায় সীমিত পরিসরে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে পুলিশ সদস্যরা থানার অভ্যন্তরীণ কাজকর্ম করেছেন। নরসিংদীতে সেনাবাহিনীর সহায়তায় স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করেছেন পুলিশ সদস্যরা। গতকাল থেকে সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ টহল চলছে জেলাজুড়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ায় এখনও কার্যক্রম শুরু হয়নি। মৌলভীবাজার জেলার সাতটি থানায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে শুরু করেছে। পুলিশ সদস্যরা কর্মস্থলে আসছেন। কার্যক্রম শুরু হয়নি রাজবাড়ী জেলার থানাগুলোর। তবে ঢাকার দোহার, কক্সবাজারের চকরিয়া, ঝিনাইদহের মহেশপুর, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার কার্যক্রম সীমিত পরিসরে শুরু হয়েছে।
samakal