নয়া কিসিমের পার্লামেন্ট

নানা নতুনের এক সংসদের কার্যক্রম শুরু হচ্ছে আজ। প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া এই সংসদের একক আধিপত্য রয়েছে আওয়ামী লীগের। নতুন  কিসিমের এই সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টির চেয়ে সংসদে ছয় গুণ বেশি আসনে বসছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ৬২ আসনের স্বতন্ত্র এমপিদের অন্তত ৫৮ জনই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা। সংসদে দলীয় অংশগ্রহণও এবার কম। মাত্র ৫টি রাজনৈতিক দলের অংশীদারিত্ব আছে এই সংসদে। সংসদ অধিবেশন শুরুর আগেই স্বতন্ত্র এমপিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা। সেখানে তাদের গঠনমূলক সমালোচনা করতে বলা হয়েছে সংসদে। এই এমপিরাও সংসদ নেতার উপর নিজেদের আস্থার কথা জানিয়েছেন। তাদের সংখ্যার বিপরীতে সংরক্ষিত আসনের এমপি মনোনয়নের দায়িত্বও তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। এবারের সংসদকে অনেকে একপক্ষীয় হিসেবে বর্ণনা করছেন।

তাদের যুক্তি সরকারের দলীয় এমপিদের পাশাপাশি স্বতন্ত্র এমপিরাও আওয়ামী লীগের নেতা। এর বাইরে জাতীয় পার্টি সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করেই নির্বাচন করে ১১ আসন পেয়েছে। এই আসনসহ ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকের প্রার্থী দেয়নি। এ ছাড়া ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি যে তিনটি আসন পেয়েছে এখানেও আওয়ামী লীগ ছাড় দিয়েছিল। তাই এসব এমপিদের নিয়ে যে সংসদ কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে তাতে বিরোধী পক্ষ চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় সংসদের ভূমিকা কেমন হবে তা দেখতে সামনে অপেক্ষা করতে হবে।

গত ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২২৩টি, জাতীয় পার্টি ১১টি, ওয়ার্কার্স পার্টি একটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) একটি, কল্যাণ পার্টি একটি এবং স্বতন্ত্র সদস্যরা ৬২টি আসন পেয়েছে। এর মধ্যে ৫৮ জন স্বতন্ত্র এমপি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদধারী। এবারই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিরোধী দলের থেকে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের সংখ্যা প্রায় ছয়গুণ বেশি। অন্যদিকে সংরক্ষিত মহিলা আসনের ৫০ জনের মধ্যে ৪৮ জন হতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নে। দুজন সংসদ সদস্য হবেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কোটায়। সবমিলিয়ে ৩৫০ জন এমপি’র মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি’র সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৩২৯ জন। এজন্য বিশেষজ্ঞরা এটাকে নতুন কিসিমের সংসদ বলে অভিহিত করছেন। তাদের যুক্তি, সাধারণত সংসদে সরকারের পক্ষে ও বিপক্ষের বিষয় থাকে। কিন্তু এবারের সংসদে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, সংসদের একটি মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে সেখানে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। সরকারকে জনগণের পক্ষ নিয়ে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা। এই কাঠামো কার্যকরের অন্যতম শর্ত হচ্ছে সংসদে একটি কার্যকর বিরোধী দল থাকা। কিন্তু আমরা এবার যে সংসদ পেয়েছি সেখানে ক্ষমতাসীন দলের মোটামুটি একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে। কাজেই এখানে প্রথাগত জবাবদিহিতামূলক যে সরকারের প্রত্যাশা সেটা নেই বললেই চলে। কাজেই এ প্রেক্ষিতে উদ্বেগটা থেকেই যাবে। তবে সংসদে যে একচ্ছত্র আধিপত্য থাকছে সেটা যদি জনস্বার্থের জন্য কাজ করে তাহলে ভালো কিছু আশা করা যেতেই পারে। তবে সেটা কতোটুকু হবে সেটা বলা মুশকিল। কারণ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কিন্তু সেটা নেই। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই সংসদের  আরেকটি দুর্বলতা হচ্ছে এখানে ৬৭ শতাংশের বেশি ব্যবসায়ী। কাজেই এখানে আলোচনা বা বিতর্ক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যে বিশেষ পেশাজীবীদের প্রভাব থেকে যাবে। একসময় আমরা সংসদ বর্জনের সংস্কৃতির কারণে সাফার করেছি। সেটা কাটিয়ে উঠে এখন আমরা যেটা পেয়েছি সেটা হলো বাস্তবে সংসদে কোনো বিরোধী দল নেই। তাই বাস্তবতার নিরিখে এই সংসদ থেকে খুব বেশি ইতিবাচক আশা করা কঠিন।

এমন অবস্থার মধ্যেই আজ মঙ্গলবার থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হচ্ছে। প্রথম দিনেই সংসদে ভাষণ দিবেন প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন। এই সংসদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ পাওয়া আওয়ামী লীগ সরকারি দল ও মাত্র ১১টি আসন নিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে চায় জাতীয় পার্টি। তবে আসন সংখ্যা কম হলেও জাতীয় পার্টির সদস্যরা সংসদে কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। অবশ্য পাশে থাকছে তাদের থেকে প্রায় ৬ গুণ বেশি ৬২টি আসনে বিজয়ী স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা। সংসদ সচিবালয় জানিয়েছে, গতকাল সোমবার একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হয়েছে। আজ মঙ্গলবার থেকে অধিবেশনের মাধ্যমে দ্বাদশ সংসদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে। বেলা ৩টায় ডেপুটি স্পিকার এডভোকেট মো. শামসুল হক টুকুর সভাপতিত্বে এই সংসদের প্রথম অধিবেশন বসবে। অধিবেশনের শুরুতে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। পরে সংসদে ভাষণ দেবেন প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন। তিনি সরকারের সফলতা ও আগামীতে করণীয় বিষয়ে অধিবেশনে দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখবেন। পরে ওই ভাষণের উপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাব নিয়ে পুরো অধিবেশনে সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যরা আলোচনা করবেন। এই অধিবেশনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস হতে পারে।

অধিবেশনকে সামনে রেখে সংসদ ভবন এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। প্রথম দিনে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। সংসদ ভবন এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অধিবেশনকে কেন্দ্র করে সংসদ ভবন জুড়ে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। অধিবেশনকে সামনে রেখে ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলে সংসদ সচিবালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে চিফ হুইপ নুর-ই-আলম চৌধুরী জানান, ৩০শে জানুয়ারি থেকে দ্বাদশ সংসদের মেয়াদ শুরু হচ্ছে। এই সংসদের সরকার ও বিরোধী দলের সব সদস্যকে অধিবেশনে উপস্থিত থাকতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। গত সংসদের থেকে এবার বেশি সময় অধিবেশন চলবে। ড. শিরীন শারমিনকে পুনঃনির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়ায় প্রথম দিন ডেপুটি স্পিকারের সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হবে। সংসদে রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানাতে বিশেষ প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আসন বিন্যাসের কাজ চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

একাদশ সংসদের মতো দ্বাদশ সংসদে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করবেন মাত্র ১১টি আসনে বিজয়ী জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা। ইতিমধ্যে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের বিরোধীদলীয় নেতা, জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বিরোধীদলীয় উপনেতা ও জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্ন বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।

অধিবেশনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। সেই দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালনে আমরা প্রস্তুত। সরকারের ইতিবাচক কর্মসূচিতে সহযোগিতা ও নেতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে সমালোচনার মাধ্যমে জনগণের স্বার্থরক্ষায় সংসদে বিরোধী দলের দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করবে জাপা সদস্যরা।
প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন জানান,  প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনে ভাষণ দেবেন। ভাষণ ইতিমধ্যে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ সাফল্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তার বক্তব্যে প্রাধান্য পাবে।

গত রোববার স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের সরকারি বাসভবন গণভবনে আমন্ত্রণ জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে প্রধানমন্ত্রী সংসদকে কার্যকর করতে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্ররা সংরক্ষিত নারী আসনের সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর ওপর ছেড়ে দেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, অধিবেশনকে সামনে রেখে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এজন্য সংসদের টানেল ও ড্রাইভওয়েতে যে কোনো ধরনের গাড়ি রাখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে দর্শনার্থীদের মোবাইল বাইরে রেখে প্রবেশ করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যেকটি মোবাইল বিশেষ ভাবে পরীক্ষার জন্যও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সংসদের অধিবেশন কক্ষে সংসদ সদস্যদের বসার চেয়ার ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়েছে। অধিবেশন কক্ষের সকল মাইক্রোফোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। অধিবেশন চলাকালে সব লিফট ত্রুটিমুক্ত রাখতে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে সংসদ ভবন ফুলসহ বিভিন্ন গাছ দিয়ে সাজানো হয়েছে। অধিবেশন চলাকালে অক্সিজেন সুবিধাসহ সার্বক্ষণিক একটি এম্বুলেন্স রাখতে বলা হয়েছে। সংসদ লবিতে একজন ডাক্তারসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী থাকবে। এ ছাড়া সংসদ অধিবেশন ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক সম্পর্কে অবহিত করতে সংসদ সদস্যদের জন্য ‘শর্ট মেসেজ সার্ভিস’ চালু করা হয়েছে।

নতুন সংসদের প্রথমদিনের অধিবেশনে প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা, দেশি-বিদেশি কূটনীতিক, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা এবং ভিআইপিদের আত্মীয়স্বজনসহ ৫ শতাধিক অতিথি উপস্থিত থাকবেন। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে সংগৃহীত তালিকা চূড়ান্ত করে আমন্ত্রণপত্র বিতরণ করা হয়েছে। আমন্ত্রণপত্র ছাড়া কোনো অতিথি ওই দিন সংসদে প্রবেশ করতে পারবেন না বলে সংসদের নিরাপত্তা বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে।

সর্বোচ্চ ৯ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বেকর্ড:
সংসদ নেতার নির্দেশ ও স্পিকারের পরামর্শ অনুযায়ী চিফ হুইপ নুর-ই-আলম চৌধুরী আসন বিন্যাস চূড়ান্ত করেছেন। আসন বিন্যাসে একাধিকবার নির্বাচিত, রাজনৈতিক দলে অবস্থান, ভোটের ব্যবধান, জনপ্রিয়তাসহ কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বারবার নির্বাচিতদের তুলনামূলক সামনের দিকে আসন দেয়া হলেও প্রথমবার নির্বাচিত হয়েও সামনের সারিতে আসন পেয়েছেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। সবচেয়ে বেশি নবমবার সংসদ সদস্য হওয়ার রেকর্ড গড়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। আর আটবার সংসদ সদস্য হয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান খান, সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান। এ ছাড়া বর্তমান কৃষিমন্ত্রী উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ, মো. দবিরুল ইসলাম, মির্জা আজম ও বীর বাহাদুর উশৈ সিং সাতবার নির্বাচিত হয়েছেন। তারা সকলেই সামনের সারিতে আসন পেয়েছেন।

সূত্র : মানবজমিন