- সৈয়দ আবদাল আহমদ
- ২৮ নভেম্বর ২০২২
- নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশ। – ফাইল ছবি
গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপিকে মহাসমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হবে না। বিএনপিকে এই সমাবেশ করতে হবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এ জন্য সরকার তার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সম্মেলন ৮ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ৬ ডিসেম্বরে এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিএনপিকে মঞ্চ তৈরি করার সময় দেয়ার জন্যই নাকি ছাত্রলীগের সম্মেলন এগিয়ে আনা হয়েছে। নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশে সরকারের ভয় কেন? জনসমুদ্রই কি ভয়ের কারণ? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে, এ মুহূর্তে গণঅভ্যুত্থান কিংবা গণআন্দোলনেই সরকারের ভয়। বিএনপি বলেছে, ঢাকায় তারা ১০ লাখ লোকের সমাবেশ ঘটাবে। এত লোক ঢাকায় এসে পড়লে সমাবেশ কোন দিকে মোড় নেয় এটিই সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে।
বিএনপিই এখন সরকারের মাথাব্যথার কারণ। তাই বিএনপিকে কীভাবে ঠেকানো যায় সেই কৌশল গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন নিয়েই তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ সরকারের মধ্যে কাঁপন ধরিয়েছে। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বিএনপি এখন সংগঠিত ও নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত। সব বাধা উপেক্ষা করে মানুষ যেভাবে সমাবেশে অংশ নিয়েছে তা সরকারকে ভাবিয়ে তোলে।
বিভাগীয় সমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতে প্রথমে সরকার জায়গা বরাদ্দ করা তথা সমাবেশের স্থানের অনুমতি দিতে তালবাহানা করে। বড় ময়দানের পরিবর্তে ছোট ময়দান নির্ধারণ করে দেয়; কিন্তু তাতেও মানুষের ঢল থামাতে না পেরে পরিবহন মালিকদের দিয়ে বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়। তাতেও দেখা যায় মানুষ দমেনি। চিঁড়া-গুড়-মুড়ি নিয়ে হেঁটে, নছিমন-করিমন, রিকশা, নৌকায় করে দু’দিন আগেই নির্ধারিত সমাবেশস্থলে এসে উপস্থিত হয়েছে। ঢাকার বাইরে এখন সমাবেশ রাজশাহীতে। ৯টি বিভাগীয় গণসমাবেশ শেষে ঢাকায় হতে যাচ্ছে মহাসমাবেশ। এখন ঢাকার সমাবেশ নিয়েই যত মাথাব্যথা সরকারের।
বিএনপি চায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ করতে। ইতোমধ্যে গত ১৫ নভেম্বর মহানগর পুলিশ বরাবরে নয়াপল্টনে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে; কিন্তু পুলিশ এখন সরকারের সুরে কথা বলছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিএনপি নয়াপল্টন চাইলেই হবে না, আমরা ঠিক করব বিএনপি কোথায় সমাবেশ করবে।’ তার এই বক্তব্যের পরই গত ২৭ নভেম্বর গণভবনে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, নয়াপল্টনে বিএনপিকে মহাসমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হবে না।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই বিএনপিকে সমাবেশ করতে হবে। গণভবনে ওই বৈঠকটি ছিল আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভা। তবে ওই বৈঠকে প্রধান আলোচ্য বিষয়ই ছিল বিএনপির ঢাকার মহাসমাবেশ। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নয়াপল্টনে ৫০-৬০ হাজারের বেশি লোকের সঙ্কুলান হবে না। বড় সমাবেশের জন্য নাকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানই উপযুক্ত জায়গা। প্রকৃতপক্ষে সরকার চাচ্ছে বিএনপির সমাবেশকে চার দেয়ালের মধ্যে আটকে রাখতে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারদিক লোহার রেলিংয়ে আটকানো। অন্য দিকে নয়াপল্টন উন্মুক্ত। চারদিকে রাস্তা। সেখানে মহাসমাবেশ হলে পুরো ঢাকাই জনসমুদ্রে পরিণত হবে।
রাজশাহীর বিভাগীয় সমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতে ইতোমধ্যে বাস ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। ঢাকার সমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতে কী কী করবে সরকার তারও আলামত শুরু হয়ে গেছে। শুধু সড়কপথই নয়, নৌপথ-রেলপথ বন্ধ করারও কৌশল নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ‘গায়েবি মামলা’ দেয়ার সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রাজপথে নামার পর গত ২২ আগস্ট থেকে গত তিন মাসে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের নামে ৫৮ জেলায় নতুন করে ২১৬টি মামলা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত ১০ দিনেই হয়েছে ১৬৫টি মামলা। সবই ‘গায়েবি’ মামলা। ইতোমধ্যে পত্র-পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে- সরকার ১০ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকাকে অবরুদ্ধ করে ফেলবে চারদিক থেকে। সড়ক, রেল ও নৌপথ কৌশলে বন্ধ করা ছাড়াও রাজধানীর প্রবেশমুখগুলোতে আওয়ামী লীগের দলীয় সভা-সমাবেশ করবে। সাভার, আশুলিয়া, রূপগঞ্জ, টঙ্গী অর্থাৎ- যেসব সড়ক দিয়ে বাইরে থেকে লোক প্রবেশ করবে তা আটকে দেয়াই সরকারের লক্ষ্য।
বিএনপির ওপর সরকারের রাজনৈতিক নিপীড়ন নির্যাতন সম্পর্কে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ঢাকা কোর্টে, জেলা আদালতগুলোতে যারা মামলার আসামি হয়ে আসছেন তাদের ৯০ শতাংশই বিএনপির নেতাকর্মী। বিএনপির ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। প্রতিহিংসার বশে আমাদের প্রায় সহস্র্রাধিক কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে ২০০৯ সালের পর ৬১১ জন গুম হয়েছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন আড়াই সহস্রাধিক মানুষ। এদের বেশির ভাগই বিএনপি ও বিএনপি সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী কিংবা ভিন্নমতাবলম্বী।’
বিএনপির ওপর দমন-পীড়ন কতটা ভয়াবহ তার এ বক্তব্যেই পরিষ্কার। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় গায়েবি মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের কী নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে তা-ও নিষ্ঠুরতার দলিল হয়ে আছে। বিএনপির বহু নেতাকর্মী বছরের পর বছর ধরে বাড়িঘর ছাড়া। তারা নিজের বাসায় পর্যন্ত থাকতে পারছেন না। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে, অন্যায়ভাবে সাজা দিয়ে, জেলে বন্দী করে রেখে কীভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে দূরে রাখা হয়েছে তা-ও দেশবাসী অবহিত। তেমনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপর নির্মম নির্যাতন ও তাকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর অমানবিক আচরণের কথাও দেশবাসীর অজানা নয়। সরকার ও আওয়ামী লীগের এমন প্রতিহিংসারই শিকার হয়েছে বিএনপি।
দেশে যেমন আজ গণতন্ত্র নেই, তেমনি রাজনীতিও নিয়ন্ত্রিত। দেশকে বিরাজনীতিকরণ করে আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য বর্তমান সরকার বিএনপিকে নির্মূল করতেই এমন নীলনকশা গ্রহণ করে। গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরেই দলটি এমন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বিএনপির ৩৫ লাখ নেতাকর্মী মামলার খড়গ মাথায় নিয়ে অমানবিক জীবন যাপন করে যাচ্ছে। তাদের আত্মীয়স্বজন পর্যন্ত নির্যাতন থেকে বাঁচতে পারছেন না। তাদের চাকরি-বাকরি, ব্যবসায়-বাণিজ্য সব বন্ধ হয়ে গেছে।
এমন রাজনৈতিক নির্যাতনের কারণ কী? শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপিকে দেশের মানুষ কেন এত ভালোবাসে, কেন বিএনপির এত জনসমর্থন, বিএনপি কেন বারবার ক্ষমতায় আসে- সেটিই সরকারের প্রতিহিংসার কারণ।
২০০৬-০৭ সালে মইন-ফখরুদ্দীনের জরুরি সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনে এমনিতেই বিএনপি ছিল পর্যুদস্ত। ধীরে ধীরে বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল; কিন্তু বর্তমান সরকারের প্রতিহিংসা অতীতকে ছাড়িয়ে গেছে। জরুরি সরকারের সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেয়া মামলাগুলো তুলে নেয়া হলেও বিএনপির নেতাকর্মীদের একটি মামলাও সরকার তুলতে দেয়নি। উপরন্তু আরো হাজার হাজার নতুন মামলা দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়ি ছাড়া করেছে। চেয়ারপারসন, স্থায়ী কমিটি, সহসভাপতি, উপদেষ্টা কমিটি, নির্বাহী কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে সর্বনিম্ন ২৫টি থেকে সর্বোচ্চ ২০০ পর্যন্ত মামলা হয়েছে। বিএনপির কোনো নেতা মাথা তুলে দাঁড়ালেই মামলা দিয়ে হয় তাকে জেলে নেয়া হয়েছে, না হয় হয়রানি করা হচ্ছে। তেমনি বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে চাইলেই কোনো না কোনো ইস্যু এনে তার অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয়া হয়।
গুম হওয়ার পর ইলিয়াস আলীর সন্ধান আজ ১০ বছরেও পাওয়া যায়নি। তেমনি চৌধুরী আলমসহ আরো অনেক নেতার ভাগ্যও একই। এভাবে গুম করে, খুন করে সর্বত্র ভয়ভীতি, ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব থাকাকালে সালাহউদ্দিন আহমদকে গুম করা হয়। এরপর তার অবস্থা কী হয়েছে দেশবাসী অবহিত। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ছয়বার জেলে নেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে ৮৬টি মামলা। যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নির্মম জেল নির্যাতনের কথা কারো অজানা নয়। তেমনি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ অনেক নেতা জেলে নির্যাতন ভোগ করেছেন। এম কে আনোয়ার আজ বেঁচে নেই। ৮৬ বছর বয়সে স্থায়ী কমিটির এই সদস্যকে জেলে নির্মম নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। সাবেক পররাষ্ট্র উপদেষ্টা রিয়াজ রহমানকে হত্যার উদ্দেশ্যে বোমা ও গুলিবর্ষণ করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর কয়েক বছর তো বিএনপিকে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডই করতে দেয়া হয়নি। মাসের পর মাস বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশের অফিসগুলো পুলিশ দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বিএনপি মিছিল বের করলেই পুলিশ গুলি চালাতো। সভা-সমাবেশ, জেলা-উপজেলা সম্মেলন ও কাউন্সিল কিছুই করতে দেয়নি। এমনকি মোমবাতি প্রজ্বলন এবং মানববন্ধনের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও বাধা দিয়েছে। শহীদ জিয়াউর রহমানের ৩৮ বছরের স্মৃতিবিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এক কাপড়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে। শেখ হাসিনার ১৪ বছরের অবৈধ শাসনকালে অত্যাচার-নির্যাতনের দিকে যদি তাকানো হয়, তাহলে দেখা যাবে- কী বীভৎস নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে এ সরকার। এভাবে বিএনপি এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে।
আন্দোলনের জন্য তৈরি বিএনপি
এত হামলা-মামলা, হত্যা, খুন, গুম ও নানামুখী নির্যাতনের পরও বিএনপি নিঃশেষ হয়ে যায়নি; বরং এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বিএনপির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বিএনপির কর্মসূচিগুলোতে মানুষের অংশগ্রহণ চোখেপড়ার মতো। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, নিত্যপণ্যসহ সব জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, যানবাহন ও শিক্ষা-চিকিৎসার ব্যয় বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিএনপি আন্দোলন করছে। আন্দোলন করছে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য। সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটি দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে বিএনপির আন্দোলন। বিএনপি চায় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনবিচ্ছিন্ন কর্তৃত্বপরায়ণ এ সরকারের পতন ঘটবে। এরপর দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে। তাই বিএনপি দেশের সব গণতন্ত্রমনা দল, নাগরিক সমাজ ও পেশাজীবী সংগঠনকে সাথে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন সূচনা করেছে। বিএনপি বলেছে, তাদের এ আন্দোলন গণতন্ত্র এবং ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এ সংগ্রাম দেশ ও দেশের মানুষকে বাঁচানোর সংগ্রাম। তাই বিএনপি এ সংগ্রামে তাদের সাথে দেশের গণতন্ত্রমনা সব মানুষকে শরিক হতে আহ্বান জানিয়েছে। বিএনপি মনে করে- তাদের ন্যায়, সত্য ও গণতন্ত্রের আন্দোলন কখনো বৃথা যাবে না।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
ই-মেইল : [email protected]