ভ্যাকসিন কূটনীতি : আমরা হেরে যাবো না তো?


ভারত থেকে করোনা ভ্যাকসিন আমদানি নিয়ে যে তেলেসমাতি শুরু হয়েছে তা শেষ অবধি কোথায় গিয়ে ঠেকে বলা মুশকিল। করোনার টিকা সম্পর্কে রূঢ় বাস্তবতা হলো বিশ্বের সব উন্নত ও ধনী দেশে ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে ব্যাপকভাবে টিকাদান শুরু হয়ে গেছে। সিঙ্গাপুর দেশের সব নাগরিকের জন্য ফাইজারের টিকা কিনে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই টিকাদান কর্মসূচি শুরু করেছে। অথচ আমরা সে টিকার জন্য গত ছয় মাস ধরে চুক্তি করে টাকার বস্তা নিয়ে বসে ছিলাম। সেই টিকার উৎপাদন শুরু হয়েছে তা-ও আবার পরীক্ষামূলকভাবে জানুয়ারি মাসে অর্থাৎ ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে। আমরা জানি না যে, কবে নাগাদ ভারতের সে প্রাইভেট কোম্পানি সিরাম ইনস্টিটিউট কথিত অক্সফোর্ডের টিকাটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করবে এবং তাদের বাংলাদেশের এজেন্ট বেক্সিমকোকে সরবরাহ করবে। কিন্তু আমরা নববর্ষের প্রথমেই জানতে পারলাম, টিকার বাণিজ্যিক উৎপাদন, রফতানি এবং বাংলাদেশকে হস্তান্তর কোনোটির বিষয়েই সিদ্ধান্ত না হলেও টিকা বাবদ ছয় শত কোটি টাকা সিরাম ইনস্টিটিউটকে পরিশোধের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

চীন ছাড়াও আমাদের আরেকটি কৌশলগত অংশীদার এবং পরীক্ষিত বন্ধুরাষ্ট্রের নাম রাশিয়া যারা চীনের পর পরই করোনার টিকা আবিষ্কার করেছে। তারা যে টিকা আবিষ্কার করেছে তা মার্কিন কোম্পানি ফাইজার এবং জার্মান কোম্পানি বায়োটেকের উৎপাদিত টিকার চেয়ে অধিক কার্যকর এবং কম দামের। আমরা কেন রাশিয়া থেকে টিকা আমদানির চেষ্টা না করে ভারতের একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন অখ্যাত ওষুধ কোম্পানির ওপর নির্ভর করে দেশের সতেরো কোটি মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিলাম তা সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা- ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লোকজনও বুঝতে পারছে না।

পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে যখন অক্সেফোর্ডের টিকা অনুমোদন পেল তখন তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা এ কথা প্রচার শুরু করল যে, ওদের টিকার মধ্যে শুয়োরের চর্বি রয়েছে। তা ছাড়া টিকাটি মাত্র ৮০ ভাগ কার্যকর যেখানে অন্যান্য টিকা পঁচানব্বই থেকে আটানব্বই ভাগ পর্যন্ত কার্যকর। এসব প্রচার প্রপাগান্ডার ফলে ইংল্যান্ডে ও ভারতে অক্সফোর্ডের টিকার সরকারি অনুমোদন আটকে গেল। ভারতের মুসলমানসহ আরো শত শত জাতিগোষ্ঠী যারা শূকরের মাংস খায় না তারা অক্সফোর্ডের টিকার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এলো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার ফাইজারসহ আরো কয়েকটি টিকার অনুমোদন দিলো বটে কিন্তু অক্সেফোর্ডের টিকার অনুমোদন আটকে দিলো। এই অবস্থায় ইংল্যান্ড ও ভারতে বহু দেনদরবার ও ধরপাকড়ের পর ডিসেম্বর মাসের একদম শেষ দিকে টিকাটি সংশ্লিষ্ট দেশ দু’টিতে অনুমোদন পেল।

বাংলাদেশে যারা অক্সফোর্ডের টিকা ভারতীয় ওষুধ কোম্পানি সিরাম ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে ক্রয় করে দেশসেবার মহান ব্রত গ্রহণ করেছিলেন তারা খুশিতে নাচতে আরম্ভ করলেন। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখের পত্রপত্রিকায় খবর বেরুলো যে, বাংলাদেশ ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে টিকা পাবে এবং এই জন্য ভারতীয় ওষুধ কোম্পানিকে ছয় শত কোটি টাকা অগ্রিম পরিশোধ করতে হবে। দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রবল বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে টাকার বস্তা রেডি করে অনেক আগে থেকেই বসে ছিল। ফলে ভারতের ওষুধ কোম্পানি সিরাম ও বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানি বেক্সিমকো অগ্রিম অর্থ পরিশোধের কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করা মাত্র টাকার বস্তায় খুশির নাচন শুরু হয়ে গেল। তারা জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখ অর্থাৎ রোববার দিনই টাকা পরিশোধের জন্য তড়িঘড়ি শুরু করে। কিন্তু রোববার দিন সকালে ভারত ও বাংলাদেশে যে খবরটি চাউর হলো তাতে টাকার বস্তায় কান্নার রোল পড়ে গেল।

২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি আমরা জানলাম, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাদের দেশে উৎপাদিত সব করোনা ভ্যাকসিনের রফতানি নিষিদ্ধ করেছে। কারণ এই মুহূর্তে ভারত পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় দেশ যেখানে করোনার ধ্বংসলীলা সবচেয়ে বেশি। অধিকন্তু দেশটির এক শত ত্রিশ কোটি লোকের সংখ্যাটি যদি বিবেচনায় আনা হয় তবে তাদের করোনা বিপর্যয়ের সাথে কোনো দেশেরই তুলনা হবে না। সুতরাং ভারত নিজ দেশের নাগরিকদেরকে টিকা না দিয়ে কোনো অবস্থাতেই বিদেশে রফতানির কোনো সুযোগ দেবে না। ভারত সম্পর্কে অন্য দেশের লোকজন যতই সমালোচনা করুক না কেন তাদের দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ এবং গণতান্ত্রিক বিধিবিধানের প্রশংসা না করে উপায় নেই।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক করোনা ভ্যাকসিন নিষিদ্ধের খবরে বাংলাদেশের সর্বস্তরে মারাত্মক হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। মন্ত্রণালয়গুলো নড়েচড়ে বসে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্থানীয় ভারতীয় দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করেন এবং কোনো ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে বলেন যে, ভারতের সাথে আমাদের যে সম্পর্ক তাতে মনে হয় না যে ভারত এমনটি করবে। অন্য দিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব এবং বেক্সিমকোর কর্তাব্যক্তিরা যেসব কথাবার্তা বলেন তাতে পুরো ঘটনা আরো তালগোল পাকিয়ে যায়। আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা বলার চেষ্টা করেন যে, যেহেতু ইতঃপূর্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছেন যে, বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেয়া হবে, সুতরাং আমাদের উচিত দুই প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করা।

আমরা সবাই কমবেশি জানি যে, চীন যখন বাংলাদেশকে বিনামূল্যে প্রায় এক কোটি টিকা দেয়ার প্রস্তাব দিলো, ঠিক সেই সময়ে দিল্লি বাংলাদেশের বিষয়ে অতি মাত্রায় আগ্রহী হয়ে পড়ল। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শ্রিংলা হঠাৎ এক ঝটিকা সফরে সামরিক বিমানে করে বাংলাদেশে এলেন এবং ঢাকা বিমানবন্দরের চিরাচরিত প্রটোকল এবং অন্যান্য কূটনৈতিক প্রটোকল এড়িয়ে অনেকটা জুলিয়াস সিজার বা নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মতো ঢাকা এলেন এবং একটি পাঁচতারা হোটেল বসে পছন্দের লোকজনের সাথে ম্যারাথন বৈঠক শুরু করলেন। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথেও দেখা করলেন। শ্রিংলার সফরের পর আমরা জানলাম যে, ভারত বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা সরবরাহ করবে। এ ছাড়া আমরা আরো জানলাম যে, বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ চীন বিনামূল্যে বাংলাদেশকে যে টিকা দিতে চেয়েছিল তা বাংলাদেশ গ্রহণ করবে না।

আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, টিকা নিয়ে বাংলাদেশের সাথে চীন ও ভারত রীতিমতো জটিল রাজনীতি শুরু করেছে। এরই মধ্যে খবর এলো, চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নজিরবিহীনভাবে বাংলাদেশ সফরে আসছেন। কিন্তু কয়েক দিনপর জানলাম, চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফর বাতিল হয়েছে। এত্তোসব ঘটনা-অনুঘটনার পর যখন ভারত টিকা রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল তখন দৃশ্যমান আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে আরেকটি খবর বাংলাদেশের কূটনৈতিক অঙ্গনকে ভাবিয়ে তুলেছে। খবরটি হলো, ভারতীয় টিকা আমদানির ব্যাপারে বাংলাদেশ যদি সরাসরি ভারত সরকারের সাথে জি টু জি ভিত্তিতে চুক্তি করত তবে টিকা পেতে অসুবিধা হতো না। এবং আগামীতেও যদি এ ধরনের চুক্তি হয় তাহলে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বাংলাদেশের টিকা পেতে কোনো সমস্যা হবে না।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার উল্লিখিত বক্তব্যে এ কথা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ সরকার যেভাবে বেক্সিমকোর মাধ্যমে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সাথে চুক্তি করেছে তা দিল্লি মোটেও পছন্দ করছে না। আমরা যদি এই মতামত বিশ্লেষণ করি তবে এ কথা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি যে, ভারত সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের সাথে লেনদেন করতে চায়- বেক্সিমকোর মাধ্যমে নয়। এখন প্রশ্ন হলো, ভারত কেন বেক্সিমকোকে পছন্দ করছে না। এই বিষয়টি নিয়ে আপনি যদি বিস্তারিত জানতে চান তবে বেক্সিমকোর মালিক পক্ষের প্রতি ভারতের মনোভাব সম্পর্কে আপনাকে ওয়াকিবহাল হতে হবে।

বাংলাদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই খুব ভালো করে জানেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে ভারত কী কী করেছে। কাজেই ভারতের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় কোনো পক্ষ ঢুকে পড়–ক সেটি তারা কোনো দিনই বরদাশত করবে না। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ভারতের চিরশত্রু চীনের সাথে বাংলাদেশের দহরম মহরম দিল্লিকে বেশ উত্তেজিত করে তুলেছে। দিল্লির অভিমত, বাংলাদেশে যেসব পাকিস্তানি লবিস্ট রয়েছে তারা আওয়ামী লীগের ওপর প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশের কূটনীতি পাকিস্তানের মাধ্যমে চীন ও তুরস্কমুখী করে ফেলেছে। ভারত খুব ভালো করে জানে, এ দেশে কারা পাকিস্তানি লবিস্ট হিসেবে কাজ করে এবং কারা ভারতমুখী কূটনীতিকে চীনমুখী করার জন্য দিবারাত্র চেষ্টা তদবির করে।

উল্লিখিত জটিল ও কুটিল হিসাবপত্র এবং নানাবিধ কূটনৈতিক রসায়ন যখন টগবগিয়ে ফুটছিল ঠিক তখনই বাংলাদেশে ভারতীয় টিকা রফতানির বিষয়ে দিল্লির নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি হঠাৎ করে উদয় হলো। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন ব্যাখ্যা করছেন। এ ক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হলো, সরকার খুব ভালো করে জানে যে, তাদের আশপাশে যারা ঘুর ঘুর করে মধু মেওয়া খায় এবং তাদের মধ্যে কাকে বা কোন গোষ্ঠীকে ভারত অপছন্দ করে। সুতরাং একটি বিষয় জানার পরও যদি কারো অপছন্দের লোক নিয়ে সরকার গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কারো কাছ থেকে কিছু আশা করে তবে সে ক্ষেত্রে ফলাফল কী হতে পারে তা সরকার না বুঝলেও সাধারণ মানুষ কিন্তু ঠিকই বুঝছে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য